আ-আল মামুন
প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
ম্যাজিক আলাপন
প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র সমালোচনা
আ-আল মামুন
(তারিখ : ২৬ জুন ২০১৩, স্থান : ১২৩ রবীন্দ্র কলাভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।)
কাজী মামুন হায়দার : উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা। আমরা একেবারে একটা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা এর নাম দিয়েছি ম্যাজিক আলাপন। এখানে কথা বলবেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আ-আল মামুন (আব্দুল্লাহ আল মামুন)। যিনি, দীর্ঘদিনই বলবো আসলে, প্রায় এক যুগ ধরে ফিল্মের সমালোচনায় কাজ করছেন। সবারই একধরনের অভিযোগ থাকে, চলচ্চিত্র নিয়ে ভালো সমালোচক, ভালো সমালোচনা কিংবা কোনোটাই দাঁড়ায়নি; যা হয় তা শুধু একধরনের কাদা-ছোড়াছুড়ি। এর বাইরে দাঁড়িয়ে যে কয়েকজন লোক এ ধরনের কাজ করছেন তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন অন্যতম।
আমরা মূলত এখানে ম্যাজিক লণ্ঠন এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফিল্ম স্টাডিজ কোর্সের শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়েছি। আমরা মূলত কথা শুনবো স্যারের কাছে। আমরা নিজেরাও সেই আলাপে সম্পৃক্ত হবো। আমাদের কিছু প্রশ্ন থাকলে সেগুলো আমরা করবো। স্যারও হয়তো সেই ভাবে আলোচনা এগিয়ে নেবেন। আমি স্যারকে অনুরোধ করছি আলাপ শুরু করার জন্য, আমাদের ম্যাজিক আলাপন শুরু করার জন্য।
আ-আল মামুন : ধন্যবাদ মামুন। এটা একটা ভালো প্লাটফর্ম কথা বলার জন্য। আলাপনে ম্যাজিক থাকবে কি না জানি না; তাবে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর প্লাটফর্ম একটি ভালো প্লাটফর্ম। এটা যে ম্যাজিক আলাপন হয়ে উঠবে—এমনটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, কারণ আমি প্রস্তুত না। আমি আগেই বলে নিয়েছিলাম যে, কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই কথা বলতে হবে। কারণ, সময় নেই, আর সে প্ল্যানও আমি করতে পারিনি। তো দেখা যাক, প্রস্তুতিহীন জায়গা থেকেও অনেক সময়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বের হয়ে আসতে পারে; অনেক সম্ভাবনার জায়গা বের হয়ে আসতে পারে। এবং এখানে দুইটা জায়গা ওপেন রাখতে চাচ্ছি আলোচনার সময়। এর একটা হলো, আমার দিক থেকে আমি যেকোনো সময় তোমাদেরকে প্রশ্ন করতে পারি, এটা ফরমাল কোনো প্রেজেন্টেশন না, ওকে। দ্বিতীয়ত, তোমাদের দিক থেকেও তোমরা যেকোনো সময় হাত তুলে আমাকে প্রশ্ন করতে পারো। কারণ এখানে ওরকম কোনো স্ট্রাকচারড আলোচনা নাই। আনস্ট্রাকচারড, ইনফরমাল, খুবই ঢিমে তালে চলা একটা আলোচনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে।
যাই হোক, শুরু করি এভাবে, ফিল্ম ক্রিটিসিজমের কথা বলছি, কিন্তু আমি খুব কম লিখেছি। অনেক সময় ধরে আমি মাত্র কয়েকটা লেখা লিখেছি, খুব অল্প কয়েকটা। সময়ের হিসাবে সেটা প্রায় এক দশক, যুগও হয়ে গেছে, হয়তো! এই ১০ বছরে ফিল্ম নিয়ে আমি তিনটা বা চারটা লেখা লিখেছি। আর এখন একটা লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তো সময়ের হিসাবে এটা দীর্ঘ এবং প্রোডাকশন হিসেবে খুবই অল্প। সেহেতু ফিল্মক্রিটিক হিসেবে সেই অর্থে আমার বাজারদর তৈরি হয়নি। সেটা হোক আমি তা চাইও নাই, আই মাইসেল্ফ অ্যাজ অ্যা ফিল্মক্রিটিক—কখনো দেখতেও চাই নাই। কিন্তু ফিল্ম নিয়ে একটা ইন্টারেস্টের জায়গা তো আছেই। কারণ ফিল্ম একটা মেজর মিডিয়াম, এবং এই মেজর মিডিয়াম আরো বেশি ইম্পোর্টেন্ট হয়ে উঠেছে এই সময়ে।
আ-আল মামুন
এই সময়ের একটা মেজর ডাইমেনশন হলো যে, আমরা বলতেছি—অনেক থিওরেটিশিয়ান বলতেছে, এই যুগটা হচ্ছে ইমেজের যুগ, এই যুগটা হচ্ছে ভিজ্যুয়ালের যুগ। বলা হচ্ছে যে, আমাদের সোসাইটি একটা ভিজ্যুয়াল টার্ন-এ এসে পড়েছে। বলা হয়, একটা সময়ে কালচারাল টার্ন ঘটেছিলো। সমাজ অধ্যয়নে কালচারাল টার্ন বলে একটা ধারণা ব্যবহার হয়—এটা তোমরা জানো কি? যখন অনেক ডিপার্টমেন্টে, ধরো যে কালচারাল স্টাডিজ নামে যে ডিপার্টমেন্টগুলো গড়ে উঠেছে ফিফটিজ-এ, সেই কালচারাল স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলো বলছে, কালচারাল টার্ন বলে কিছু একটা ঘটেছে।
তখন, যেকোনো প্রোডাকশনের, যেকোনো ইন্সটিটিউশনের, যেকোনো ক্রিয়েশনের, যেকোনো প্র্যাকটিসের কালচারাল ডাইমেনশন অ্যানালিসিস গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই যেমন ধরো, রিগ্যান এবং চিনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটা আলাপ হবে, তো সেখানে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের জায়গা থেকে একটা ডাইমেনশন আছে তো বটেই। কিন্তু এই রিলেশনের ক্ষেত্রে দুই দেশের কালচারাল প্র্যাকটিসগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলবে, কোন্ স্থানে, কীভাবে মিটিং অ্যারেঞ্জ করা হবে—সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। তো কালচারাল ডাইমেনশন অ্যানালিসিস করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে সেই ফিফটিজ থেকে এবং অনেকদিন ধরে এই ডাইমেনশনটা বিশ্লেষণের চল আমরা দেখে আসছি। এবং তারপরে, এই নাইনটিজে এসে টেকনোলজিকাল ট্রান্সফরমেশনের কারণে, আমি ক্লাসেও পড়াচ্ছিলাম যে, আজকের সোসাইটির রিলেশনের স্ট্রাকচার বদলে যাচ্ছে। সেখানে ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্স, ভিজ্যুয়াল ইমেজারি আমাদের বাস্তবতাকে প্রতিনিয়ত কন্সটিটিউট করতেছে।
আমাদের কাছে ফিকশন এবং রিয়ালিটির পার্থক্য অনেক কমে আসতেছে। তো, আমরা কখন কিসের মধ্যে বাস করি? ধরো আইডেন্টিটির যে ডাইমেনশন—আমি একজন মানুষ। এখন ধরো, আমার একটা নাম আছে, আমার একটা পরিচয় আছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে, এই পরিচয় নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। কিন্তু ফোন আমাকে এমন সুযোগ দেয়, আমি হয়তো একজন পুলিশ হয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি; আমি একজন ডাক্তার হয়ে কথা বলতে পারি; আমি একজন জিনের বাদশাহ হয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি, তাই না! এ রকম অনেক ফোন কলও আসে। কিংবা ধরো যে অনলাইনে আমি যখন কথা বলি, তখন অনেক আইডেন্টিটি নিয়ে আমি কথা বলতে পারি। এটা হলো, ফিকশনাল কিংবা ইমাজিনারি যে আইডেন্টিটি এবং রিয়ালিটির যে আইডেন্টিটি আছে, এই ইমাজিনারি এবং রিয়ালিটির ডিসটেন্স এখন বিপুলভাবে কমে আসছে টেকনোলজির প্রভাবে। সেই টেকনোলজির একটা মেজর ডাইমেনশন হচ্ছে ভিজ্যুয়াল। এখন ভিজ্যুয়ালিটি আমাদের দৃশ্যমানতা, আমাদের সত্তা প্রতিনিয়ত নির্মাণ করতেছে। তো এই পিক্টোরিয়াল টার্ন যখন ঘটছে একটা সোসাইটিতে, সেই সোসাইটিতে—বস্তুত প্রতিটা সমাজে এবং মানুষের জীবন-যাপনের সাথে ইমেজ প্রোডাকশন, রিপ্রোডাকশন এবং কনজামশন এতো নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে যখন, তখন তাহলে ফিল্মের গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়ে যায়। কথাটি কি ঠিক মনে হচ্ছে?
ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের নাম তো বোধহয় জানো সবাই, জানো? (দর্শকদের উদ্দেশে) তো ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যখন ‘দ্য ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দ্য এইজ অব মেকানিকাল রিপ্রোডাকশন’ (যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা) লিখছেন ১৯৩৬ সালের দিকে, তখন ফিল্ম একটা নতুন টেকনোলজি হিসেবে সোসাইটিতে আসছে। তিনি বললেন, একটা শিল্প, শিল্পবস্তু বা একটা শিল্পস্থাপনার একটা ‘অরা’ (Aura) মানে ‘সৌরভ’ থাকে, যেমন সবকিছুর একটা সৌরভ থাকে। আমার যেমন একটা সৌরভ আছে—গাম্ভীর্য, আবেগ সবকিছু মিলে আমার আইডেন্টিটির একটা আবহ থাকে। সেই আবহ তোমাকে প্রভাবিত করে, যখন তুমি আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করো। তো শিল্পের এই রকম একটা সৌরভ থাকে, যেকোনো শিল্পের। সেই শিল্পের কাছে গেলে সেটা বোঝা যায়, এবং এইটাই হচ্ছে রিয়াল; এর কোনো রিপ্রোডাকশন হয় না। তো, রিপ্রোডাকশন যখন হচ্ছে, তখন তাহলে সৌরভটা হারিয়ে যাচ্ছে, অরিজিনালিটি আর কিছু থাকছে না। মোনালিসা (চিত্রকর্ম) একটাই অরিজিনাল; কিন্তু এখন হাজার হাজার মোনালিসা রিপ্রোডিউস হচ্ছে। এখন হাজার হাজার কপি, ফটোকপি; এবং কোন্টা আসল আর কোন্টা নকল, এই সব পার্থক্য আর থাকছে না। এ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক অনেকভাবে বলেছেন।
তো, বেঞ্জামিন বলছেন, শিল্পের এই সৌরভ যদিও হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু টেকনোলজি হিসেবে ফিল্ম কিংবা ফটোগ্রাফি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফিল্মের...যেমন ধরো, ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা ফিল্ম আছে, মামুন (কাজী মামুন হায়দারকে লক্ষ্য করে) লাস্ট..., কী যেনো? (কেউ একজন বললো) লাস্ট লিয়ার। দেখেছো নাকি তোমরা? তো লাস্ট লিয়ার-এ দু-একটা কথা এসেছে এ রকম, ওখানে প্রধান চরিত্র, স্টেজে যিনি অভিনয় করেন, তিনি এ রকম করে বলেন যে, আমি যখন স্টেজে অভিনয় করি তখন একটা টোটালিটি থাকে; কিন্তু আমি যখন ফিল্মে যাই, তা কোনো অভিনয় মাধ্যম হইতে পারে না; তাতে নিজেকে এক্সপ্রেস করা যায় না। এখানে (ফিল্মে) তুমি যখন আমার হাত দেখতে পারছো, আমার মুখ দেখতে পারছো না; পা দেখতে পারতেছো তো আবার মাথা দেখতে পারতেছো না। কখনো ক্লোজ-আপে বড়ো বড়ো করে দেখানো হচ্ছে। এই যে আমি একটা দেখতে পাচ্ছি তো আরেকটা দেখতে পাচ্ছি না; এবং আমি কী করছি? ক্যামেরা, তার, লাইট সবকিছু আমার ভিতরে এসে ঢুকে যাচ্ছে—ক্যামেরা এদিক দিয়ে আসছে, ওদিক দিয়ে আসছে, আমাকে ওখানে গিয়ে একটা ভঙ্গি করতে হচ্ছে—এটা তো কোনো অভিনয় হতে পারে না, এটা কোনো শিল্পমাধ্যম হতে পারে না। স্টেজে অভিনয়ের যে ‘সৌরভ’ তা ফিল্মে হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে লাস্ট লিয়ার-এর সেই ক্যারেক্টার, সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে না। কিন্তু তবু সে পরিচালকের যুক্তি মেনে ফিল্মে অভিনয় করতে রাজী হচ্ছে। সে (পরিচালক) বলছে যে, দেখেন এটা একটা খারাপ দিক বটে যে স্টেজের মতো টোটালিটি থাকছে না, কিন্তু ফিল্মের একটা পজিটিভ দিকও তো আছে, সেটা হলো—আমি যেটুকু দেখাতে চাই, যা দেখাতে চাই, ডিরেক্টর যা দেখাতে চায়, যেটুকু দেখাতে চায় সেইটুকুই দেখানো যায়। আমার যখন পা দেখানোর দরকার নেই, আমি তখন পা দেখাবো না। আমার দেখানোর দরকার মুখের এক্সপ্রেশন, তাহলে আমি মুখই দেখাবো।
তাহলে ডিরেক্টর এখানে একটা কেন্দ্রীয় রোল প্লে করছে এবং সবকিছু যোগ করে সে একটা কিছু ক্রিয়েট করছে। এবং সেটাই সে করবে, যদিও তার পুনরুৎপাদন হচ্ছে, বারবার রিপ্রোডিউস হচ্ছে; অরিজিনাল বলে কোনো কিছু থাকছে না; কিন্তু তবু ফিল্মের সম্ভাবনা অন্য জায়গা থেকে দেখতে হবে। বেঞ্জামিন এটাকে বলছিলো যে, ফিল্মের/ফটোগ্রাফির ইমান্সিপেটরি একটা সম্ভাবনা আছে। সেটা হলো যে, ফিল্ম পার্টিসিপেশন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার পক্ষে তো মোনালিসাকে দেখে আসা সম্ভব না, মোনালিসাকে লুভ্যর মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে আসা সম্ভব না। কিন্তু আমি মোনালিসাকে চিনি। তারপরে, এখন আমি কী করছি? আমি মোনালিসাকে শুধু চিনিই না, মোনালিসাকে রিপ্রোডিউস করছি বারবার এবং মোনালিসাকে রিকন্সট্রাক্ট করছি। কী করি, মোনালিসার মুখে আরেকজনের মুখ বসিয়ে দিই, মোনালিসার হাত নাড়া-চাড়া করাই; মানে আমাদের ফটোশপে কিংবা অন্যান্য সফটওয়্যারে করি এগুলো। তাহলে এইগুলো আমরা কী করছি? আমরা, এই যে একটা শিল্প মাধ্যম, সেটাকে ব্যবহারের জায়গা থেকে অনেক বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছি, আমরা পার্টিসিপেট করছি। তো, বেঞ্জামিন একজন মার্কসিস্ট, সে মনে করছিলো, সমাজের যে সাবলটার্ন বা যাদেরকে আমরা প্রলেতারিয়েত বলছি, প্রলেতারিয়েতদের যে জাগরণ সম্ভাবনা, সেটা জাগাতে হলে ফিল্ম একটা খুব শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।
তো যদি এই হয় সম্ভাবনার জায়গা, তাহলে আবার এর পাশাপাশি আরেকটা দুর্ভাবনার জায়গাও আছে। যেহেতু এটা ভীষণ শক্তিশালী একটা মাধ্যম, সেহেতু এই ভীষণ শক্তিশালী মাধ্যম দিয়ে ভীষণ শক্তিশালী কিছু করা সম্ভব, যেটা ডেস্ট্রাক্টিভ হতে পারে, অ্যাটোম বোমার মতো। পারমাণবিক চুল্লির যে তাপ-এনার্জি, তা সারাপৃথিবীর মানুষকে খাইয়ে পরিয়ে রাখবার মতো এনার্জি দিতে পারে, চিকিৎসাসহ বহু কিছু দিতে পারে। সেই এনার্জিটাই আবার হাজার হাজার, লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষকে মুহূর্তের মধ্যেই মেরে ফেলতে পারে; হিরোশিমা, নাগাসাকি এর দৃষ্টান্ত। তো, ফিল্ম ওরকম একটা মাধ্যম। আমার মনে হয় তোমরা সবাই জানো, ফিল্মের এই জায়গাটা খুবই ইম্পোর্টেন্ট; যেহেতু তা নিয়ার রিয়াল, রিয়ালের এতো কাছাকাছি যে, ফিকশন এবং রিয়ালিটি কিংবা আমাদের ইমাজিনেশন এবং রিয়ালিটির ডিসটেন্স কমিয়ে দেয়; কিংবা আমাদের ইমাজিনেশনে যা কিছু আছে, যা কিছু আমরা ভাবতাম যে বিইয়ন্ড আওয়ার রিচ, সেই বিইয়ন্ড রিচ’টাকে আমাদের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসে, অন্তত ইমাজিনেশনে হলেও, একধরনের রিয়ালিটির অনুভূতি তৈরি করে। তো সেই কারণে এর ডেস্ট্রাকটিভনেস এবং পটেনশিয়াল কন্সট্রাকটিভনেস অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশন টু দ্য সোসাইটি—দুই দিক থেকেই এর ক্ষমতা অনেক বেশি। তো যাই হোক, এ পর্যন্ত যা বললাম তা ফিল্ম সম্পর্কে একটা গৌরচন্দ্রিকা, অর্থাৎ এই সময়ে, মানে আমাদের সময়ে, ফিল্ম ঠিক কী হতে পারে তার একটা আভাস দিলাম।
আমার আজকের আলোচনার বিষয় হলো, ফিল্ম ক্রিটিসিজম। তো, একটা প্রশ্ন হতে পারে এ রকম : ফিল্মের ক্রিটিক নাকি ফিল্ম ইটসেল্ফ একটা ক্রিটিক হয়ে উঠতে পারে? সোসাইটিতে ফিল্ম অ্যাজ অ্যা টুল, সেটা দিয়ে আমি সোসাইটির অসঙ্গতির নানারকম ডাইমেনশন তুলে ধরতে পারি, পারি কি না? মাইকেল মুর যে ফিল্ম বানায়, ধরো ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানায়, সেই ডকুমেন্টারি ফিল্ম কী বলে? ক্যাপিটালিজমের প্রতিপাদ্য বিষয় কী; কিংবা অস্ত্রের সঙ্গে আমেরিকান পলিসির কী রিলেশন; কিংবা ধরো যে ফারেনহাইট নাইন/ইলেভেন আসলে কী বোঝায়? একটা সিস্টেম, সেখানে নানারকমের প্র্যাকটিস, সেই প্র্যাকটিসগুলোর ক্রিটিসিজম-ফিল্ম ইটসেল্ফ সেই ক্রিটিসিজম হিসেবে প্রোডিউসড হতে পারে, তাই না?
কিন্তু আবার আমরা বলছি, ফিল্মের ক্রিটিক করাও দরকার। তাহলে সেটা কোন্ রকমের ফিল্ম? একধরনের ফিল্মের কথা বলছি, যেটা ইটসেল্ফ একটা ক্রিটিসিজম ম্যাটেরিয়াল হিসেবে আমরা প্রোডিউস করতে পারি। কিন্তু আরেক ধরনের ফিল্ম, যেটা অ্যানালিসিস করা সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য, সেটা হলো যে অ্যাজ অ্যা কালচারাল প্রোডাক্ট...কালচারাল পণ্য কিসের জন্য তৈরি হয়? ফর মার্কেট কনজামশন, ফর প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি। নানারকমের কালচারাল প্রোডাক্ট তৈরি হয়, এগজিস্টিং পাওয়ার রিলেশন টিকিয়ে রাখার জন্য যে ফিল্মগুলো তৈরি হয়, সেই ফিল্মের ক্রিটিক করাটা দরকার। এখানে আমি দুই রকমের ফিল্মের কথা বলছিলাম—একধরনের ফিল্ম দিয়ে আমি ক্রিটিক করতে পারছি; আর কিছু ফিল্ম আমাদের জন্য ক্রিটিক করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তার মানে, পরিচালক যা বলতেছে, সেই বলাটাকে ভিন্ন একটা বলা দিয়ে খারিজ করা, চ্যালেঞ্জ করা, কাউন্টার আর্গুমেন্ট তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়ে।
একটা ফিল্ম একটা আর্গুমেন্ট দেয় তো, একটা ইন্টারপ্রিটেশন দেয়, একটা ব্যাখ্যা দেয়; সার্টেইন রিয়ালিটি কিংবা সোসাইটির কোনো কোনো রিয়ালিটির একটা ব্যাখ্যা দেয়। তো সেই ব্যাখ্যাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে আরো সম্ভাবনাময় করে তুলতে হয়। ফিল্ম কী করে, যেহেতু একটু আগে বললাম, এটা হচ্ছে ডিরেক্টর ডমিনেটেড একটা শিল্প; তো ডিরেক্টরের একটা গেইজ থাকে, একটা দেখার চোখ থাকে, সে কী করে, সেই চোখ দিয়ে ভিউয়ারের একটা চোখ নির্মাণ করে। ডিরেক্টর চায়, লোকজন এই ফিল্মটা এই ভাবে দেখবে। এখন ফিল্ম ক্রিটিসিজমের একটা কাজ হতে পারে, যে দেখার চোখটা ডিরেক্টর নির্মাণ করে দিচ্ছেন, যা দেখতে বলতেছেন, সেই জায়গা থেকে ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে, ভিউয়ারের ভিন্ন জায়গাটা তৈরি করা।
একজন ভিউয়ার কী দেখবে সেটা ডিটারমাইন করতে চায় ডিরেক্টর; সেই ডিটারমিনেশন’টাকে আনডিটারমাইন করে দেওয়া, সেট্লমেন্ট’টাকে আনসেট্ল করে দেওয়ার কাজটা করতে হবে একজন ক্রিটিককে। মানে সেটা অনেকটা কন্সট্রাকশনের পরে যে ডিকন্সট্রাকশন, সেই ডিকন্সট্রাকশনের কাজটা করা। এখন ডিকন্সট্রাকশন কথাটার মানে কী? তোমরা বলো তো ডিকন্সট্রাকশনের কথাটা আমরা কার থেকে শিখেছি? (দর্শকদের উদ্দেশে) দেরিদা’র নাম শুনেছো তো তোমরা, জ্যাক দেরিদা? ডিকন্সট্রাকশন তার কথা। ডিকন্সট্রাকশন কী জিনিস? ডিকন্সট্রাকশন মানে ডেস্ট্রয় করা না। ডিকন্সট্রাকশন হলো, একটা বিষয়কে তার আর্কিওলজিকাল এবং জেনিওলজিকাল অ্যানালিসিস দিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যার সম্ভাবনা তৈরি করা—এটাই মূলত একজন ফিল্ম ক্রিটিকের কাজ। যেমন ঋতুপর্ণ সর্বশেষ ফিল্মটাতে যেটা করলো, ফিল্মের নামটা হলো...(দর্শকরা বললো) চিত্রাঙ্গদা। ‘চিত্রাঙ্গদা’তে রবী ঠাকুর যা বলেছেন...তোমরা দেখেছো কি সবাই ছবিটা? (শ্রোতাদের উদ্দেশে, হ্যাঁ—শ্রোতাদের উত্তর) সবাই দেখেছো? ভালো তো! রবী ঠাকুর যা বলেছেন, সেই বলাটার মধ্যে একটা পসিবিলিটি ছিলো—উনি যেটা ব্যাখ্যা করেন নাই, বলেন নাই—‘চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষের মতোই পালন করা হয়।’ এই যে ‘পুরুষের মতোই’...মণিপুর রাজা কী করলো—যখন তার কেউ নাই, সন্তান নাই; একটাই সন্তান হলো এবং সে সন্তানও হলো নারী, এবং সেই সন্তান হচ্ছে ওই রাজ্যের পরবর্তী রাজা। এখন তাকে রাজা বানাতে হলে কী করতে হবে, ‘পুরুষের মতোই’ তাকে লালন-পালন করতে হবে এবং মণিপুর রাজও তাই করলেন। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা যেহেতু নারী, সেহেতু তিনি অর্জুনের সান্নিধ্যের জন্য তার নারী-ভাবটা জাগ্রত করলেন। এইটাকে একেবারে ভিন্ন রকম একটা জায়গা থেকে কী করলেন ঋতুপর্ণ—‘নারীর মতোই পালন করলেন’, কিন্তু আসলেই সে নারী; যে চিত্রাঙ্গদা এখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানে আমরা একটা ক্যারেক্টারকে পাচ্ছি, এইটা মেইন ক্যারেক্টার—রুদ্র—সেই ক্যারেক্টারটা হচ্ছে একজন পুরুষরূপী নারী। তো যাই হোক, এই যে হোমোসেক্সুয়ালিটির ডাইমেনশন সোসাইটিতে, সেই ডাইমেনশন নিয়ে সমাজে কোনো কথা হয় না এবং এটার যে এ রকম একটা ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড় করানো যাবে—সেটা উনি করলেন। এটাকে ডিকন্সট্রাকশন বলা যেতে পারে। চিত্রাঙ্গদাকে ডিকন্সট্রাকশন করে একটি ভিন্ন ডাইমেনশনকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসলেন যে ডাইমেনশনটা রবী ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’য় একেবারে গোপন। তো এই রকমই হলো একজন ক্রিটিকের কাজ; মূলত ক্রিটিকের কাজ আমার মনে হয় এ রকম যে, ফিল্ম যখন এ রকম শক্তিশালী মাধ্যম যখন, ফিল্ম যখন অনেক কথা বলে, এবং একটা ফিল্মের যখন অ্যানালিসিস করতে যাচ্ছি তখন দেখতে হবে, ফিল্ম যে কথাগুলো বলছে সেই কথাগুলো কোনো না কোনো একটা ডিসকোর্সের অংশ। তোমরা ডিসকোর্স সম্পর্কে মনে হয় সবাই জানো। একটা ফিল্ম বা যেকোনো ফিল্ম কোনো না কোনো ডিসকোর্সের প্রোডাকশন এবং সেটা একধরনের সত্যকে জাস্টিফাই করে, নির্মাণ করে এবং প্রতিষ্ঠিত করে। এখন সেই সত্যটা আমাদের জন্য কতোটুকু সত্য? এখানে আমাদের জন্য বলতে আমি...এই ‘আমাদের জন্য’ বিষয়টা একটু পরিষ্কার করা দরকার। ক্রিটিকদেরকে আমরা অ্যানালিটিকাল রাইটার বলছি, আবার অনেক লেখক আছে যাদেরকে আমরা ক্রিয়েটিভ রাইটার বলি, যেমন ধরো আমাদের হাসান আজিজুল হক। ‘প্রথম আলো’তে যেমন দুইটা ক্যাটাগরি আছে; সৃজনশীল শাখায় তারা পুরস্কার দেয় তোমরা দেখেছো। ১০টা সৃজনশীল বই এ বছরে বই মেলায় এসেছে এবং ১০টা মননশীল বই, তাই না? তো এটা হলো ক্রিয়েটিভ এবং অ্যানালিটিকের দুটি ক্যাটাগরি। এই রকম ক্যাটাগরি দিয়ে বিচার করা, ভাবা—আমাদের একটা স্বভাব। ক্রিয়েটিভ এবং অ্যানালিটিকের যে ডিফারেন্স, যে ডিসটেন্স আমরা তৈরি করি তাতে ক্রিয়েটিভটাকে আমরা উঁচু জায়গায় রাখি। শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে পোলিশড, সবচেয়ে সফিস্টিকেটেড, সবচেয়ে গভীরতম, নিবিড়তম শিল্প কোনটা? এটা ধরো যে আজ থেকে ১০০ বছর আগে হলে সহজে উত্তর দেয়া যেতো, আজ থেকে ৫০ বছর আগে হলেও সহজে বলা যেতো। কোনটা, তোমরা জানো কি? মানে এই ক্যাটাগরিতে কোনটা সবার উপরের শিল্প? (দর্শকরা বললো, কবিতা) কবিতা, আধুনিক কবিতা এবং এরপরে ধীরে ধীরে অন্যান্য শিল্প। এই যে হায়ারাইর্কাইজেশন, আমি এই হায়ারাইর্কাইজেশনের পক্ষে না; ইভেন এই যে ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড অ্যানালিটিক, মননশীল এবং সৃজনশীল এই ক্যাটাগরাইজেশনের পক্ষেও আমি না। এর পক্ষে-বিপক্ষে আর্গুমেন্ট আছে প্রচুর। আমি এর পক্ষে না সিম্পলি এই কারণে যে, যেকোনো কাজই আমরা করি না কেনো, যা কিছুই আমরা করি না কেনো—যদি পোস্ট-মডার্ন ধারণা থেকে বলি, সবই রিপ্রোডাকশন, সবই ইন্টারটেক্সুয়াল। আমি নতুন কোনো কিছুই তৈরি করছি না। আমি হচ্ছি একটা অ্যাকুমুলেশন—সোসাইটি, কালচার, হিস্ট্রির অসংখ্য টেক্সটের অ্যাকুমুলেশন। আমার মধ্যে যে ভাব আসছে সে ভাবটা আসলে অ্যাকুমুলেশন। অনেক ধরনের সম্ভাবনা থেকে আমি হয়তো কবিতা লিখতে শুরু করেছি, ফিল্ম বানাতে শুরু করেছি কিংবা অ্যানালিসিস করতে শুরু করেছি—তো এই ক্রিয়েটিভ আর অ্যানালিটিকের ডিফারেন্সটা আমরা মানি না, আমি মানি না।
এখান থেকে আরেকটা জায়গা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম: ক্রিয়েটিভের যে অ্যানালিসিস করে ক্রিটিকরা, সেই ক্রিটিকদের একধরনের ভ্যালু থাকে। ক্রিটিক যেটা করে, ফিল্মে কী ভ্যালু প্রোডিউসড হয়েছে, অ্যাজ অ্যা ফিল্ম ক্রিটিক বা অ্যানি কাইন্ড অব ক্রিটিক, যে কালচারাল প্রোডাকশনের ক্রিটিক করছে সে ওই কালচারাল প্রোডাকশনের হিডেন মিনিং উদ্ধার করতে আর্গুমেন্ট দিয়ে একটা সমালোচনা দাঁড় করায়। কিন্তু, সে যে সমালোচনা দাঁড় করায়, তা কিসের ভিত্তিতে? আমি যে সমালোচক; ধরো, আমি সমালোচনা করছি, আমারও তো একটা পজিশন আছে। যিনি এই প্রোডাকশনটা তৈরি করেছেন, তারও তো একটা পজিশন আছে। ধরো আমি বলছি যে, সে ভীষণভাবে নারী বিদ্বেষী একটা ফিল্ম বানিয়েছে। আমি তাহলে কোন্ পজিশন থেকে বলতেছি, নারীবাদী একটা পজিশন থেকে। তাহলে সমালোচক ও সমালোচনার একটা পজিশন আছে, যেমন তার সমালোচনার যে বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তুরও একটা পজিশন আছে। এখন এই দুইটা পজিশনই তাহলে নিউট্রাল না—নাথিং ইজ নিউট্রাল। সেই সেন্সে, তাহলে, কীভাবে আমি সমালোচনা করছি? আই অ্যাম মেকিঙ অ্যা পলিটিকাল মুভ। যে সমালোচনাটা আমি হাজির করতে যাচ্ছি, সেইটা একটা পরিষ্কার পলিটিকাল মুভ। সমালোচকরা যেটা করে সেটা কোনো নিরপেক্ষ জায়গা থেকে করে না; তারও একটা পক্ষ থাকে। সমাজের পলিটিকাল ও পাওয়ার রিলেশনের যে কনফিগারেশন বা বিন্যাস, সেই বিন্যাসের জায়গা থেকে আমাদেরকে পুরো বিষয়টাকে দেখতে হবে।
আমরা মনে করি, যুদ্ধক্ষেত্র—ব্যাটল ফিল্ড, ব্যাটল গ্রাউন্ড যে শব্দগুলো আছে কিংবা যুদ্ধের ময়দান যাই বলি না কেনো কিংবা অমুক অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে, একটা অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। এখন ধরো, মিশেল ফুকো বলবেন, আধুনিক সমাজ হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানের মতো করে সাজানো, মানে রণক্ষেত্রের মতো করে সাজানো। আমরা যেভাবে রণনীতি বা রণক্ষেত্র তৈরি করি, তেমনি সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো, মানুষের বিন্যাসগুলো সবকিছুই রণক্ষেত্র বা রণনীতির মতো করে সাজানো; রণক্ষেত্রের বিভিন্ন রকমের সংমিশ্রণ। তাহলে রণক্ষেত্র বলে আমরা সমাজের বাইরে যে ফিল্ডকে আলাদাভাবে চিন্তা বা চিহ্নিত করি সেটাই শুধু রণক্ষেত্র না; সমাজ ইটসেল্ফ রণক্ষেত্রের মতো করে সজ্জিত। ফুকোর আরেকটা ইন্টারেস্টিং বক্তব্য ছিলো, যেটা খুব ইম্পোর্টেন্ট এক্ষেত্রে; সে বলছে—আমাদের সমাজ একটা ডিসিপ্লিনারি সোসাইটিতে পরিণত হয়েছে। ডিসিপ্লিনারি সোসাইটিটা কেমন? অনুশাসনবদ্ধ একটা সমাজ, নানান রকম অনুশাসনের মধ্য দিয়ে সে সাবজেক্ট, মডার্ন সাবজেক্ট, তৈরি করছে। একজন নারী জানে তার কী কী রোল সমাজে থাকবে; পুরুষ জানে তার কর্মজীবী হওয়া দরকার, কীভাবে স্বাস্থ্য সেবা করতে হয়; কীভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়—সবকিছুর নিয়ম-নীতি আছে।
ডিসিপ্লিনারি সোসাইটির বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে সবাই নজরদারির মধ্যে থাকবে। কেউ না কেউ আমাকে নজরদারি করছে। কেমন? ধরো এখানে আমি বা তুমি ‘অসামাজিক’ কার্যকলাপ করছি। অবশ্য কোনটা সামাজিক কোনটা অসামাজিক তা নির্ধারণ করার জন্য কিছু লোকজনও সবসময় নিয়োগ করা আছে। ধরো এখানে বসে আমি তাস খেলছি, জুয়া খেলছি কিংবা ড্রাগ নিচ্ছি। এখন ড্রাগের ডেফিনিশনটা কিন্তু এদেরই নির্ধারিত। এরা বলবে অসামাজিক কাজ হচ্ছে, এখন কী করবে, শাস্তি দিবে। আরও সফিস্টিকেটেড ডিসিপ্লিনারি রেইজিম কী রকম? ধরো তোমার বাসায়, তোমার বাচ্চা তিন-চার দিন জোরে জোরে কেঁদে উঠলো, তখন আমেরিকান পুলিশ তোমার বাড়িতে এসে বলবে যে তোমরা বাচ্চা পালন করার উপযুক্ত না; তোমাদের বাচ্চাকে দিয়ে দাও আমরা পালন করছি। কিংবা তোমাদের একটা পানিশমেন্ট দিবে, ওয়ার্নিং দিবে। তার মানে বাচ্চা পালন করার ক্ষেত্রেও কিছু ডিসিপ্লিন আছে, নজরদারি আছে। ধরো তুমি যদি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াও, এইবার তোমাকে বলা হবে—তুমি ভবঘুরে, তোমাকে তাহলে আশ্রয়কেন্দ্র বা ভবঘুরে কেন্দ্রে নিতে হবে, যেটা গাজীপুরে আছে। তুমি রাস্তায় রাস্তায় স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারবা না। স্বাধীনতার সীমাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আরো এক্সট্রিমে যদি যায়, তোমাকে পাগল ভাবা হবে এবং পাগলাগারদে রাখা হবে। ডিসিপ্লিনারি সোসাইটির এই হলো নিয়ম। তোমাকে বলছে যে তুমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে পারবা না; তুমি কাজ করবে এবং দিনে-রাতে এই সময় পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারবে—এই রকম সব; এর বাইরে যা যা করবা তা ইনডিসিপ্লিনারি। ডিসিপ্লিনারি সোসাইটির এই ধারণা ফুকো তৈরি করতেছেন জেলখানা থেকে। জেলখানাকে ডিসিপ্লিনারি সোসাইটির মডেল হিসেবে দেখতেছে সে। জেলখানায় ভিতরে অনেক খুপরি থাকে এবং নজরদারি করার একটা বিশেষ টাওয়ার থাকে, সেখান থেকে সব দেখা যায়—কোন্ কয়েদী কোথায়, কীভাবে আছে, কী করছে সবই দেখা যায়। সেই টাওয়ারে কেউ বসে থেকে নজরদারি করে—এটা কয়েদি জানে, তাই সে পালাইতে পারে না।
এখন, অনেক সময় দেখা যায়, টাওয়ারে কেউই নেই। কিন্তু কয়েদিরা তো দেখতে পারছে না টাওয়ারে কেউ আছে কি নাই! তাই সে ভাবে—কেউ না কেউ তাকে নিশ্চয় পাহারা দিচ্ছে। সেহেতু সে পালায় না—তো, ডিসিপ্লিনটা হচ্ছে এ রকম। ফুকো বলছে, জেলখানার ওই যে মডেল তা আমাদের স্কুল, আমাদের চাকরিক্ষেত্র, আমাদের পরিবার, হাসপাতাল সব জায়গায় বিস্তৃত। সোসাইটির সব প্রতিষ্ঠানে এটি বিস্তৃত হয়েছে, এই বিস্তৃত হওয়ার মানে কী? জেলখানা কেনো, কিসের জন্য করা হয়েছিলো? কিছুদিন তোমার স্বাধীনতা, স্বাধীন জীবন-যাপনে বাধা দেওয়ার জন্য, তোমাকে সংশোধন করার জন্য। তোমাকে কিছু কোয়ালিটি শেখানো হবে জেলখানায়; সেখান থেকে তুমি ফিরে এসে নতুন করে সমাজের প্রোডাক্টিভ এক লেবার হয়ে উঠবে। এখন কী হচ্ছে তাহলে, যখন পুরো সমাজই এটা হয়ে গেলো, তার মানে তোমার স্বাধীন জীবন-যাপন পুরোপুরিই বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। আমি যদি কাজ না করি, আমি যদি আজকেই চাকরিটা ছেড়ে দিই, কালকে আমাকে না খেয়ে মরতে হবে। কারণ, আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা চাইতে পারবো না; ভিক্ষা চাইলেই আমাকে ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই হলো পরিস্থিতি, স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে ডিসিপ্লিন বাধামূলক।
এখানে আমি ফুকো থেকে দুইটা পয়েন্ট নিয়ে আসলাম; একটা হলো যে, সোসাইটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো সাজানো, যুদ্ধক্ষেত্রে যা যা ঘটে : রণনীতি-বোমাবর্ষণ-খুন-জখম, সোসাইটিতেও প্রতিনিয়ত এগুলো ঘটে। খুন হওয়া কিন্তু সিম্পল কিলিং না; খুন হওয়ার আগে অনেক সময় আমরা কিল হয়ে যাই। আমরা যে ধরনের সাবজেক্ট হয়ে পড়ছি, সেটাও একরকম জখম। এই ধরো, আমরা প্রতিনিয়ত একটা রুটিন লাইফ লিড করতেছি; সকালে উঠে অফিসে যাচ্ছি, রাত নয়টায় অফিস থেকে তিন-চারটা কাজ নিয়ে ফিরতেছি এবং তারপরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে ঘুমিয়ে পড়তেছি এবং সকাল হলে আবার অফিসে যাচ্ছি। তারপর সপ্তাহে দুদিন ছুটি পাচ্ছি এবং সে ছুটিতে কী করতে হবে তার নিয়ম-কানুন ও ছক বাঁধা আছে। এই যদি লাইফ হয়, বিউটিফুল লাইফ হয়, সেই বিউটিফুল লাইফে ক্রিয়েটিভিটির, ইমাজিনেশনের, ফ্রিডমের কোনোই স্পেস নাই।
এই সোসাইটি তাহলে কী করছে? সোসাইটির এই যে রিলেশনগুলো, সোসাইটি যেগুলোকে উন্নয়ন বলতেছে, যেগুলোকে অগ্রগতি বলতেছে, যেগুলোকে সুখ বলতেছে—আসলে সেগুলো আমাদের কাছে একধরনের মৃত্যুর বিকিকিনি করতেছে। তো, এই মৃত্যুর বিকিকিনি করার সোসাইটিতে তাহলে আমরা বসবাস করি; যেখানে ডিসিপ্লিন আমাদেরকে নিয়মিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি আমরা দেখি, এই সোসাইটিরই একটা প্রোডাকশন হলো ফিল্ম। তাহলে ফিল্ম কী করে? ফিল্ম তাহলে ওই বোমার মতো কাজ করতে পারে, ফিল্ম তাহলে আমাদেরকে কিছু ডিসিপ্লিন শেখাতে পারে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ফিল্ম কী ডিসিপ্লিন শেখায়, কেনো সে এভাবে তৈরি হয়, কেনো তার মধ্যে ভালগারিটি থাকে, কেনো সে হিস্ট্রির নতুনভাবে ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড় করায়? কেনো সে, ধরো, প্রতিটা ফিল্মে শেষ পর্যন্ত নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটায়, তাই না? কিংবা ধরো যে, প্রতিনিয়ত ফিল্মে আইনের প্রতি সম্মান জানানো হয়—এ রকম অনেক কিছু আছে, যেটা ফিল্মে প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই—নিয়মিত এগুলো তোমাকে কন্সট্রাক্ট করছে। তো, ফিল্ম এগুলো কেনো করে?
ফিল্ম ডিসিপ্লিনারি রেইজিম-এর একটা কম্পোনেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে। আমি একটা আর্গুমেন্টের জায়গায় যাচ্ছি যে, ডিসিপ্লিনারি যে রেইজিম আমাদেরকে অনুশাসনবদ্ধ করে, সেই রেইজিমের একটা কম্পোনেন্ট হয়ে উঠতে পারে ফিল্ম। জেলখানায় আমাদের ওপর সারভেইল্যান্স করে জেলপুলিশ, তাই না। তেমনই ফিল্ম একটা জেলপুলিশ হয়ে উঠতে পারে। প্রতিদিন তুমি যে দৈনিক পত্রিকা পড়ো সেটা তোমার জন্য একটা জেলপুলিশ হয়ে উঠতে পারে। কারণ তোমাকে সে বলে দেয়, কী কী বিষয় আজ ভাবতে হবে। কিংবা কীভাবে তুমি সাজবে, কী কী রান্না করবে, তোমার বাচ্চাকে কীভাবে পালন করতে হবে, তাকে কীভাবে কথা বলতে শেখাতে হবে—এসবই হলো পুলিশি বা নজরদারি। এই নজরদারি দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন করে থাকে। এ রকম পত্রিকা থেকে শুরু করে সব রকম কালচারাল প্রোডাকশন, তারা যে ভ্যালু সিস্টেমকে আপহোল্ড করে কিংবা প্রোডিউস করে, রিপ্রোডিউস করে তা আমাদেরকে অনুশাসনবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে আরো বেশি দীক্ষিত করে। একজন ক্রিটিকের কাজ তাহলে কী হয়? এই অনুশাসনের ক্রিটিক করা। তাই ফিল্ম ক্রিটিসিজমকে আমি মনে করি না কোনো আলাদা বা ডিফারেন্ট এরিয়া অব ক্রিটিসিজম।
হ্যাঁ, অবশ্যই, যেমন কবিতার একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আমি যখন উপন্যাস দেখি তার ল্যাঙ্গুয়েজের, তার প্লটের, তার স্ট্রাকচারের ব্যাপার আছে, তার মাধ্যমের ব্যাপার আছে, কী দিয়ে তৈরি হচ্ছে, উপাদান কী ইত্যাদি। ফিল্মের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্যের এই সব বৈশিষ্ট্য আছে। তার পরেও যেটা বলতে চাই, যখন কোনো কালচারাল প্রোডাক্টের ক্রিটিক করতে যাই, তখন আমার মনে হয়েছে, ক্রিটিসিজম ইটসেল্ফ শুধু ফিল্ম দেখে বা ফিল্ম সম্পর্কে পড়ে আমি ফিল্ম ক্রিটিক হয়ে উঠবো, এটা কখনোই সম্ভব নয়। কিংবা ধরো, চিকিৎসাবিদ্যায় কীভাবে চিকিৎসা করতে হয় আমি শিখলাম, সারাজীবন এটাই শিখলাম, তাহলে আমি একজন রোগীকে ভালো ট্রিটমেন্ট করতে পারবো—এটা আমার মনে হয় না। কারণ, একধরনের টোটালিটি থাকে, মানে একটা সোসাইটিতে ওই ডাক্তারিবিদ্যার চর্চা কীভাবে হয়, মানুষের সঙ্গে এর রিলেশন কী; মানুষের সঙ্গে কীভাবে গুড রিলেশন মেইনটেইন করতে হয়—সেই সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে একজন মানুষ ভালো ডাক্তার নাকি খারাপ ডাক্তার হবে; সে ছুরিটা ভালোমতো ধরতে পারবে নাকি ধরতে পারবে না। শুধু ছুরি চালানো শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ছুরি যার ওপর চালানো হচ্ছে, যেভাবে চালাচ্ছে এবং কোন্ মানুষের বুকে চালাচ্ছে সবটাই গুরুত্বপূর্ণ।
সেই অর্থে ফিল্ম ক্রিটিক’কে আমি আলাদা ধরনের ক্রিটিক, মনে করি না। ফিল্ম পড়ে ভালো ক্রিটিক হওয়া যাবে কিংবা কয়েকটা বই পড়ে, সো কল্ড মিডিয়া স্টাডিজ পড়ে, খুব ভালো মিডিয়া অ্যানালিস্ট হয়ে উঠবে—এটা আমার মনে হয় না। কারণ মিডিয়া একটা সোসাইটিতে তৈরি হয়, প্রোডিউসড হয়। সেহেতু ওই সোসাইটির অন্যান্য অসংখ্য ডাইমেনশন আছে, তার সায়েন্স আছে, তার হিউজ লিটারেচার আছে, তার অন্যান্য ফর্মের শিল্পকলা আছে, লিভিং লাইফ আছে। সেই লিভিং যে লাইফ; প্রতিনিয়ত আমরা যে জীবন যাপন করছি, প্রতিনিয়ত এখানে যে চেইঞ্জগুলো ঘটছে, যেমন—ইকোনমিক, সোশ্যাল, কালচারাল বা পলিটিকাল যে চেইঞ্জগুলো ঘটছে; যে ফর্মগুলো প্রতিনিয়ত আমাদেরকে হন্ট করে কিংবা আমাদেরকে মুক্তি দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষতি করে—সেই সবকিছু তোমার জানা দরকার, যদি আমি যেকোনো কিছুরই ভালো ক্রিটিক হতে চাই। সেহেতু, ফিল্ম ক্রিটিকের জন্য ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজের লিমিটটুকু বাদ দিলে তা লিটারারি অন্যান্য ক্রিটিকেরই মতো।
মামুন (মামুন হায়দার) আমাকে সেদিন একটা মজার কথা বলেছে, আমি নাকি খুব ভালো ক্রিটিক। সে বলেছে, ‘স্যার, আপনার ওপরে আর কারো লেখা দেখছি না। বাংলাদেশে এখন যারা ক্রিটিসিজম করতেছে এদের মধ্যে আপনার ওপর কারো লেখা দেখতেছি না।’ হয়তো ও সবার লেখা দেখেনি, আবার অনেকে বিদেশি ভাষায় চর্চা করছে। বাংলাদেশের বাইরেও বাংলাদেশ নিয়ে অনেক চর্চা হয়, তারা হয়তো আমার চেয়ে অনেক ভালো লেখে। আর আমি ফিল্মের লোকও নই সেই অর্থে। তো যাই হোক, এ কথার মধ্যে একধরনের প্রশংসা আছে। ও আমাকে খুব ভালোবাসে, সেটা একটা ব্যাপার বটে। কিন্তু ওর কথা হয়তো খানিকটা সত্যও বটে। এক অর্থে, যারা ফিল্ম নিয়ে অ্যানালিসিস করছে বাংলাদেশে, তারা প্রস্তুতির জায়গা থেকে অনেকেই পিছিয়ে আছে। তারা হয়তো অনেক ফিল্ম দেখে, তারা হয়তো পুঁজিবাদ নিয়ে, মার্কস নিয়ে প্রচুর পড়ালেখা বা মার্কসিস লিটারেচার নিয়ে খুব ভালো পড়ালেখা করেছে; কারো হয়তো সাহিত্য ভালো পড়া আছে; কিন্তু যেটা দরকার, সেটা হলো টোটালিটি।
আমি যেটা বলছিলাম, যেকোনো ডাইমেনশন নিয়ে আমি যখন অ্যানালিসিস করি সেটার জন্য আমার যেমন দরকার স্যোসিওলজিকাল নলেজ, তেমনই লিটারেচার, ফিলোসফি, হিস্ট্রি। সেই ফিলোসফিক, স্যোসিওলজিকাল, লিটারেচার বিভিন্ন উপাদান যদি সংযুক্ত না হয়, তাহলে পসিবিলিটি এবং প্রবলেমের জায়গাগুলো সব ধরা যাবে না। যে মাল্টিপল ডাইমেনশন থাকে একটা জিনিসের, উপাদানের, যেকোনো কালচারাল প্রোডাক্টের, তেমনি ফিল্মেরও মাল্টিপল ডাইমেনশন থাকে, তাকে মাল্টিপল পজিশন থেকেই দেখতে হবে। আমাদের মিডিয়া স্টাডিজের মেজর লিমিটেশন হলো এর ডিসিপ্লিনারি বাউন্ডারি।
ডিসিপ্লিন কী? আবার ডিসিপ্লিনের কথা আসলো। ডিসিপ্লিন আর পানিশ-এর যেমন কথা হচ্ছিলো, শাস্তির রকম-বিধি যেমন বদলে গেছে, জেলখানায় নিয়ে গিয়ে আর শাস্তি দেওয়া হয় না। এখন আমাদের যেভাবে শাস্তি দেওয়া হয় সেটাকে আমরা শাস্তিই মনে করি না। আমরা প্রতিনিয়ত ফেইসবুকে বসে হাজার হাজার কথা বলতে থাকি, প্রতিনিয়ত দিনে দশবার স্ট্যাটাস দিতে থাকি। এই যে অমুক ছবি আপলোড করেছে, এটা সেটা অনেক কথা বলতে থাকি। কিন্তু এটাও যে আমাদের নজদারিরই একটা টুল হয়ে ওঠে, সেটা আমরা অনেকে বুঝি না। যেমন ধরো, ফুকো নজরদারির ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার যে উদাহরণ দিয়েছিলো সেটা হলো—স্টেডিয়াম। তুমি যখন ফুটবল খেলা দেখতে যাচ্ছো, স্টেডিয়ামের চারপাশে গ্যালারি আছে। এখন, এই গ্যালারি যখন ছিলো না, তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছো। এখানে সামনে যারা আছে ভালো দেখতে পারছে, পিছনে যারা তারা কিছুই দেখতে পারছে না—পা উঁচু করে, রিকশার উপর দাঁড়িয়ে, ছাদে দাঁড়িয়ে কেউ খেলা দেখে। এখন গ্যালারি থাকার সুবিধা কী হলো? সবার আই লেভেল থেকে খুব ভালো করে দেখতে পারছে বলটা কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু যে গ্যালারি তোমার এতো উপকার করে দিলো, তোমাকে দেখার এতো সুবিধা করে দিলো, সেই গ্যালারির আরেকটা সুবিধা আছে। আগে যেমন অনেক মানুষ মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, তাদের ওপর নজরদারি করতে পুলিশের খুবই অসুবিধা হতো। এখন গ্যালারিতে বেশি পুলিশ লাগে না। এখন গ্যালারি এক একটা অংশে একজন করে পুলিশ দিলেই সে সব দেখতে পায়, কারা কী করছে। তাহলে নজরদারি সিস্টেমের বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে?
ফেইসবুক তোমাকে হড়হড় করে, অহরহ যা খুশি তাই বলার সুযোগ করে দিয়েছে; এবং দেখার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু, ফেইসবুক আরেকটা কী করছে দেখো, তোমাকেও দেখার সুযোগ করে দিয়েছে, যারা তোমাকে দেখতে চায়। এখন তোমার ঘরে বিজ্ঞাপন এসে হাজির হবে, তোমার ঘরে পুলিশ এসে হাজির হবে। যেমন ধরো, যে চারজন নাস্তিক ব্লগারকে, সো কল্ড নাস্তিক ব্লগারকে ধরে নিয়ে গেলো; তারা ব্লগে কী কী সব লিখেছিলো। আমাদের আইনে আছে, যদি পাবলিক কনজামশনের জন্য আমি কিছু লিখি, যেটা ম্যাসমিডিয়াতে প্রকাশিত হয়, এবং সেটা যদি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় তাহলে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া যায়। অথচ ব্লগ ওরকম কোনো স্পেস না, ওটা অনেকটা পার্সোনাল স্পেস। কারণ সেখানে আমার আইডি-পাসওয়ার্ড আছে, যা আমার দু-চারজন বন্ধু ছাড়া কেউ দেখে না। কিন্তু দেখো, আমার পার্সোনাল স্পেসে পুলিশ ঢুকে পড়ছে, রাষ্ট্র ঢুকে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে? আমি তাদের বলছি, ভাই এসে আমার বৈঠকখানায় একটু বসো, কিন্তু তারা এসে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়ছে; তো, এটা হলো পরিস্থিতি।
টেলিভিশন কোথায় দেখতে সবচে আরাম লাগে; এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতে, তাই না! কিন্তু টেলিভিশনের কাজ কী? সে কালচারালি আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো, আমায় এতো আরাম দিলো, আমি কতো কিছু দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মনে রাখতে হবে টেলিভিশনও আমাকে দেখছে। আমি সেটাকে দেখি, যা দেখি, সেও কিন্তু আমাকে দেখে। যদিও আমি মনে করি সে আমাকে দেখছে না; কিন্তু সে দেখছে, সে আমাকে কন্সট্রাক্ট করছে। রিয়াল-আনরিয়ালের বা বাস্তবতা-অবাস্তবতার পার্থক্য আছে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু সুজান বাক-মস এর একটা লেখা আছে (ভিজ্যুয়াল স্টাডিজ অ্যান্ড গ্লোবাল ইমাজিনেশন) আমি সেটা পড়াতে চেয়েছিলাম একসময়, পড়ানো হয়নি। তো, সুজান বাক-মস ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে লিখছিলো, ইমেজ কীভাবে ট্রাভেল করতেছে আজকাল এবং কীভাবে প্রোডিউসড হচ্ছে, এক দেশের ইমেজ অন্য দেশে যাচ্ছে এবং কন্সট্রাক্ট করছে সেখানকার মানুষগুলোকে। সেগুলো নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে সে বলছিলো, ইমেজের মধ্যে রিয়ালিটির একটা ট্রেস সবসময় থেকে যায়। যেকোনো ইমেজের মধ্যে সেই সময় ও ঘটনার একটা ট্রেস/অস্তিত্ব থেকে যায়; ইমেজ কোনো ডেড থিং না, ইমেজ হচ্ছে একটা লিভিং থিং। ইমেজ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমাকে কন্সট্রাক্ট করে। আমি যেমন ইমেজকে কন্সট্রাক্ট করি, ইন্টারপ্রেট করি, সেই ইমেজও আমাকে ইন্টারপ্রেট করে, কন্সট্রাক্ট করে। এখানে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের আরেকটা কথা খুব ইম্পোর্টেন্ট, ইমেজ সম্পর্কে, ভিজ্যুয়াল ইমেজ সম্পর্কে। ভিজ্যুয়াল ইমেজ আমার ওপর কীভাবে কাজ করে, আমি কী মনে করি? সমাজে গণমাধ্যমের প্রভাব কিংবা ইন্টারনেটের প্রভাব, ওমুক-তমুক প্রভাব নিয়ে তোমরা নানা অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলো। এখানে প্রচুর আছে এ রকম অভিসন্দর্ভ, প্রচুর থিসিস আছে, প্রতিদিনই আমাদের ক্লাসে স্যাররা পড়ায়, আমরা পড়ি। কিন্তু শুধু বেঞ্জামিন নয়, বেঞ্জামিনের পরেও আলথুসারসহ অনেকে বলছিলো, বেঞ্জামিন বলছিলো, যদি আমরা মনে করি ইমেজ সমাজকে এইভাবে এটা-এটা প্রভাবিত করতেছে, সেইটা আসলে ভুল অ্যানালিসিস। বেঞ্জামিন বলতেছে, ইমেজকে বুঝতে হবে আমাদের আনকন্সাস ক্যাটাগরি দিয়ে। যদি আমাদের জীবনে ইমেজের প্রভাব কিংবা আমাদের সঙ্গে ইমেজের রিলেশন খুঁজতে যাই, তাহলে ইমেজের রিলেশনটা বুঝতে হবে আমাদের আনকন্সাস ক্যাটাগরি দিয়ে। এইটা ইভেন ধরো লাঁকা মানে জ্যাক লাঁকাও বলবে, কিংবা ইয়ুঙও বলবে।
তোমরা সাইকো অ্যানালিসিস পড়েছো বোধহয়। ধরো, আমাদের বা আমার কল্পনা, কিংবা আমাদের আনকন্সাসে কী থাকে, ইমেজ থাকে। আমাদের আনকন্সাস হলো ইমেজ দিয়ে গড়া। যে কারণে ইমেজ এতো ইম্পোর্টেন্ট। আমি যখন কল্পনায় অতীতে ফিরে যাই, আমি যখন ভাবি বা কাউকে আমি যখন ভাবি, নিজেকে যখন রি-ইন্টারপ্রিয়েট করতে যাই, তখন একটা ট্রাভেল করি—আমি দুই বছর আগে কী করেছিলাম, তার আগে কী করেছিলাম, তার আগে কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম—আর এই ট্রাভেল ঘটে ইমেজ মারফত। কার্ল ইয়ুঙ বলতেছিলো যে, যা দিয়ে আমি এবং আমার আনকন্সাস তৈরি তা হচ্ছে ইমেজারি, অসংখ্য ইমেজারি। বাড়ি, সমুদ্র, জন্তু-জানোয়ার, মানুষ, আমার যে পূর্বপুরুষ তাদের ইমেজারি। সেগুলোর কিন্তু কোনো নামধাম নাই, শুধুই ইমেজ, চেহারা। তো এই চেহারা, ইমেজ আমাদের আনকন্সাসকে তৈরি করেছে। সেহেতু এই মডার্ন সময়ে, আমরা যে সময়ে বাস করছি, যে সময় ফিল্ম ইজ ইম্পোর্টেন্ট। তার যে প্রভাব কিংবা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক কিংবা আমাদের কন্সট্রাকশনে ইমেজের যে রোল, সেটা বুঝতে হলে আনকন্সাস ক্যাটাগরির কথা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। এটা হলো, একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের ফিল্ম সমালোচনায়। যদিও আমার কোনো অ্যানালিসিসে আমি এতো দিকে যাইনি।
আমরা একটা জায়গা থেকে বলতেছিলাম, ফিল্ম একটা ডিসিপ্লিনারি প্র্যাকটিসের পার্ট। আমার কথা মনে হয় অসংলগ্ন মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে? তোমরা কথা বলছো না কেনো, সেটা আগে বলো। আমি কি তোমাদের সাথে কমিউনিকেট করতে পারছি, তাই বলো? আমি কি আদৌ তোমাদের কিছু বলছি বলে মনে হচ্ছে? আমি কিছু বলছি নাকি বলতেছি না?
মামুন হায়দার : স্যার, আমার যেটা মনে হয়, অনেকগুলো ব্যাপারে এখানে ওরিয়েন্টেশন আছে অনেকের। তাই আপনি যা বলছেন বা যে লাইনে কথা বলছেন, তা অনেকেই বুঝতে পারছে। সবার একেবারে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে না। এখানে ফোর্থ ইয়ার, মাস্টার্সের অনেক শিক্ষার্থী আছে। তারা অবশ্য অ্যাকাডেমিকালিই এর অনেক কিছু পড়ে। তার পরেও নিচের দিকে যারা বা অন্যান্যদের কিছুটা হলেও ধারণা আছে। তাই একেবারেই উপর দিয়ে যাচ্ছে না বলেই মনে হয়।
আ-আল মামুন : তাইতো, কেননা একেবারে উপর দিয়ে গেলে তো সমস্যা। কিন্তু এরা তো কেউ কথা বলছে না!
মামুন হায়দার : এরা তো কথা বলবেই, আপনি বলে নেন, এরা শুরু করবে তারপর। আপনার এমনিতেই বলার যে জায়গা, সেটা কতোখানি?
আ-আল মামুন : আমার কোনো জায়গা নাই। আমি জাস্ট বলে চলেছি। আসলে আমি কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই কথা বলছি। আর প্রস্তুতিহীন মানুষের পক্ষে বলা মানে অপ্রস্তুত হয়ে বলা। আর অপ্রস্তুত মানুষ অনেক সময় বেশি কথা বলে এবং অগোছালো কথা বলে, অসংলগ্ন কথা বলে। এইটা ধরো, সেরকম একটা বলা। আসলে ফিল্ম নিয়ে অসংখ্য কথা বলার আছে। আমি কোনো নির্দিষ্ট ফিল্ম নিয়ে কথা বলছি না এখানে। আচ্ছা বলি...
আমার লেখা কি তোমরা পড়েছো সবাই? (একজনকে উদ্দেশ্য করে আ-আল মামুন বলেন, ও মনে হয় সবগুলো লেখা পড়েছে)। আমি কয়েকটা লেখা লিখেছি। আমাদের বন্ধুরা যখন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, তার ফিল্ম নিয়ে মুগ্ধ; তখন আমি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা লেখা লিখলাম। তখন আরেকটা ছবি করলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তাহলে, ফারুকী ও হুমায়ূন কী বলতে চান ব্যাচেলর এবং চন্দ্রকথাতে। এই দুটা ফিল্ম অ্যানালিসিস করলাম। সে একটা ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত থেকে। সেসময় আমার বন্ধুরা একটা রিসার্স করছিলো, মানে একটা বই লিখেছিলো। তখন ওরা রাজশাহীতে আসে ডেটা কালেক্ট করতে, তোমরা (দর্শকদের উদ্দেশ্য) তখন ছিলে না এই ডিপার্টমেন্টে। তো তখন রাজশাহীতে চন্দ্রকথা চলছিলো উৎসব সিনেমা হলে। সবাই বললো, চলো ওটা দেখে আসি। সবাই মিলে চন্দ্রকথা দেখতে গেলাম এবং ফেরার পথে কথা হলো। পরের দিন ছাত্রদের সঙ্গে ওরা একটা ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করলো।
আমি বলেছিলাম, আমি আপনাদের এই আর্গুমেন্টের সঙ্গে একমত না, ‘প্রথম আলো’র এই পজিশনের সঙ্গে একমত না, আমি অশ্লীলতা প্রসঙ্গে এই আর্গুমেন্টের সঙ্গে একমত না। তখন আমি মাস দুয়েকের মধ্যে দুটো লেখা লিখলাম। প্রথমে চন্দ্রকথা তারপরে ব্যাচেলর নিয়ে লিখে একটা আর্গুমেন্ট দাঁড় করালাম। বলতে চাইলাম, এই ফিল্মগুলো কী বলতে চাচ্ছে। তখন ওরা আমাকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে গেলো একটা সেমিনারে লেখাটা প্রেজেন্ট করার জন্য। সেই সেমিনারে লোটে এসেছিলো, লোটে হুক। লোটে হুক তখন বাংলাদেশের ফিল্ম নিয়ে, ফিল্মে কাটপিসের ব্যবহার নিয়ে একটা রিসার্চ, পিএইচডি করছিলো। এখন সে এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। তখন লোটে যে আর্গুমেন্ট দিচ্ছিলো সিনেমায় কাটপিসের অর্থাৎ কাটপিস হুট করে যে ঢুকে পড়তেছে সিনেমার গল্পের মধ্যে, তা কী মিনিং তৈরি করতেছে, সেটা দিয়ে অশ্লীলতা বা যৌনতা কী, বোঝা যায় কি না—সেগুলো নিয়ে লোটের আর্গুমেন্ট। আমার আর্গুমেন্টের অনেক কাছাকাছি। ফলে দেখা গেলো, আমরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি এবং সবসময় ও খোঁজখবর রাখে। তো, ওর বইটা বের হয়েছে এখন। তোমাদের যে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর একটা ফেইসবুক পেইজ আছে দেখলাম, সেখানে আমি ওর বইয়ের একটা পোস্ট দিয়ে দিয়েছি, কাটপিসের ব্যবহার নিয়ে বইটা। তো চন্দ্রকথা, ব্যাচেলর-এর ক্রিটিসিজম নিয়ে কথা বলছিলাম, এটা অবশ্য একেবারেই শুরু ছিলো আমার ফিল্ম অ্যানালিসিসের।
তারপরে তো আমার আরেকটা মেজর কাজ ছিলো তোমাদের ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য। (কেউ একজন বলে লেখাটার শিরোনাম, ‘বেশরা ফকির...’) তো, মজার কথা হলো, আমি মাস্টার্সে রিসার্স প্রোপোজাল জমা দিয়েছিলাম থিসিস করবো বলে, ঠিক আছে। আমি প্রোপোজাল দিলাম, লালনকে নিয়ে কাজ করবো। দেখা গেলো—আমার ডিপার্টমেন্টে কোনো সুপারভাইজার নাই। তারপরে আমি যখন মাস্টার হলাম, তখন ভাবলাম, আচ্ছা আমি না হয় আমার পিএইচডিটা লালনকে নিয়েই করবো। তারপর থেকে যতো বইপত্র বের হয় লালনকে নিয়ে সেগুলো পড়ি, আখড়ায় যাই, গান শুনি, কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে এই লাইনে মানিকগঞ্জে, কুষ্টিয়াতে; যারা এই লাইনে কাজ করে, সাধন-ভজন করে। সব মিলে লালনের সঙ্গে আমার একধরনের যোগাযোগ আছে। আমার বাড়িও কুষ্টিয়াতে।
তো তাহলে কী হলো, আমার লালন সম্বন্ধে পড়া আছে, যারা লালনপন্থি তাদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। লালন নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদের বেশিরভাগ লেখাই, বেশিরভাগ লোকের লেখাই আমার পড়া। শুধু তাই না, লালনের বাইরে কী পড়া আছে, ধরো গিয়ে আমি পোস্ট-মডার্নিটি, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম—এই যে কন্টিনেন্টাল ফিলোসফির যে শিফ্টগুলো সেই শিফট্গুলো সম্পর্কেও কিছু জানি। আমি রিলিজিয়ন ও সেক্যুলারিজম সম্পর্কেও পড়ালেখা করি। আমি আর কী পড়েছি, ভিজ্যুয়াল কালচারাল নিয়েও পড়েছি। আর পড়েছি পলিটিকাল ইকোনমি। পলিটিকাল ইকোনমি নামে একটা শব্দ আছে না? পলিটিকাল ইকোনমি হচ্ছে, একটা ফিল্ড অব অ্যানালিসিস, বলা যায় কার্ল মার্কসের হাতে পলিটিকাল ইকোনমির জন্ম। পলিটিকাল ইকোনমি যে শব্দটার প্র্যাকটিস শুরু হলো, সেটার সূত্রপাত ঘটে মার্কসের হাত ধরে। কারণ এর আগে ধরো, অ্যাডাম স্মিথ কিংবা রিকার্ডো বা অন্য কেউ সারপ্লাস ভ্যালু কোথা থেকে হয়—এই ধারণা তৈরি করতে পারেনি। মার্কস বললো, কয়েল অব দ্য লেবার বা লেবারের শ্রম, লেবারের ঘাম সেটা হচ্ছে সারপ্লাস ভ্যালুর উৎস। সেই লেবারের শ্রম থেকে, ঘাম থেকে পুঁজি তৈরি হয়। ক্যাপিটাল বা ক্যাপিটালিজমের যে উৎপত্তি সেটা তার থেকে। আর সেখান থেকেই পলিটিকাল স্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ হলো, যা ১৮৪৮-এ সে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে লিখেছে।
যাক, ফুকোর একটা লেখা আছে, ‘অর্ডার অব থিংকস’ বইয়ে একটা চ্যাপ্টার আছে ‘লেবার, লাইফ, ল্যাঙ্গুয়েজ’। তো ধরো যে, লেবার একটা কনসেপ্ট তাকে ঘিরে পলিটিকাল ইকোনমি; লাইফ একটা ধারণা, সেই ধারণাকে ঘিরে লাইফ সায়েন্সের ডিসিপ্লিনগুলো তৈরি হচ্ছে। এই সবকিছু আমার কিছু কিছু পড়া আছে।
ফলে কী হয়, আমি যখন ফিল্ম অ্যানালিসিস করতে যাই, তখন কী ঘটে, এই সব রকম ফিল্ডের পড়ালেখার প্রভাব পড়তে থাকে। এখন আমরা যদি ফিল্মের ডিসিপ্লিনারি বাউন্ডারির সীমায় আটকে থাকি, তখন সমস্যা। ধরো যে আমাদের মিডিয়া স্টাডিজে যেটা হয়েছে, অ্যানথ্রোপলজি, হিস্ট্রি, সোসিওলজি, লিটারেচার সবধরনের লোকের পার্টিসিপেশন আছে। মার্শাল ম্যাকলুহানের কথা আমরা সবাই জানি, সে কিসের লোক? সে আসলে লিটারেচারের লোক। ধরো, রেমন্ড উইলিয়ামসের নামও তোমরা জানো ব্রিটিশ কালচারাল স্টাডিজ বলে যে ধারাটি আছে সেটার সূত্রপাত ঘটেছে তার হাতে, তিনি মিডিয়া নিয়ে, কালচার নিয়ে প্রচুর অ্যানালিসিস করেছেন। সত্যিকারার্থে সেগুলো একটা ডিসিপ্লিনের জন্য হিউজ কন্ট্রিবিউশন। সে-ও কিন্তু ডিসিপ্লিনের বাইরের লোক, মিডিয়া স্টাডিজের লোক না। মিডিয়া স্টাডিজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি ইন্টারভেনশন দরকার। ফিল্মটাকেও আমার কাছে এ রকম একটা এরিয়া মনে হয়। ফিল্মটাকেও অ্যানালিসিস করার জন্য আমাদের এ রকম একটা ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি ইন্টারভেনশন দরকার হয়।
এসব বলছিলাম মনের মানুষ সিনেমার প্রসঙ্গ ধরে। মনের মানুষ ফিল্ম যখন আমি অ্যানালিসিস করি সেখানে অনেক ডিসিপ্লিনের উপাদান এক সাথে এসে হাজির হয়। যে উপাদানগুলো শুধু যারা ফিল্ম স্টাডিজ পড়েছে কিংবা শুধু অ্যানথ্রোপলজি পড়ে, শুধু মেইনস্ট্রিম ইতিহাসের ছাত্র তার পক্ষে ধরা সম্ভব না। ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে যে সোশ্যাল সায়েন্সের অন্যান্য এলাকায়ও পড়ালেখা করেছে তার পক্ষে এটা নিয়ে একটা ভালো অ্যানালিসিস দাঁড় করানো সম্ভব। যাই হোক, ফিল্ম অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে আমার কাছে কয়েকটা জায়গা, টেকনিকালি ইম্পোর্টেন্ট মনে হয়। ডিসকোর্সের কথা বলতেছিলাম, একটা ফিল্ম কোনো না কোনোভাবে একটা ডিসকোর্সের পার্ট। তাহলে ফিল্ম যদি ডিসকোর্সের একটা পার্ট হয়, তো যেকোনো ডিসকোর্স কী করে? সে কিছু নিয়মকানুন, সে কিছু নৈতিকতার কথা বলে, সে কিছু এথিক্সের কথা বলে এবং একধরনের সত্যের কথা বলে। এটা সত্য, এটা সঠিক, অন্যটা বেঠিক। একটা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে। মানুষের বিশেষ ধরনের জীবন-যাপনের কথা বলে।
তাহলে ফিল্ম যাই বলুক না কেনো, যদি তুমি তার টেক্সটের মধ্যে ঢোকো, তাহলে ওই ডিসকোর্সের বিশেষ গুণগুলোকে তুমি ফিল্মটার ভিতরে চিহ্নিত করতে পারবে। তাহলে তুমি বুঝতে পারবা, কোন্ গুণগুলোর কারণে ফিল্মের ক্যারেক্টারগুলো, ফিল্মের বক্তব্য বা ফিল্মের ভিজ্যুয়ালিটি এই রকম কথা বলে? এখন ধরো যে, ফিল্মের ক্রিটিসিজম কি শুধু ফিল্মের টেক্সট ক্রিটিসিজম? এটা বোধ হয় না। ফিল্মের তিনটি ডাইমেনশন খুব ইম্পোর্টেন্ট। একটি হচ্ছে টেক্সট, একটি প্রোডাকশন এবং অন্যটি কনজামশন। কনজামশন কীভাবে ঘটছে, রিসেপশন কীভাবে ঘটছে, অডিয়েন্স কীভাবে ফিল্মকে কনজিউম করে এবং ফিল্ম প্র্যাকটিসের সাথে তারা কীভাবে ইনভল্ব থাকে। অডিয়েন্স এথনোগ্রাফি এখন তাই বিশ্লেষণের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ডাইমেনশন, অডিয়েন্স বা আমি কীভাবে ফিল্ম বা টেলিভিশনের সঙ্গে বাস করি, আমি কীভাবে অনলাইনের সাথে বসবাস করি বা কীভাবে অনলাইনে জীবন-যাপন করি—এগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে।
অডিয়েন্স কিংবা যারা পার্টিসিপেট করছে, যারা প্রতিনিয়ত ফিল্ম দেখছে তাহলে তাদের অবস্থান থেকে ফিল্মকে বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ—যেটাকে বলা যায় টেক্সুয়াল অ্যান্ড কনটেক্সুয়াল অ্যানালিসিস। কালচারাল স্টাডিজে বলা হয়, ফিফটিজে (৫০ এর দশকে) যখন কালচারাল স্টাডিজ শুরু হচ্ছে, তখন টেক্সুয়াল অ্যানালিসিসের গুরুত্ব অনেক বেশি করে দেখা হয়েছে, যেনো টেক্সটাই হচ্ছে আসল। টেক্সটকে কনটেক্সট ফ্রি করে দেখা হচ্ছে। এ যেনো টেক্সটের স্বাধীন অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব দাবি করা। কিন্তু এর বিপরীতে এসে পোস্ট-মডার্নিজমে যেমন বলা হচ্ছে, একটি টেক্সট লেখা হয়ে গেলে অথারের মৃত্যু হয়, এই কথাটা তোমরা শুনেছো বোধ হয়? লিওতার যখন অথারের মৃত্যু ঘোষণা করছেন কিংবা ফুকো যখন বলছেন, রিডারের জন্ম হইতে পারে তখনই, যখন অথারের মৃত্যু ঘটে। অথারের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই রিডারের জন্ম। রিডার তার অথারশিপ, তার পজিশনকে ক্লেইম করতে পারে, অ্যাসার্ট করতে পারে যখন অথারের মৃত্যু হয়।
ইভেন ধরো, সাবলটার্ন স্টাডিজের কথা, আমি যেখানে পড়ি সেখানে এর জন্ম। এটা কলোনিয়াল হিস্ট্রি অ্যানালিসিসের একটা ধারা। তো, সাবলটার্ন স্টাডিজ যখন শুরু হলো এবং খুব রমরমা, সেই সময় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক একটা কোশ্চেন করলো। সাবলটার্ন স্টাডিজের গবেষকরা দাবি করছেন যে, তারা সাবলটার্নদের স্বর খুঁজে বের করতে চান; তারা দাবি করছেন, রনজিৎ গুহের কাজে যেমন দেখা যায়, কৃষকদের আলাদা একটা ‘চৈতন্য’ আছে, যে চৈতন্য সন্ধান করা যায় এবং যে খণ্ডিত চৈতন্য অ্যাড্রেস করে পূর্ণতা দেয়া যায়। তো গায়ত্রী স্পিভাক একটা প্রশ্ন করেছিলো তখন, সাবলটার্নরা কি কথা বলতে পারে (ক্যান দ্য সাবলটার্ন স্পিক?), কৃষক চৈতন্য বলে আদৌ কি স্বতন্ত্র কিছু আছে যা প্রবলের বিপরীত? সাবলটার্নের কথা আমি কেনো বলছি, সাবলটার্ন স্টাডিজের লোকজন কেনো বলবে?
তো এ প্রসঙ্গে, অনেকদিন পরে, গায়ত্রী আর্গুমেন্ট দাঁড় করাচ্ছিলো এ রকম—সমাজে এমন পজিশন থাকে, এমন ব্যক্তি আছে সমাজে, এমন লাইফ থাকে, যে লাইফ অ্যাসার্ট করতে পারে না, কিছুই অ্যাসার্ট করতে পারে না। মানে পৃথিবীতে কোনো রকমের মার্ক-ই রাখতে পারে না। আমাদের যে দৈনন্দিনতা সেখানে তার কোনো রকমের রেজিট্যান্স তো দূরের কথা, নিজ অস্তিত্বের জানানটুকুও দিতে পারে না। কৃষকের রেজিট্যান্স নিয়ে কথা হচ্ছিলো, রণজিৎ গুহ যে রেজিট্যান্স নিয়ে বই লিখেছেন। গায়ত্রী বলছেন, রেজিট্যান্স তো তাহলে আর রেজিস্ট্রার হয় না। তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে আমার যে অস্তিত্ব, সে অস্তিত্বের যে সঙ্কট বা সম্ভাবনা, যে টানাপড়েন সেটাকে রেজিস্ট্রার করানো উচিত এবং তার জন্য কী দরকার? আমাদের দরকার হচ্ছে লার্ন টু লার্ন ফ্রম দেম। আমাদের শিখতে হবে তাদের কাছ থেকে। তো এটা কেমন?
এই সঙ্কটটার কথা তিনি আলোচনা করেছেন তার ঠাকুরমার জীবনের উদাহরণ থেকে। যেমন—মেয়েদের মেনোপজ নিয়ে নানা সঙ্কট তৈরি হয়। সেই সঙ্কটে পড়ে তার দাদি কাউকে কিছু বলতে পারেনি, কোনো রকমের কোনো কিছুই করতে পারেনি। গায়ত্রী তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন, তিনি বুঝতে পারেন যে—ঠাকুরমার এ রকম একটা সঙ্কট হয়েছে এবং তিনি সেটা বলতেও পারেননি এবং মারা গিয়েছেন। এখন এই সঙ্কট, এই মারা যাওয়াটা রেজিস্ট্রার করাটা তাহলে প্রথম কাজ। রেজিস্ট্রার করা কী রকম? রেজিস্ট্রার করা মানে আমার অস্তিত্ব রেজিস্ট্রার করা। এইটুকু করার জন্য দরকার হয় তার পজিশনকে স্বীকৃতি দেয়া। এখানে যেটা বলতে চাচ্ছিলাম যে, অথারের মৃত্যু কিংবা রিডারের জীবন, এটাকে আমাদের আসলে এইখান থেকে দেখতে হবে।
অথার এবং রিডারকে টেক্সটের জায়গা না বরং লাইফের জায়গা থেকে দেখতে হবে, বলার জায়গা থেকে দেখতে হবে। কিংবা আমার যে একটা পজিশন আছে, আমি যে জগতে জীবন-যাপন করছি, সেই জগতে আমার যে জীবন, সেই জীবনের জায়গা থেকে আমরা যা দেখছি, যা করছি, সেই জায়গা থেকে আমার অবস্থানকে রেজিস্ট্রার করার শক্তিটা অর্জন করতে হবে।
যেমন ধরো, অনেক কিছুই আজকাল ঐতিহ্য হিসেবে সেল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের লৌকিক অনেক ঐতিহ্য আমরা রি-কন্সট্রাক্ট করতেছি, বিক্রি করতেছি। এই দিক থেকে অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, নিজেদের কমিউনিটির লোকেরাও পার্টিসিপেট করতেছে। ফলে পুঁজিবাদের আগ্রাসন প্রতিরোধে আমাদের রেজিট্যান্সের যে সম্ভাবনা তা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই কারণে অ্যাক্টিভিস্টদের কাজ হলো রেজিস্ট্রার বা রেজিট্যান্সের জায়গা থেকে পুরো প্রক্রিয়াটা দেখা এবং যে রিপ্রোডাকশনগুলো হচ্ছে, যে হাইব্রিডিটি হচ্ছে তার সম্ভাবনার জায়গা থেকে দেখা। এগুলোর ক্ষতিকর দিক এবং সম্ভাবনার দিকগুলো দেখা। তাহলে বলা যায়, ফিল্মের যে রিডার বা ভিউয়ার, সেই ভিউয়াররা, যে ভিউয়ার প্রতিনিয়ত নির্মিত হচ্ছে ফিল্ম স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে, ফিল্ম কালচারে প্রতিদিন যে ভিউয়াররা নির্মিত হচ্ছে, সেই নির্মিত যে চোখ, যে ভিউয়ার, ইনডিভিজ্যুয়াল, ইনডিভিজ্যুয়ালিটি, তার পজিশন, এই পজিশনগুলো কোশ্চেন করা জরুরি। সেই পজিশনগুলোকে রি-ইন্টারপ্রিয়েট করা, রেজিস্ট্রারের জায়গা থেকে দেখা জরুরি।
তো হিস্ট্রি, ফিলোসফি কিংবা ধরো লিটারেচার এই সবকিছুই তাহলে, আমি যখন অ্যানালিসিস করতে যাই, একই পাটাতনে এসে হাজির হচ্ছে। আমাদের ইতিহাস হচ্ছে পুরাণ কথা, তাই না? হিস্ট্রি আর ইতিহাস কিন্তু এক জিনিস না। তবে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, এই হিস্ট্রিকে আমরা বলি সায়েন্টিফিক প্রোডাকশন, সেই হিস্ট্রি ইটসেল্ফ একটা একটা কাহিনী, সেটাও নির্মিত এবং সেটাও কাহিনী। তো এই কাহিনীর জগৎ, যেখানে আসলে এই যে রিয়াল এবং আনরিয়ালের যে ডিসটেন্সগুলো আমরা তৈরি করি সেগুলো এক এক ধরনের পলিটিকাল পজিশন।
একজন ইন্টারপ্রিয়েটরের কিংবা একজন ক্রিটিকের অবস্থান যখন পলিটিকাল অবস্থান। আমি যখন লিখি তখন আমি একটি পলিটিকাল অবস্থান থেকে লিখি, একটা অবস্থান গ্রহণ করি। সেই একইভাবে যে প্রোডাকশনটা তৈরি হচ্ছে, সেটাও একটা পলিটিকাল অবস্থান। আমার পলিটিকাল পজিশন থেকে, পাওয়ার অরগানাইজেশনের জায়গা থেকে, পাওয়ার রিলেশন এবং ডিস্ট্রিবিউশনের জায়গা থেকে আমাদের ফিল্মগুলোকে দেখতে হবে; এবং যে বাউন্ডারিগুলো আমরা তৈরি করেছি, ক্যাটাগরিগুলো তৈরি করেছি, সেই ক্যাটাগরিগুলোর ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে, সতর্ক থাকা খুব জরুরি।
বাউন্ডারির কথা বলতেছিলাম, ধরো আমরা মনে করি—ইতিহাসের এক একটা যুগ আছে। কী যুগ? বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পড়ছো—প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক যুগ। আমরা মনে করি, রেনেসাঁ একটা বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ে ঘটলো। আমরা মনে করি, শিল্পের এক একটা ক্যাটাগরি বা বাউন্ডারি আছে। আসলে এই বাউন্ডারিগুলো সবই কন্সট্রাক্টেড। ধরো মডার্নিটি, নন-মডার্নিটি, রিলিজিয়াস বা সায়েন্টিফিক বলে যে ক্যাটাগরিগুলোর কথা বলি, এটা বৈজ্ঞানিক বা এটা অবৈজ্ঞানিক বলি, সেই বাউন্ডারিগুলো খুবই নড়বড়ে বাউন্ডারি। কিংবা আমরা যেটাকে নারীত্ব এবং পুরুষত্ব বলি, যেটাকে আমরা ন্যায় এবং অন্যায় বলি, সেই ন্যায় এবং অন্যায়ের বাউন্ডারিগুলো খুবই প্রবলেমেটিক। এমন অনেক কিছুই আছে যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে অন্যায়, কিন্তু সেটা হয়তো আল্টিমেটলি খুবই ন্যায়সঙ্গত। যেমন ধরো যে আইন এবং ন্যায্যতা—এ দুটা একেবারে আলাদা জিনিস। আমরা অনেক সময় এই দুটাকে এক করে দেখি। যেমন দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্র—এই দুটাকেও আমরা এক করে ফেলি। দেশপ্রেমের যে ধারণা সেটাকে আমরা কোথায় প্রয়োগ করি, রাষ্ট্রের ওপর। এখন এই প্রেম যদি না থাকে, তবে তুমি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাও। দেশ কিংবা রাষ্ট্রকে আমরা মায়ের সাথে এক করে দেখি। তো এই যে সঙ্কটগুলো, আমি বলছি বাউন্ডারি এবং ক্যাটাগরিগুলো, মডার্নিটি এবং নন-মডার্নিটি, পশ্চাৎপদতা এবং আধুনিকতা—এই বাউন্ডারিগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আসলে আমরা একই সাথে মাল্টিপল সময়ে বাস করি, একই সাথে আমি প্রিমিটিভ এবং আধুনিক—সো কল্ড আধুনিক, সো কল্ড প্রিমিটিভ—দুই রকমের ভ্যালুজই প্র্যাকটিস করি সোসাইটিতে। ইভেন শুধু ভ্যালুজ না, একজন ইতিহাসবিদ (দামোদর কোসাম্বি) একদিন দেখতেছিলো, তার ঘরের মধ্যে একটা ওয়াশিং মেশিন আছে, সেটা কখনকার জিনিস? তোমার ঘরের মধ্যে এখন ইন্টারনেট আছে, তো এটা কখনকার জিনিস, সর্বাধুনিক টেকনোলজিকাল অ্যাসিভমেন্ট এটা। তোমার ঘরের মধ্যে একটা শিলনোড়া আছে, শিল-পাটা আছে, এটা কবেকার জিনিস; এটা প্রস্তর যুগের জিনিস। প্রস্তর যুগে শিল-পাটার ব্যবহার শুরু হয়েছিলো। তাহলে প্রস্তর যুগের ম্যাটেরিয়াল বা কালচারাল ম্যাটেরিয়াল এবং এখনকার কালচারাল প্রোডাকশন বা ম্যাটেরিয়াল দুটোই টিকে আছে। কোসাম্বি সেহেতু ইতিহাসের স্তর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
যাই হোক, আমাদের মনের জগতটাও এ রকম। এর মধ্যে প্রিমিটিভ বা সো কল্ড প্রিমিটিভ এবং সো কল্ড মডার্ন সবকিছুই থাকে। তাহলে এই কথাটাই বলতে হচ্ছে যে, আমাদের যেকোনো প্রোডাকশন যেকোনো কিছুর মধ্যে আমি এ রকম ক্যাটাগরির অস্তিত্ব দেখি না; যেটা দেখি তা হলো একটা প্রোডাকশন। তাহলে অ্যানালিসিসও করতে হবে, ওরকম কোনো ক্যাটাগরির সীমানায় দাঁড়িয়ে না। তুমি যদি মার্কসিস্ট অ্যানালিসিস করো, তাহলে দেখা যাবে শুধু মার্কসিজম দিয়ে সমাজকে সবটুকু বোঝা সম্ভব না। তুমি যদি মনে করো, না আমি একটা লিবারেল অ্যানালিসিস করলাম, আমি একটা সাইকো-অ্যানালিটিক বিশ্লেষণ করলাম—তাহলে হয়তো বহু রকমের অর্থময়তা ধরা সম্ভব না। অসংখ্য রকমের ইন্টারপ্রিটেশনের সম্ভাবনা থাকে এবং ভিউয়ারেরও অসংখ্য পজিশন থাকে; ফিল্মের অসংখ্য পজিশন থাকে। তাহলে আমরা সেই পজিশনগুলোকে ইন্টারপ্রিয়েট করবো কোন্ জায়গা থেকে, কোন্ পলিটিকাল পজিশন থেকে। লাইফের প্রশ্নে কোন্ পলিটিকাল পজিশন গ্রহণ করবো সেটা নির্ভর করে আমি যে সোসাইটিতে বাস করি, আমি যেটাকে আমার মোরালিটির পজিশন থেকে ন্যায্য মনে করি, আমার জন্য ভালো, কমিউনিটির জন্য ভালো মনে করি—সেরকম পজিশন থেকে আমি তাহলে অ্যানালিসিস করবো। আমি অবজেক্টিভ অ্যানালিসিস না, সাবজেক্টিভ অ্যানালিসিসের পক্ষের লোক। যেগুলো অবজেক্টিভ, সো কল্ড অবজেক্টিভ অ্যানালিসিস বলে দাবি করা হয়, সেগুলো খুবই প্রবলেমেটিক জিনিস প্রোডিউস করে।
এই হলো সব মিলিয়ে আমার বলার কথা; আরো অনেক কথা আছে; আরো বেশকিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম; যেমন ধরো মিথ তৈরি হয় কীভাবে? যেভাবে ধরো একটা রেইজিম অব ট্রুথ তৈরি হয়। সিনট্যাগম্যাটিক বা প্যারাডিগম্যাটিক অ্যানালিসিস কী; প্যারাডাইম কী কিংবা প্যারাডাইম কীভাবে তৈরি হয়—এই বিষয়গুলো আমাদের ফিল্ম অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আমাদের ইকোনমিক কোশ্চেন; আমাদের আইডেন্টিটি ও জাতিসত্তা, তার যে পলিটিক্স, রিলিজিয়াস পলিটিক্স—এ সবই ফিল্ম অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। আর ভিজ্যুয়ালিটি তো আছেই।
যাই হোক, মামুন আমাকে সেদিন বলছিলো—স্যার, আপনার মতো এ রকম আর কাউকে দেখতেছি না বাংলাদেশে। সঙ্গে আরেকটা কথা যোগ করেছিলো, যেটা এখানে বলার বিষয়। ও বললো যে, স্যার আপনার একটা জায়গায় দুর্বলতা আছে, ফিল্মের ল্যাঙ্গুয়েজটা আপনার জানা নাই, বলছিলো যে এইটা আপনি অ্যানালিসিস করেন না। আসলে ওটা আমি করতে চাইওনি কোনোদিন, আসলে ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজের টেকনিকালিটি, আমার আগ্রহের জায়গা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। হয়তো দু-একটা জায়গায় কিছু কথা বলেছি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে, লাইট নিয়ে, তার ক্যামেরা ওয়ার্ক নিয়ে। ধরো, আমি ব্যাচেলর নিয়ে যখন অ্যানালিসিস করছিলাম তখন মাঝে মাঝে প্রশ্নগুলো এসেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, আমি ফিল্ম কিংবা অ্যা গ্রুপ অব ফিল্মের মধ্যে একটা মেজর প্যাটার্ন দেখতে চেয়েছি সবসময়।
যেমন ধরো, একজন ক্রিটিক রানওয়ের ক্রিটিসিজম করবে। রানওয়েতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তারেক মাসুদ। আমার কাছে মনে হয়, এই প্রসঙ্গগুলো কেনো? একটা গল্প যখন বলি, তখন আমি কীভাবে বলি যে, ঘরের টেবিলটা ছিলো এ রকম, টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রাখা আছে, কাপের পাশে একটা গ্লাস রাখা ছিলো, সে একটা বই পড়তেছিলো, ওমুকের একটা বই পড়তেছিলো, এই চশমা পরা ছিলো। এই যে কতো কিছু বললাম তাই না! এই সব বলাটা তাহলে কেনো? গল্পকে বানিয়ে তোলা। গল্পটা নির্মাণের এগুলো হচ্ছে নানারকম সরঞ্জাম, মসলা। তুমি যখন ভাত খাচ্ছো তরকারি দিয়ে, তখন কি আলাদা করে লবণ, হলুদ সবকিছু মিশিয়ে নিয়ে খাবে? তাহলে গল্পকে বানিয়ে তোলার জন্য অনেকগুলো উপাদান এর সাথে যুক্ত থাকছে। আমাকে দেখতে হবে, এসেন্স’টা (Essence) কী এইখানে; যেটাকে বলা যায় মাস্টার ন্যারেটিভ কী আছে এখানে। এতো গল্পের মধ্যে কোন্ গল্পটা ডমিনেট করছে, কোন্ ভিউয়িংটা, কোন্ ডাইমেনশনটাকে ফোকাস করছে। যেমন রানওয়েতে গার্মেন্টস কারখানা, নদীভাঙন, এনজিও, বিদেশ গমন, বেকারত্ব ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ আছে। এই প্রসঙ্গগুলো আসলে মূল গল্পটা বলার জন্য বলা। আসল বলার কথা হলো, একটা ছেলে সে জঙ্গি হয়ে উঠতেছে এবং সে জঙ্গি হচ্ছে উর্দু ভাইয়ের কাছে গিয়ে। উর্দু ভাই মানে ‘বাংলা ভাই’। এখন এই ‘হয়ে ওঠা’টা সমাজের জন্য খুবই জঘন্য কাজ। এখন তার দরকার হচ্ছে ফিরে আসা এবং সে ফিরে আসার চেষ্টা করে, তাইতো? এই যে গল্প, ফিরিয়ে আনার গল্প, সংশোধন করার যে চেষ্টা এইটাই মেজর গল্প, এই গল্পটা কিন্তু ফোকাসে থাকা দরকার। এখন যদি অ্যানালিসিসে অনেকগুলো প্রসঙ্গকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে চাই, তাহলে প্রধান গল্পটা আর ফোকাসে নাও থাকতে পারে। এটা আমার লেখায় আমি সবসময় দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু তবু আমি যখন ব্যাচেলর নিয়ে লিখলাম, সেখানে একটা পোর্ট্রটে আছে, ব্যাচেলররা যে ঘরে থাকে সেখানে একটা সোফাসেট আছে। সেই সোফাতে বসে, হেলান দিয়ে নানাভাবে তারা নারীদের সঙ্গে কথা বলে। ঠিক সোফার উপরে একটা পোর্ট্রটে আছে, যে পোর্ট্রটে একটা নারীর, ওপেন বক্ষ মানে ন্যুড। এখন যখনই ব্যাচেলররা কথা বলে, তখন কিন্তু ঘরের লাইট ইম্পোর্টেন্ট, একটা সোফা ইম্পোর্টেন্ট। মানে সেক্সুয়ালিটির কোশ্চেনে সোফা ইম্পোর্টেন্ট একটা আসন হিসেবে, এটা টেবিল চেয়ার না কিন্তু। সোফা আছে, ঘরে নীল হালকা আলো এবং খুবই পরিচ্ছন্ন আলো এবং সঙ্গে সেই পোর্ট্রটে। যখনই কোনো মেয়েরা ফোন করে বা কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে ফোন করে, তখন মাঝে মাঝে ওই পোর্ট্রেটের কিছু অংশ একটু একটু করে দেখা যায়। এখন যে ফিল্ম দেখতেছে, সে কী দেখতেছে তাহলে? ছেলেটা কোনো একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেছে, তাই না? এবার তার সঙ্গে সঙ্গে তার ইমাজিনেশন আরেকটা জিনিসকে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেই সাপোর্ট দিচ্ছে পোর্ট্রটেটা। এই যে ভিজ্যুয়ালিটি, এটা হয়তো আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্লেষণ করি না।
একটা কথা আছে, মানে, যে ভালো রাঁধুনি সে রান্নাঘরের যন্ত্রপাতি দিয়ে টেবিলের খাবার সার্ভ করে না; যন্ত্রপাতি রান্নাঘরেই রেখে আসে, খাবারটা টেবিলে সার্ভ করে। একজন ভালো অ্যানালিস্টও কিন্তু কী কী টুল দিয়ে অ্যানালিসিস করলো, সেটা সে বলবে না। ও যেটা বলছে সেটা ইম্পোর্টেন্ট নিশ্চয় এবং ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজের দিকেও নজর রাখা দরকার। কিন্তু এটাও ইম্পোর্টেন্ট যে, তুমি যা দিয়ে রান্না করছো, যেমন খুন্তি কড়াই সেগুলো সহই যেনো টেবিলে খাবার সার্ভ না করো। যে ব্যাখ্যাটা দাঁড় করাচ্ছো কিংবা যে থিসিসটা দাঁড় করাচ্ছো, সেই থিসিসটাতে ওমুক মডেল ওমুক থিওরি অনুসারে করেছ এইসব বলার বিশেষ প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন হচ্ছে বলার কথাগুলো বলা। সেই কথাটা সহজে, ফোকাসড ওয়েতে, প্রিসাইজলি বলাটা জরুরি। যাই হোক আজকের মতো আলাপ শেষ করি। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে...
মামুন হায়দার : কারো কোনো কথা যদি থাকে সেটা বলা যেতে পারে। তার আগে আমার একটু কথা ছিলো স্যার। আমার কথাটা একটু বলি, আসলে তো ফিল্ম একটা টোটালিটি। মানে এটা শুধু স্টোরিটেলিংয়ের একটা বিষয় না। একটা টোটালিটিতে একটা স্টোরি যখন টেলিং হয়, তখন তো আসলে স্টোরি তো শুধু স্টোরি থাকে না। আপনি যে ভিজ্যুয়াল ইমেজের কথা বললেন, সেই ইমেজ তো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আ-আল মামুন : অবশ্যই। আমি যদি ফিল্মের ল্যাঙ্গুয়েজের কথা বলি, আমি যখন বলি আমাদের হুমায়ূন আহমেদ তো কোনো ফিল্ম বানায়নি; আমাদের হুমায়ূন আহমেদ তো কোনো ফিল্ম বানাইতে পারে না; তানভীর মোকাম্মেল কোনো ফিল্ম বানাইতে পারে না। তখন আমি কী বলি? কিংবা যখন তারেক মাসুদেরটা ফিল্ম হয়ে ওঠে। কিন্তু ইন সাম কেসেস দেয়ার আর প্রবলেমস? যে ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজ, তার যে ভিজ্যুয়ালি কথা বলা, আমি একটাতে কলম দিয়ে কথা বলছি, কোথাও আমি মুখে কথা বলছি, ফিল্মে আমি ভিজ্যুয়ালি কথা বলছি; লাইট এবং ক্যামেরা দিয়ে কথা বলছি। সেই ক্যামেরা দিয়ে যদি আমি কথা না বলতে পারি, তাহলে আমার সেটা ফিল্ম হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু ফিল্মে তো ধরো কাব্যিক একটা ভাব থাকে, অসাধারণ কিছু জিনিস থাকে।
ধরো, একটা ফিল্ম আসলে তখনই ফিল্ম হয়ে ওঠে এবং সেটাকে ফিল্ম তখনই বলি, যখন সে একটা গল্প বলতে পারে। সে ভিজ্যুয়ালি বললো কী মুখের কথায় বললো, দ্যাটস নট ইম্পোর্টেন্ট টু মি। ইম্পোর্টেন্ট হলো, আমি একটা ফিল্ম দেখলাম, ফিল্ম দেখার পরে আমি কিছুক্ষণ হয়তো কিংবা অনেকক্ষণ, কিংবা অনেক দিন ধরে কিংবা অনেক মাস ধরে ওইটা আমাকে হন্ট করতে থাকলো, আমি চেইঞ্জ হলাম। যদি এটা না ঘটে, তাহলে সেটা ফিল্ম হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা হয় না, তার ল্যাঙ্গুয়েজ, তার ইমেজ খুব ইম্পোর্টেন্ট এখানে গল্পটা বলার জন্য। মামুন যেটা বলছে, আমার লেখায় নিশ্চয় ইমেজ নিয়ে আরেকটু বেশি কথা বলা দরকার।
মাহমুদুল হাসান পারভেজ : স্যার, আপনি অনেক কথা বললেন, ফিল্ম অ্যানালিসিস বা ক্রিটিসিজম করার জন্য ডিসিপ্লিন, সমাজ, অর্থনীতি—এ ধরনের বিষয়গুলো যুক্ত হবে। কিন্তু বেসিক ফিল্ম ক্রিটিসিজমের জন্য বা অ্যানালিসিস করার জন্য আরেকটু ডিপলি যদি বুঝাইতেন। অনেক বিষয় আছে, স্যার এখানে যা অ্যাকাডেমিকালি বুঝাইছেন যে, এগুলো জানতে হবে। কিন্তু ক্রিটিসিজম কী বা কোন্টা ধরে এগোতে হবে। কী বলবো আমি, যেহেতু আমি নতুন, সেক্ষেত্রে।
আ-আল মামুন : ফিল্ম ক্রিটিসিজম বলে আলাদা কিছু তো আমার কাছে নাই, আমি তো প্রথমেই সেটা বলেছি। ক্রিটিসিজমের মননশীল এবং সৃজনশীলতার বাউন্ডারি আমি মানি না। তার মানে হলো, সো কল্ড যে ফিল্ম রিভিউ বা এ রকম কিছু আমি আসলে করি না। আমি ডিকন্সট্রাক্ট করি; একটা স্টোরিকে পুনর্নির্মাণ করি। তোমার যে একটা ইন্টারপ্রিটেশন দিচ্ছো, ভিউয়ারের যে একটা গেইজ তৈরির চেষ্টা করছো, আমি সেই গেইজের বাইরে আরেকটা পার্সপেক্টিভ বের করার চেষ্টা করছি। যেখানে ভিউয়ার ভিন্নভাবে ফিল্মটাকে দেখার চেষ্টা করতে পারে। পরিচালক হিসেবে তুমি যে মিনিংগুলো, যে বিষয়গুলো গোপন করে গেছো, আমি সেই বিষয়গুলোকে ওপেন করে দিলাম, এবার তোমরা অন্যভাবে দেখো। এটা হচ্ছে ইম্পোর্টেন্ট, ভিউয়ারের পজিশন বা মাল্টিপল ভিউয়িং পজিশন তৈরি করা।
এখানে আরেকটা কথা বলি, একটা উদাহরণ দিই, সেটা হলো—আবার মিশেল ফুকোর কথা বলতে হচ্ছে—ফুকো বলতেছে, সে যখন ‘হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস’ লিখেছে, তার আগে সে অনেকদিন ধরে পাগলাগারদে বাস করেছে। তার ‘মানসিক সমস্যা’ আগে থেকেই ছিলো, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, তার শিক্ষক আলথুসার তো বউকে মেরে বসে ছিলো এবং পরে নিজেও সুইসাইড করেছিলো। তো যাহোক, ফুকো বলতেছে, আমি যখন কোনো বিষয় নিয়ে লিখি, আমি সেই বিষয়টাকে অনুভবের চেষ্টা করি, আমি ফিল করার চেষ্টা করি, আই লিভ উইথ দ্যাট সাবজেক্ট। সে পাগলাগারদে বসবাস করতেছে, পাগলদের অ্যাটিটিউড দেখতেছে, তাদের অনুভূতি উপলব্ধি করতেছে এবং তারপর সে লিখতেছে।
আমার মনে হয়, যেকোনো লেখার ক্ষেত্রে, যেকোনো কিছু বলার ক্ষেত্রে এইটা ইম্পোর্টেন্ট। আমি একটা পজিশন থেকে কিছু বলবো, সেই পজিশনটা যদি আমি কোনোদিন নাই দেখি; গ্রামের মানুষের যে হাহাকার সেটা যদি আমি শুধু বলতে থাকি, অথচ কেনো হাহাকার সেটা যদি আমি নিজে না অনুভব করি, না দেখি গিয়ে—তাহলে সেটা হবে না। ‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’ যখন ফুকো লেখতেছে, তার আগে, ফুকো নিজেও হোমোসেক্সুয়াল ছিলো এবং তার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার জন্য সে ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেছে আলজেরিয়াতে। সেখানে গিয়ে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে, সেখানে থাকছে, সেখান থেকে ইরানে গেছে, অনেক কিছু করছে এবং মুভমেন্ট করছে, রাস্তায় মার খাচ্ছে, পুলিশ পেটাচ্ছে তাকে। সবকিছুর সঙ্গে তাহলে সে ইনভল্ব থাকছে। সে ওই লাইফটাকে লিড করছে, যে কারণে সে উপলব্ধি করছে সেক্সুয়ালিটি নিয়ে গড়ে ওঠা ডিসকোর্সগুলোর সমস্যা।
আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো ধরনের লেখা বা ফিল্ম নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে এ ধরনের উপলব্ধির জায়গাটা থাকা দরকার। আমি যখন মনের মানুষ নিয়ে লিখতেছি, তখন মনে হচ্ছে আমার পিঠে কেউ ছুরি মারছে—যে জাতিসত্তা বা যে প্রশ্নগুলো হাজির হচ্ছে, তার সাফারার আমরা সবাই এবং এখন পর্যন্ত। আমরা প্রতিনিয়ত সাফার করছি, সাম্প্রদায়িকতা ও মডার্নিটির সঙ্কটগুলোর জন্য—মডার্নিটির অ্যাপ্রোচ থেকে বিষয়গুলোকে আমরা যেভাবে দেখি, প্রতিনিয়ত যে জীবন আমরা যাপন করি, লালনকে আমরা প্রতিনিয়ত যেভাবে নির্মাণ করি এবং ব্যবহার করি এইগুলো সমস্যাজনক। যখন তুমি পিঠের ওপর মার খাও, তখন একটা ভালো উপলব্ধির জায়গা থেকে তোমাকে লিখতেই হবে—ফিল্ম ক্রিটিকও এ রকমই!
ফারুক ইমন : স্যার একটা কথা বলছিলেন, আপনি বাজার-না-পাওয়া ক্রিটিক। তো আপনার মনের মানুষ নিয়ে লেখাটা আমি পড়েছিলাম। লেখা পড়ার পর মনে হইছে, বাজার-না-পাওয়া ক্রিটিকের অনেক বেশি দরকার আমাদের এখন। মিশেল ফুকোকে আনলেন কিন্তু এটা আমার এখনো পড়া না। তাই বুঝতে পারিনি অনেক কিছুই। এখানকার কিছু কিছু ছাড়া বেশিরভাগ ধরতে পারছিলাম না। তো আমার যেটা কথা হলো, একজন পরিচালক যখন ফিল্ম করছেন, তখন সমালোচকের যে রকম বিশাল একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার ক্রিটিক করার জন্য, পরিচালকও সেই জায়গাতেই পড়ে।
দর্শক হিসেবে একটা ফিল্মে যে সিস্টেমগুলো দেখি, বাংলা ফিল্মে অনুশাসন অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে। ভাঙার ক্ষেত্রে আমাদের যে ডিসিপ্লিন বা নিয়ম বা শৃঙ্খলা এগুলো অনেক বেশি করে দেখানো হচ্ছে। ভাঙার জায়গাটা অনেক কম। ঋতুপর্ণ ঘোষ ভাঙার জায়গাটায় হাত দিয়েছিলেন প্রায়। তো আপনি এই ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন? পরিচালক যখন ফিল্ম বানাচ্ছেন, তার জায়গাটা ঠিক কী বলা যায়? বিনোদন, শুধুই বিনোদন, যা আল্টিমেটলি সমাজ পরিবর্তনের জন্য কিছু বলতে চাচ্ছে না, দায় নিচ্ছে না। তো এই বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন?
আ-আল মামুন : আসলে দায়দায়িত্বের প্রশ্ন তোলা মুশকিল। নর্ম্যাটিভলি, একজন আর্টিস্টকে সোশ্যাল কোনো দায়বদ্ধতার জায়গায় বাঁধা ঠিক কি না আমি জানি না। যদি কেউ রিয়ালি আর্টিস্ট হয়ে থাকে, আর্টিস্ট বলতে আমি যে ক্যাটাগরির মানুষকে বোঝাচ্ছি, সেই ক্যাটাগরির মানুষ যদি সে হয়ে থাকে, তাহলে সে অনিবার্যভাবে সোসাইটির কথা বলবে। যে দায়বদ্ধ হয় না বা হতে পারে না সে তখন এইগুলো করে। আজকের যুগে যেটা হয়, অনেক লিমিট তৈরি করা হয়েছে। একজন আর্টিস্টের মৃত্যু অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। আর্টিস্টের মৃত্যু, কবির মৃত্যু, শিল্পীর মৃত্যু অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। শিল্পীকে বানানো হচ্ছে এখন কমপ্রাডর কিংবা যেটাকে বলে শিল্প-পণ্য উৎপাদক। ওই পণ্য কয়েকটা বৈশিষ্ট্য ধারণ না করলে টিকতে পারে না। এটা ফিল্মের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য।
এখানে হিউজ ইনভেস্টমেন্ট থাকে, তাই বেশিরভাগ পরিচালকের পক্ষে এই স্টেইক বা ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হয় না। আর যদি কোনোভাবে ব্যবসা ব্যর্থ হয়, তাহলে তো তার মরণ। ফলে হয় কী, তাকে এই সঙ্কটগুলো মোকাবিলা করার জন্য কিছু কম্প্রোমাইজ করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে; যে যে কম্প্রোমাইজগুলো পরিচালককে অন্তত তার কিছু কথা বলার সুযোগ করে দেয়। ফিল্মের ক্ষেত্রে এইটা হয়, আর এ কারণে ফিল্মের মার্কেট এবং ফিল্মে ইনভেস্টমেন্টের সঙ্গে ফিল্মের টপিকের প্রশ্নটা আসে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নামে যে হিউজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে সেটাও কিন্তু এ-ই।
তাছাড়া দায়বদ্ধতা কী এবং কার প্রতি—একটা খুবই ইম্প্রিসাইজ একটা প্রশ্ন। সমাজ বলতে বা জনগণ বলতে আমি কী বুঝি? যেমন, গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন—বলতে আমি কী বুঝি, প্লেটো বলবে যে এটা ইডিয়টদের শাসনব্যবস্থা। তথাকথিত এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যুগেই সবচে বেশি মানুষ মারা গেছে। চমস্কি বলবে দুই ধরনের গণতন্ত্রের কথা। একধরনের গণতন্ত্র আছে, যেখানে আমরা একধরনের ম্যানেজার সিলেক্ট করি যারা শাসন করবে এবং আর, আরেক ধরনের গণতন্ত্র আছে যেখানে সবাই পার্টিসিপেট করতে পারে। পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসি আমাদের এখানে নাই। ফিল্মের ক্ষেত্রেও এই কথাগুলোই প্রযোজ্য। আমরা যদি বলি, জনগণের প্রতি, সমাজের প্রতি দায় আছে, তাহলে সমাজ বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, সেইটা আগে ক্লিয়ার করতে হবে। জনগণ বলতে কী বোঝাচ্ছি, সেইটা আগে ক্লিয়ার করতে হবে। ক্রিটিক যখন এইগুলো বলে, তখন ক্রিটিকের ক্রিটিসিজম করাটা জরুরি হয়ে যায়, বোঝা গেছে কি?
আহমেদ মাসুম : স্যার, আমরা যখন একটা ফিল্ম অ্যানালিসিস করবো আপনি বললেন যে, তখন সেটা আসলে পলিটিকাল পজিশন থেকে অ্যানালিসিস করতে হবে। পলিটিকাল পজিশন বলতে আপনি আসলে কী বোঝাচ্ছেন? এর বাইরে আরেকটি কথা, আমরা যখন একটা ফিল্ম ধরে আলোচনা করবো, তখন আমরা তার যে কন্টেন্ট আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করবো, এর বাইরে যে ফিলোসফি আছে সেটা আলোচনা করবো, কিন্তু এর বাইরে যে টেকনিকাল ডিভাইসগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো আমাদের আলোচনায় আনা উচিত কি না একজন সমালোচক হিসেবে?
আ-আল মামুন : এটা আসলে নির্ভর করে ফিল্মের যে প্রোডাকশন, যে সেট বা কোন্ কোন্ ডাইমেনশন আছে তার ওপর...আমি কোন্ কোন্ পার্সপেক্টিভ থেকে ফিল্মটাকে দেখবো সেটার ওপর। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সাইকো-অ্যানালিসিস পছন্দ করতে পারি; কিংবা জেন্ডার বা জেন্ডারের ডাইমেনশনটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট হতে পারে; কখনো অ্যাসথেটিকসের প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এইগুলো একেকটা অ্যানালিটিকাল টুল, যেমন ধরো সেমিওটিক অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো কোথাও সেমিওটিক অ্যানালিসিসের সঙ্গে সঙ্গে ডিসকোর্স অ্যানালিসিসও জরুরি। তাহলে ডিসকোর্স এবং সিমিওটিক অ্যানালিসিসে কী পেলাম? ডিসকার্সিভিটির যে জায়গা থেকে ফিল্ম প্রোডিউস হচ্ছে, ডিসকার্সিভিটির সেই জায়গা আমি চিহ্নিত করতে পারছি।
আবার, যে ইন্সটিটিউশনগুলো একটা ফিল্মকে পসিবল করে তুলেছে, যে রিডারের জন্য ফিল্মটা তৈরি হচ্ছে, যে রিডার এটা কনজিউম করতেছে, সেই রিডারের পার্সপেক্টিভ আবার কখনো ইম্পোর্টেন্ট হয়ে ওঠে। যেমন ধরো, ফোর্থ ইয়ারের শিক্ষার্থীদেরকে একটা জিনিস আমি পড়তে দিয়েছিলাম, ইন্ডিয়াতে একটা সিরিয়াল, টিভি সিরিয়াল ‘রামায়ণ’ ভীষণ পপুলার হয়ে উঠলো এবং লোকজন প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে কথা বলে, প্রতিদিন দেখতো। এটা একবার সম্প্রচার হওয়ার পরে পুনঃসম্প্রচারও হয়। এখন এটা যে শুধু জনগণের ভালো লাগছে—এই রকম জায়গা থেকে দেখার সুযোগ ছিলো না। পূর্ণিমা মানকেকার অন্য একটা জায়গা থেকে এটা দেখার চেষ্টা করলেন; তিনি বললেন, ইন্ডিয়াতে সেসময় যখন হিন্দুবাদের রাইজিং বা ডেভেলপমেন্ট ঘটতেছিলো, তারই ডিসকোর্সের পার্ট হিসেবে ‘রামায়ণ’-এর প্রোডাকশন ও কনজামশন হয়েছে। ‘রামায়ণ’ নতুন কিছু করছে কিংবা নতুন কোনো অ্যাঙ্গেল থেকে রামায়ণ দেখানো হচ্ছে—এমন নয়। এই হিন্দু রাইজিংয়ের সঙ্গে ‘রামায়ণ’-এর প্রোডাকশন, সম্প্রচার এবং কনজামশন রিলেটেড। এই যে বিপুল মুভমেন্ট ঘটলো, বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো, এইগুলো তাহলে এর সঙ্গে রিলেট হয়ে যায়, রাষ্ট্রের প্রশ্ন জড়িয়ে যায়। কিংবা ধরো, মূর্তি নিধন হলো অনেক জায়গায়, মুসলমানদের অপর করে তোলার প্রক্রিয়ায় এইটা কীভাবে পার্টিসিপেট করলো এই প্রশ্নটা ইম্পোর্টেন্ট হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে শুধু ‘রামায়ণ’-এর কন্টেন্টের সিমিওটিক অ্যানালিসিস করে আমি পাচ্ছি না এটা। তাহলে ওয়াইডার যে ডিসকার্সিভ ফরমেশন এই রকম প্রোডাকশনকে পসিবল করে তোলে এবং পিপলকে কন্সট্রাক্ট করে, সেই সম্ভাবনার জায়গাগুলো অ্যানালিসিসে আসা জরুরি হয়ে পড়ে। যে কারণে তারেক মাসুদের রানওয়ে নিয়ে যদি কোনো অ্যানালিসিস আমি করতে চাই, তাহলে সেই অ্যানালিসিসের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নগুলো আসা দরকার বা ইম্পোর্টেন্ট তা হলো বাংলাদেশের সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত। যে সময়ে ফিল্মটা তৈরি হচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে কী ঘটেছে বাংলাদেশে, কেনো ঘটেছে এবং সেই প্রসেসটা কী ছিলো, সেই প্রসেসের সঙ্গে এই ফিল্মেও পার্টিসিপেশন কী? এই বিষয়গুলো ফিল্মের সঙ্গে জড়িত, প্রশ্ন হিসেবে কিংবা গ্লোবাল যে কোশ্চেন এগুলোকে রিলেট করতে হবে এবং এ রকম ফোকাস খুব ইম্পোর্টেন্ট। তা না হলে রানওয়ে এ রকম একটা ফিল্ম, যে ফিল্ম প্রেসক্রিপ্টেড, এর কিছুই বোঝা যাবে না। তারেক মাসুদ এর আগে একটা চমৎকার ফিল্ম তৈরি করতেছে মাটির ময়না, সেখানেও একটা পলিটিকাল এজেন্ডা আছে, যে এজেন্ডা বোঝা যায়। মডার্ন, সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়বার আকাক্ষা সেটা বোঝা যায়। কিংবা ধরো যে অন্তর্যাত্রা, সেখানে কিছু প্রবলেমেটিক জায়গা আছে। কিন্তু রানওয়ের যে হিউজ ইনগেজমেন্ট, সেই হিউজ ইনগেজমেন্ট শুধু তার টেক্সট থেকে কিছুই বোঝা যাবে না।
আরেকটা প্রশ্ন বোধ হয় ছিলো, পলিটিকাল পজিশনিং বলতে কী বোঝাচ্ছি। ধরো যে, আমরা মনে করি পরিবার হচ্ছে সুখের নীড়, এ রকম বলে না? এই ঘরবাড়ি সবই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই না। আমরা বলি—পরিবার একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এটা কি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না? আসলে, পরিবার একটা মেজর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিমালিকানা জড়িত, দাম্পত্য জীবন জড়িত, জেন্ডারবোধ জড়িত, সোসাইটির স্ট্রাকচার জড়িত; পরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক যে শাসন-নিপীড়ন-শোষণ এই সবকিছু জড়িত। পরিবার না থাকলে রাষ্ট্র থাকে না, এটা তো সিম্পল কথা। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ হলো পরিবার। তাহলে রাষ্ট্র কি একটা পলিটিকাল ইন্সটিটিউশন, না সোশ্যাল ইন্সটিটিউশন? রাষ্ট্র নির্মাণের দুইটা আর্গুমেন্ট আছে। একটা আর্গুমেন্ট হচ্ছে, সমাজে নানান রকমের বিশৃঙ্খলা, ওমুক-তমুক ছিলো, হবস্-এর যে থিওরি, সেখান থেকে শৃঙ্খলা আনতে, শান্তি ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। আরেকটা হচ্ছে, সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র একটা শোষণকারী, মানুষকে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আগ্রাসন ঘটিয়েছে। রাষ্ট্র ধরো, যখন ব্রিটিশরা আমাদেরকে শাসন করছে, তখনো রাষ্ট্র আমাদের শরীরের ভিতর ঢুকে পড়ে নাই, আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে নাই। রাষ্ট্র ও সমাজ অনেক আলাদা ছিলো। কিন্তু এখন আমার দেশপ্রেম থেকে শুরু করে ভোটার আইডি, আরো কতো কিছু মিলে, আমার প্রতিদিনের নৈমিত্তিক জীবনে, আমার ঘরের মধ্যে রাষ্ট্র ঢুকে যাচ্ছে।
তো, রাষ্ট্র প্রতিটি সমাজের মধ্যে বিস্তৃত হয়। বোঝা যাচ্ছে কি? তো এই রকম করেই আমার মনে হয়, ফিল্মের যে পলিটিকাল পজিশনিং, সেই পজিশনিং যদি প্রবলেমেটিক মনে হয়, এই পলিটিকাল পজিশনিং কী বলতে চাচ্ছে, কেনো বলতে চাচ্ছে, কী তৈরি করছে, কী কন্সট্রাক্ট করছে, কী ধরনের ভ্যালু কন্সট্রাক্ট করছে, কী ধরনের পার্সপেক্টিভে কাজ করছে—সেটা আমার পলিটিকাল পজিশনিং থেকে দেখার জায়গা থাকবে। আমি বলছি, ক্রিটিকদের পজিশন খুবই ইম্পোর্টেন্ট পলিটিকাল পজিশনিং।
যে প্রোডিউসার, যে ফিল্মমেকার, সে একটা পজিশনের অথরাইজড ভাষা প্রদান করতেছে, একটা পজিশনের অথরিটি ক্লেইম করতেছে। যে অথরিটিকে আমি কাউন্টার করতেছি; কাউন্টার লেখা হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের মতো, নাশকতা তৈরি করা অত্যন্ত ইম্পোর্টেন্ট একটা কাজ; যেটা মেইনস্ট্রিম জার্নালিজমের অনেক রিপোর্টার মাঝে মধ্যে করে। আমি করি মাঝে মাঝে বা আমরা যেটা করি, লেখার মাধ্যমে। যেমন—আমাদের অ্যাকাডেমিয়াতেও আমরা নাশকতা তৈরি করি; তোমরা বলো সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের দর্পণ; আমি বলি সেই দর্পণে সবার মুখ দেখা যায় না—এ রকম টাইপের। এ রকম নাশকতা ঘটানো, তাহলে সমাজের দর্পণ বলতে আমরা কোন্ সমাজের কথা বলছি? তাহলে এই যে পজিশনটা, বক্তব্যটা, স্টেটমেন্টটা, এটা সমাজে ভীষণ পলিটিকাল ইফেক্ট ফেলতেছে।
তাহ্সিন আহমেদ : স্যার, আমার প্রশ্নটা হলো একটা ফিল্মকে দেখার তো বিভিন্ন ডাইমেনশন থাকে আপনি বলেছেন। তা না হলে, একটা ফিল্মকে কখনোই বোঝা সম্ভব না। তো এখানে মার্কসিজম, সাইকো-অ্যানালিসিস থিওরি, পোস্ট-মডার্নিটি বিভিন্ন দিক থাকে। যখন আমি একটা সমালোচনা করবো, তখন কোন্ বিষয়গুলো আমার মাথায় থাকবে; কোন্ কোন্ ডাইমেনশন থেকে আমি আলোচনা করবো এটা সিলেক্ট করবো কীভাবে?
আ-আল মামুন : আচ্ছা, আসলে আমরা সিলেক্ট করি কীভাবে? আমি যখন ঘর থেকে বের হই, তখন কীভাবে সিলেক্ট করি কোন্ রাস্তায় যাবো? এটা সিম্পল কথা, আমি কোন্ পদ্ধতি ব্যবহার করবো, কোন্ পথে হাঁটবো সেটাই ইম্পোর্টেন্ট। আমি আসলে চাঁদে নৌকায় যাবো নাকি প্লেনে যাবো, তাই না? আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা হাতে বেরুবো নাকি ছাতা ছাড়া বেরুবো। পরিস্থিতিই বলবে আমি ছাতা নেবো কি না—মেঘ হলে নেবো, নইলে নয়! একটা মজার বই পড়েছিলাম, পলিটিক্স অব দ্য ট্রুথ, তো লেখক বলছিলো সে কীভাবে লেখে, সে কী পদ্ধতি ব্যবহার করে। আসলেই, কোনো পদ্ধতি নাই কিংবা বলা যায়, পরিস্থিতি এবং বিষয়বস্তুই বলে দেয় কী পদ্ধতি দরকার।
আমি যা করতে যাচ্ছি তার পথ আমাকেই খুঁজতে হবে। যখন আমি মনের মানুষ অ্যানালিসিস করতে যাই, সেটা একটা হিস্টোরিকাল অ্যানালিসিস। নেশন ও তার হিস্ট্রি অ্যানালিসিস করার দরকার পড়ে। ওখানে শব্দের হিস্ট্রির কথা আছে। যদিও ওটা খুব ডিটেইলে আলোচনা করিনি—ফকির শব্দটা বাতিল হয়ে যাচ্ছে এবং বাউল শব্দটা ডমিনেন্ট হয়ে উঠতেছে। রবী ঠাকুরের সময় থেকেই বাউল শব্দটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতেছে। আমাদের মন বাউল বাউলময় হয়ে উঠতেছে, তাই না। এখন আমরা বাউল ছাড়া ফকির শব্দটা চিনিই না, কি চিনি? ফকির শব্দটা এখন যারা ভিক্ষা করে তাদের ক্ষেত্রেই কেবল ব্যবহার হয়। কিন্তু বাউল বললে, আমরা সবাই চিনি এবং নিজেরাও বাউল-বাউল ভাব নিয়ে ঘুরি, কথা বলি, লিখি—সবকিছু!
শব্দের হিস্ট্রি কিন্তু ইম্পোর্টেন্ট। শব্দ একটা ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে হারায়ে যাচ্ছে এবং রাইজ করতেছে, তার সাথে একটা জাতি ও জাতিভাবনার যে শিফট্গুলো, সে শিফট্গুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লালনকে বাউল সম্রাট বলার শুরুটা দেখো সেই সময়কার। এখন এই বাউল যে শব্দটা তার হিস্ট্রিকাল অ্যানালিসিস দরকার হচ্ছে। রাষ্ট্রচিন্তা কিংবা ধরো যে সিম্পল একটা বিষয় নিয়ে শেষে অ্যানালিসিস করছিলাম, ওটা আরো ডিটেইলে আলোচনা করার ডিমান্ড করে। সেসময় আমি অনেকদিন পরে ওটা (মনের মানুষ) নিয়ে লিখতে বসেছিলাম, তাগাদাও ছিলো ওর (মামুন হায়দার)। তাছাড়া, শেষের দিকে সব মিলে আমার ভালো লাগছিলো না। আমি কম্ফোর্ট ফিল করছিলাম না। লেখা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছিলো তখন। কারণ অনেকদিন লেখার প্র্যাকটিস নাই। তাই অনেকগুলো ডাইমেনশন বাদ পড়ে গেছে ওটাতে।
যদি আমি কোনোদিন বই করি, তখন আমি ওটা অ্যাড্রেস করবো। শেষে আমি দেখতেছি, ‘মিলন হবে কতো দিনে/আমার মনের মানুষেরই সনে’ গানটা গাচ্ছে। সেই গানটা গাচ্ছে কোথায়, গগন হরকরার বাড়িতে। গগন হরকরা যে গানটা লিখছিলো, ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষেরে’, তাই না। এইখান থেকে ভাবো কতো জায়গায়, কতো ইন্টারটেক্সুয়াল ব্যাপারটা, কতোগুলো টেক্সট। এইখান থেকে রবী ঠাকুর একটা গান লিখেছিলো, ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।’ রবী ঠাকুরের এই গানটা আমাদের দেশের ন্যাশনাল অ্যান্থেম। এবং এই গানটা কখন লেখা হয়েছিলো সেটাও খুব ইম্পোর্টেন্ট।
১৯০৫ সালে যখন বাংলাকে দুই ভাগ করা হলো এই ভাগটাকে মানেননি রবী ঠাকুর, তখন এই গানটা লেখেন। রবী ঠাকুর একটা পিটিশনে সাইন করেছিলো ৪০ সালের দিকে। সেই পিটিশনে ব্রিটিশদের কাছে তারা বলতেছিলো, যে পপুলার ডেমোক্রেসি চালু করলো ব্রিটিশ সরকার, সেটা ঠিক হয় নাই। কারণ মুসলমানরা কালচারড না, তারা শিক্ষিত না, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ না। কিন্তু হিন্দুরা কালচারড, শিক্ষিত, তাই তাদের সোসাইটিতে ডমিনেন্ট পজিশনে, প্রিভিলেজড পজিশনে থাকা দরকার এবং বাংলা এক থাকা দরকার। তো বাংলা এক থাকা কোশ্চেনের মধ্যে তাহলে অনেক রকমের ডেলিকেসি আছে, সম্ভাবনা আছে। মনের মানুষ-এ এই গানটা যখন গাওয়া হয় ‘মিলন হবে কতো দিনে/আমার মনের মানুষেরই সনে’—এই মনের মানুষের সঙ্গে মিলন হবে কতো দিনে, এই যে মিলনের কথা বলতেছে, তখন আবার যদি কান পাতো, ভোর বেলার দৃশ্যটা, তো শুনতে পাবে একটা আযানের শব্দ আসতেছে। কার সঙ্গে এই মিলনের গল্প, আযান যে দিচ্ছে তার সঙ্গে? তার সঙ্গে কী ধরনের মিলন হবে তাহলে? হিন্দুর জন্য সুপিরিওর প্রিভিলেজ পজিশন রাখতে হবে, যদিও তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ। যেহেতু সে কালচারড, সো কল্ড শিক্ষিত, সেহেতু তার ডমিনেন্ট পজিশন থাকা দরকার বাংলায়। কিন্তু ওদেরকেও দেখভাল করে রাখতে হবে, যেহেতু মুসলমানরা আমাদের ভাই।
ধরো আমার বাড়িতে যে কাজ করে, তাকে আমি জিজ্ঞেস করি, এই তুই খেয়েছিস তো, তোর বাড়িতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে? পজিশনটা অনেকটা এই রকম। মুসলমানদের জন্য এই পজিশনটা, বোঝা গেলো? তো এই দৃশ্যটি যদি আমি শুধু দেখি, সেখানে কতো কিছু, হিস্ট্রিকাল নলেজ, পলিটিকাল নলেজ, জাতিসত্তার প্রশ্ন এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন কীভাবে ফিট করে, মানে আমাদের লিটারেচার, আমাদের হিস্ট্রি, এক একটা ডিসিপ্লিন কিংবা পলিটিকাল থিওরি যে কিলিং পরিস্থিতি তৈরি করে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে অবজারভেশন, এক্সপেরিয়েন্স এবং আরো অনেক কিছুই ফিল্ম অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে দরকার হয়। ইমেজ, সাউন্ড এখানে বিশ্লেষণে কিন্তু এসেছে। খুবই ধীরে একটা আযানের শব্দ আসছে ভোরবেলা, গান হচ্ছে নদীর পাড়ে। এই আযানের শব্দটা হয়তো আমাদের বেশিরভাগ ফিল্ম ক্রিটিকদের কানেই ঢুকবে না। যেহেতু আমি ফিল্মটা নিয়ে কাজ করেছি, আমার মনে হয়েছে, মিলন হবে কতো দিনে বলে গানটা কেনো এখানে গাওয়া হচ্ছে? কেনো মিলন নিয়ে এই গানটা এখানে গাওয়া হচ্ছে, অন্যকিছুও তো গাওয়া যেতো। ‘মনের মানুষ’ ও ‘মিলন হবে কতো দিনে’ গাওয়া হচ্ছে এবং গাচ্ছে কিন্তু গগন হরকরার সঙ্গে। লালন আসতেছে রবী ঠাকুরের বাড়ি থেকে এবং এসে রাত কাটাচ্ছে গগন হরকরার বাড়িতে। সবকিছু মিলে আমি ওখানে কান পাতছি ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর আমি ওখানে ঠিকই আযানের শব্দ পাচ্ছি। যাই হোক, আর কোনো প্রশ্ন?
মেহেরুল ইসলাম : স্যার, আমরা সবাই জানি চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি শিল্পমাধ্যম। এর সঙ্গে সাহিত্যসহ অনেক কিছু জড়িত। যখন এটাকে শিল্পমাধ্যম বলছি, আমার মনে হয় তখন এটার সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের একটা বিষয় জড়িয়ে আছে। আমরা যদি হুমায়ূন আহমেদ, তারেক মাসুদ বা আরো চলচ্চিত্রকার যারা আছেন তাদের সিনেমাগুলো দেখি, শিল্পমাধ্যমের সেই বিষয়গুলো আছে। যদি পিছনের দিকে তাকাই ২০০৬, ২০০৭ বা ২০০৮ সালের বেশিরভাগ সিনেমাগুলো বিশেষ করে আলেকজান্ডার বো বা আরো যেসব অভিনেতা-অভিনেত্রী আছে, সেই সিনেমাগুলো শুধু মারপিট আর কাটপিসে ভরা ছিলো। সেই অর্থে কি সিনেমাগুলো আদৌ চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পেরেছে? হুমায়ূন আহমেদ বা ঋতুপর্ণ ঘোষ এদের চলচ্চিত্রে যেমন সমাজ পরিবর্তনের বিষয়গুলো এসেছে, সেই অর্থে সেসময়ের চলচ্চিত্রগুলো আদৌ চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পেরেছে কি না?
আ-আল মামