মোহাম্মাদ আলী মানিক
প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
কালো মানুষদের শিল্পভাবনার ফোয়ারা, ঘানার ন্যাফটি
মোহাম্মাদ আলী মানিক

দাও ফিরিয়ে আমার কৃষ্ণ খেলার পুতুল
যা ছিল আমার সত্তার বিনোদন
আমি চাই আমার শক্তি, প্রত্যয়।
কারণ তা হলেই আমি উপলব্ধি করবো আমার আমিত্ব।১
শোষণ, নিষ্পেষণে জর্জরিত আফ্রিকার কালো মানুষদের পরাধীন জীবনের কষ্ট ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে ঘানা’র এমন অনেক কবিতায়। কবিতাগুলো হয়তো তাদের দুঃখ, দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে মনোবল জুগিয়েছে; কিন্তু প্রকৃত মুক্তির স্বাদ তারা পায়নি। স্বাধীন হয়েও স্বাধীনতা কী জিনিস তা আফ্রিকার অনেক অঞ্চল উপলব্ধি করতে পারেনি আজও। দীর্ঘদিন ডাচ, ইংরেজ, দিনেমার, সুইডিশরা এসব দেশে প্রত্যক্ষ শোষণ চালিয়েছে। শোষণের নির্মমতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার একপর্যায়ে ১৯৬০ দশকে আফ্রিকার অনেক দেশ ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বাদ আস্বাদন করতে না করতেই আবার তাদের ওপর নেমে আসে সামরিক শাসনের খড়গ। এরপর ‘দুই পরাশক্তি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৯০-এর দশকে আবার বিশ্বের অনেক স্থানের মত আফ্রিকায় গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করে।’২ কিন্তু নামে গণতন্ত্র হলেও আদতে চলতে থাকে শোষণ। তারা পড়ে যান নবতর ‘গণতান্ত্রিক-উপনিবেশ’-এর জিম্মায়।
এতো কিছুর মধ্যেও ১৮৯৭ সালে আফ্রিকার এ দেশগুলোতে আগমন ঘটে বিশ্বের নবীনতম শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রের। কিন্তু তাও বন্দি হয়ে যায় শাসকশ্রেণির হাতে। শাসকরা চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার করে বিশ্বকে বোঝাতে চায় আফ্রিকায় উন্নয়নের জোয়ার বইছে। ১৮৯৭ সালেই সিন্স ফ্রম সেন্ট্রাল আফ্রিকা নামে তথ্যচিত্র নির্মাণ করে ঔপনিবেশ রাষ্ট্র বেলজিয়াম। দেখানো হয়, আফ্রিকার মাতাদি বন্দর থেকে কিনশাসা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে নতুন রেলপথ।
অন্যদিকে বসে ছিলো না ব্রিটিশরাও। তারা বেলজিয়াম উপনিবেশিত কঙ্গোর রাবার খামারে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে নির্মাণ করে তথ্যচিত্র। সেখানে দেখানো হয়—কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর বেলজিয়ানদের নির্মম অত্যাচার। একই সঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশিত কেপটাউন শহরের কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রে দেখানো হয়—ঝকঝকে আলোকিত রাস্তাঘাট, উন্নত পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই কালো মানুষগুলো। এভাবে চলচ্চিত্রকে পুঁজি করে ঔপনিবেশ থেকে ঔপনিবেশে চলে কালো মানুষদের নিয়ে নির্মম খেলা।
তবে চলচ্চিত্রের এ চালচিত্রের পরিবর্তন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এ সময় আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে, সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রও মুক্ত হতে থাকে শোষকের করাল গ্রাস থেকে। চলচ্চিত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। বিভিন্ন দেশ জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিতে থাকে চলচ্চিত্রকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে ঘানায় প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট (National Film and Telivision Institute) বা NAFTI। ইন্সটিটিউটটিতে আফ্রিকার অন্যান্য দেশ ও বিশ্বের যেকোনো দেশের শিক্ষার্থীদের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। চলচ্চিত্র ইস্কুল বিভাগে এবারে আমাদের আলোচনার বিষয় কালো মানুষদের এই প্রতিষ্ঠানটি।
ইতিহাসের পুনর্পাঠ
ঘানা শব্দের অর্থ যোদ্ধা রাজা। নামের মতোই যুদ্ধ করতে হয়েছে তাদের, তবে এই যুদ্ধ শুধু রাজা একা করেননি; যুদ্ধ ছিলো ঘানা’র আপামর জনসাধারণের। শোষণের কবলে নিষ্পেষিত পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটির মানুষগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য দীর্ঘসময় যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে। অথচ শতাধিক জাতির বসবাস হলেও আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোর মতো এখানে অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন প্রমাণ করে যে, প্রাচীন ঘানাতে ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই মানুষের বসবাস ছিলো।
ঘানায় ইউরোপিয়দের মধ্যে ১৪৭১ সালে প্রথম আসে পর্তুগিজরা। প্রিন্স হেনরির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসা করতে আসা পর্তুগিজরা ১৪৮২ সালে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একটি দুর্গ নির্মাণ করে। যা আজকের বিখ্যাত এলমিনা দুর্গ নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে ডাচ, ইংরেজ, দিনেমার, সুইডিশ কে আসেনি; তবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সবাই যে সফল হয়েছিলো এমনটি নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি ইংরেজদের। ব্রিটিশরা এখানে চালু করে পরোক্ষ শাসন। স্বর্ণখনির প্রচার ও প্রসারের একপর্যায়ে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরাজ ঘানাতে স্থাপন করে ‘গোল্ড কোস্ট ক্রাউন কলোনি’। ইংরেজরা এ দেশটি থেকে নিজেদের স্বার্থে প্রচুর সম্পদ আহরণ করলেও ‘ঔপনিবেশের মহত্ত্বে’ একেবারে বঞ্চিত করেনি ঘানাবাসীকে। বিশেষ করে শিক্ষা বিস্তারে, সেসময় ঘানায় গড়ে উঠতে থাকে ইউরোপিয় শিক্ষায় শিক্ষিত একটি এলিট শ্রেণি। কিন্তু শোষণের মাত্রা কমে না এক বিন্দুও।
১৮৯০-এর দশকে J E Casely Hayford-এর শাসনামলে আফ্রিকান এলিটরা Aborgines Rights Protection Society প্রতিষ্ঠা করে। এর উদ্দেশ্য ছিলো ইংরেজদের ভূমি ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করা। সেসময় এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪—১৮) আফ্রিকানদের চোখ কিছুটা খুলে দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হলেও এ অঞ্চলে আধিপত্যের প্রশ্নে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মতো শক্তি বা সামর্থ্য অবশিষ্ট ছিলো না তাদের। কিন্তু তারা এ উপনিবেশ ছাড়তেও চাইছিলো না। এ সময় যতোটা সম্ভব দেরিতে প্রভুত্ব ছাড়ার কৌশল অবলম্বন করে তারা। কিন্তু আফ্রিকানরা ক্রমেই স্বাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে।
১৯৪৯ সালে ঘানার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা কাওয়ামে নক্রুমা প্রতিষ্ঠা করেন কনভেনশন পিপলস্ পার্টি বা সিপিপি। আমেরিকান ও ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত নক্রুমাই ছিলেন ঘানার অন্যতম প্রধান জাতীয়তাবাদী সফল নেতা। সিপিপি পার্টি ও নক্রুমা মিলে শ্রমিক, কৃষক, যুবক, নারী সবার সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। ১৯৫০ সালে সিপিপি’র নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে নক্রুমা গ্রেপ্তার হন। কিন্তু ১৯৫২ সালের নির্বাচনে নক্রুমার দল দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় লাভ করলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দিতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার।
নক্রুমা শুরুতে ইংরেজ গভর্নরের সঙ্গে সহযোগিতামূলক পন্থা অবলম্বন করেন। এতে ঘানা বা গোল্ড কোস্টে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়। ১৯৫৪ সালে সংবিধানে উপজাতি কাউন্সিল বাতিল করা হয়। তবে স্বাধীনতা আন্দোলন চলতেই থাকে। ১৯৫৬ সালে আবার নির্বাচন হলে সিপিপি ৫৭ শতাংশ ভোট পায়। নক্রুমার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ৩ আগস্ট ১৯৫৬ ব্রিটিশ কমনওয়েলথে ঘানার স্বাধীনতা চেয়ে প্রস্তাব পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৬ মার্চ ঘানার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নক্রুমা। ওই দিনই নাম পরিবর্তন করে গোল্ড কোস্ট থেকে ঘানা করা হয়। এরপর ঘানার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন কাওয়ামে নক্রুমা। তিনি ঘোষণা দেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে ঘানাকে তারা পুরো আফ্রিকার জন্য মডেল হিসেবে তৈরি করবেন। ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত নক্রুমা সেখানে একধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন।
এরপর সামরিক ক্যু ১৯৮০ দশক পর্যন্ত ঘানাকে বিপর্যস্ত করে রাখে। বিপর্যস্ত ও অস্থির এই সময়ের মধ্যে ১৯৭৮ সালে ঘানায় প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট।
ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট
ঠিক কোন্ উদ্দেশ্যে ঘানার তৎকালীন সামরিক সরকার ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলো তা একটু রহস্যজনকই। তবে এ কথা ঠিক, এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিঃসন্দেহে পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলোর মধ্যে আলোর সঞ্চার করেছিলো। রাজধানী আক্রার পূর্ব সেনানিবাসের সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট (ন্যাফটি)। প্রতিষ্ঠার বছর থেকে শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ন্যাফটি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে পড়াশোনার জন্য আফ্রিকার মালি, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যামেরুন, বুরুন্ডি, সোয়াজিল্যান্ড, উগান্ডা, ঘানা, ইথিওপিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, গাম্বিয়া দেশগুলোর শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে।
আফ্রিকার পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে ন্যাফটির গ্রাজুয়েটরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। একই সঙ্গে ইন্সটিটিউটটি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে বছরের পর বছর কারিগরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ন্যাফটি ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সংস্থা ও টেলিভিশন অ্যাকাডেমি’র সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আফ্রিকায় কোনো প্রতিষ্ঠানের এতো বড়ো অর্জন এটিই প্রথম।
ন্যাফটির শিক্ষার্থীদের নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বার্ষিক এবং দ্বি-বার্ষিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। এছাড়া ইন্সটিটিউটে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মশালা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এসব কর্মশালা ও অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা ও গণমাধ্যমব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়; যাতে তাদের সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীরা সর্বোত্তম অনুশীলন, পাঠ্যক্রম সহায়তা, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিষয়ে ভালোভাবে জানতে পারে।
এছাড়া আন্তঃসাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রেও অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে ন্যাফটি। সাম্প্রতিক ন্যাফটির সঙ্গে তিনটি ক্ষেত্রে শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম চালু আছে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঘানার National Survey of Student Engagement (NSSE)-এর অধীনে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কির আরকাডা ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, দক্ষিণ আফ্রিকার দ্য সাউথ আফ্রিকান স্কুল অব মোশন পিকচার্স মিডিয়াম অ্যান্ড লাইভ পারফরমেন্স (এএফডিএ) ও ইউনিভার্সিটি অব জোহানেসবার্গ, বুর্কিনা ফাসোর ইউনিভার্সিটি অব লুয়া (আইএসআইএস) ও জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কোন-এর সঙ্গে শিক্ষার্থী বিনিময় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যাফটি প্রধান অধ্যাপক লিনাস আব্রাহাম বলেন, ‘আমরা আফ্রিকাসহ সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদেরকে আনন্দদায়ক পরিবেশে চলচ্চিত্র শিক্ষা এবং অনুশীলনের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি—আমাদের যে শিক্ষাক্রম রয়েছে তা তোমাদের দক্ষ প্রতিযোগী করে তুলবে। তুমি দেশে ফিরে ইন্ডাস্ট্রিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
ঘুরে আসি ন্যাফটি ক্যাম্পাস
রাজধানী আক্রার আবাসিক এলাকার পাশ ঘেঁষে পায়ে হাঁটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ন্যাফটি। শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখেছে তারা। প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতির বিস্তার ও উন্নয়ন করা হয়েছে এখানে। তিনটি স্টুডিও ও চারটি অ্যাকাডেমিক ভবন নিয়ে ন্যাফটি ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের আবাসিক ভবনগুলো মূল ক্যাম্পাস থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ দূরত্বে। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বাধুনিক প্রেক্ষাগৃহসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ঠিক এই আবাসিক এলাকাতেই অতিথি শিক্ষকদের জন্যও রাখা হয়েছে চারটি সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট।
এছাড়া ন্যাফটির রয়েছে বিশাল কেন্দ্রীয় পাঠাগার। পাঠাগারে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিষয়ে ২৫ হাজারের বেশি বই রয়েছে। সঙ্গে আছে ২০টি স্তরে সাজানো সম-সাময়িক জার্নাল ও ম্যাগাজিনের এক বিশাল সংগ্রহ। এছাড়া চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্য সুসজ্জিত স্টুডিও, কম্পিউটার অ্যানিমেশনের সুযোগ-সুবিধা ও স্টিল ফটো ল্যাবরেটরি তো রয়েছেই।
ইন্সটিটিউটে আফ্রিকার ঐতিহ্য ও মান ধরে রাখার জন্য ২০০২ সালে ‘আফ্রিকান সিনেমা রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন সেন্টার’ (ACREDOC) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রটি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের ভাষা নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে; যা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ উন্নয়নে অবদান রাখবে। এই কেন্দ্রেও আফ্রিকার চলচ্চিত্র, বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও, কাগজপত্র ও নানা ধরনের বইয়ের রয়েছে বিশাল সংগ্রহ। যা মূলত উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়।
ন্যাফটি’র শব্দ বিভাগের অধীনে রয়েছে আফ্রিকার আঞ্চলিক সাউন্ড ডাবিং কেন্দ্র ‘জ্যঁ রুশ সাউন্ড ডাবিং সেন্টার’। ফ্রান্সের সিফা ও ন্যাফটির সমন্বয়ে গঠিত এ কেন্দ্রটি বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র ডাবিংয়ের কাজ করে থাকে। একই সঙ্গে এটি আফ্রিকার প্রযোজকদেরকে তাদের চলচ্চিত্রগুলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে।
যা পড়ানো হয়
ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু ছিলো। এরপর ন্যাফটি’কে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হলে চার বছরের ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস (বিএফএ) ডিগ্রি ও দুই বছরের ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম চালু হয়। শিক্ষার্থীরা পৃথক সাতটি বিষয় যথা : টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, চলচ্চিত্র পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, চলচ্চিত্রে শব্দ প্রকৌশল, অ্যানিমেশন, চলচ্চিত্র সম্পাদনা ও শিল্প-নির্দেশনায় বিএফএ ডিগ্রি নিতে পারে। চার বছরের এসব কোর্সে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো প্রথম দুই বছর সাধারণ পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি আফ্রিকার জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও আফ্রিকার নাটক নিয়ে দুটি আবশ্যক কোর্সও করতে হয়। আবশ্যিক এসব শিক্ষাক্রম এমনভাবে সাজানো যাতে তত্ত্ব ও ব্যবহারিক কাজের একটা সমন্বয় করা হয়েছে।
২০১১—২০১২ শিক্ষা বছরে ন্যাফটি’তে প্রযোজনা, চিত্রনাট্য লেখা, অভিনয় শৈলী, সিনেমাটোগ্রাফি, ডিজিটাল ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল ইমেজ উৎপাদন, স্টিল ফটোগ্রাফি, প্রামাণ্যচিত্র, সম্প্রচার সাংবাদিকতা—এ নয়টি বিষয়ে প্রফেশনাল পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে। এই প্রোগ্রামের কাঠামো এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী ও প্রফেশনাল ডিপ্লোমার শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি আগ্রহী হয়। এ কোর্স করার জন্য অ্যাকাডেমিকভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সনদও আবশ্যক।
এছাড়া ন্যাফটি’তে তিন-চার মাস মেয়াদি সংক্ষিপ্ত কিছু কোর্সও চালু আছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রবিবার ক্লাস করে থাকে। এ কোর্স করার ক্ষেত্রে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের চিত্রনাট্য, নকশা, পরিচালনা, শুটিং, শব্দগ্রহণ, সম্পাদনা ও ভিডিও প্রজেক্ট ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। এর বাইরেও সাত দিনের কিছু সংক্ষিপ্ত কোর্স চালু রয়েছে ন্যাফটি’তে। বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় সাধারণত বছরের বিভিন্ন সময় এসব কোর্সের আয়োজন করা হয়।
যেভাবে ভর্তি
সার্বিক বিবেচনায় আপনি যদি ঘানার ন্যাফটি’তে ভর্তি হতে চান, তবে আপনাকে ইন্সটিটিউট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। তারপর আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় অ্যাকাডেমিক কাগজপত্র সংযুক্ত করে তা জমা দিতে হবে। আবেদনপত্র সংগ্রহের প্রাথমিক যোগ্যতা হিসেবে আপনাকে মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগের একটি করে এবং ইংরেজি ভাষা ও গণিতসহ মোট পাঁচটি বিষয়ে ‘ও’ লেভেল উত্তীর্ণ হতে হবে। ‘এ’ লেভেলের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। এর মধ্যে একটি বিষয়ে ন্যূনতম ‘ডি’ গ্রেড এবং একটি আবশ্যিক বিষয়ে অবশ্যই কৃতকার্য হতে হবে।
আর ওয়েস্ট আফ্রিকান সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট এক্সামিনেশন (WASSCE) ও সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট এক্সামিনেশন (SSSCE) পাস শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তিনটি মূল বিষয় ইংরেজি, গণিত, ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স/সোশ্যাল স্টাডিজ/ লাইফ স্কিল এবং নির্বাচিত প্রাসঙ্গিক যে কোনো তিনটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে।
ন্যাফটি থেকে তিন বছরের ডিপ্লোমা করা শিক্ষার্থীরাও বিএফএ ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের ৫৫ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। এছাড়া যাদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতা নেই কিন্তু চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিষয়ে পেশাগত অভিজ্ঞতা আছে এবং বয়স ২৭ বছর বা তার বেশি তারাও এখানে আবেদন করতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ন্যাফটি’র লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
ঘানার শিক্ষার্থীদের ৭০ সিডি’র (ঘানার মুদ্রা) বিনিময়ে সরাসরি অথবা ব্যাংক থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। পোস্টাল বা মানি অর্ডারে আবেদনপত্র সংগ্রহ করা যাবে না। আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব সনদপত্রের ফটোকপি সংযুক্ত করে পাঠাতে হবে। কেবল সংক্ষিপ্ত তালিকায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হবে।
ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ
ঘানা সরকার কেবল নিজেদের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ইন্সটিটিউটটি প্রতিষ্ঠা করেছে এমনটি নয়, বিদেশি শিক্ষার্থীদেরও রয়েছে অধ্যয়নের সুযোগ। বিদেশি শিক্ষার্থী এবং ঘানার অধিবাসী যারা দেশের বাইরে বাস করেন তাদেরকে ভর্তির আবেদনপত্র ন্যাফটি’র ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এরপর ব্যাংক ড্রাফ্টের মাধ্যমে আবেদনপত্রের মূল্য বাবদ ৮০ ডলার ইন্সটিটিউটে পাঠাতে হবে। তাছাড়া সরকার, আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা, সম্প্রচার সংগঠন অথবা অন্য কোনো চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউট সেই শিক্ষার্থীর আর্থিক দায়িত্ব নিলে সেই প্রতিষ্ঠান স্বাক্ষরিত নিশ্চয়তাপত্র আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। নিচের ঠিকানায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা তাদের আবেদনপত্র সংগ্রহ ও পাঠাতে পারেন।
THE REGISTRAR
National Film and Telivision Institute (NAFTI),
Private Mail Bag,
General Post Office,
Accra,Ghana.
Tel : 233-0302-777610 / 777159
Fax : 233-0302-774522
E-mail : nafti@4u.com.gh, info@nafti.edu.gh
এছাড়া ইন্সটিটিউটটির ওয়েবসাইটে (www.nafti.edu.gh) ভর্তি ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
লেখক : মোহাম্মদ আলী মানিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
manikmcjru@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. লিওন ডালমাস, উদ্ধৃত; হোসেন, ড. আবু মো. দেলোয়ার ও অন্যান্য (২০১১ : ১৩৫); আফ্রিকার ইতিহাস; বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা।
২. প্রাগুক্ত; হোসেন, ড. আবু মো. দেলোয়ার ও অন্যান্য (২০১১ : ১০৭)।
পাঠ সহায়িকা
গুপ্ত, ধ্রুব (২০০৯); ‘সেলুলয়েডের ফিতেয় আফ্রিকা’; শতবর্ষে চলচ্চিত্র ২; সম্পাদনা—নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
হোসেন, ড. আবু মো. দেলোয়ার ও অন্যান্য (২০১১); আফ্রিকার ইতিহাস; বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন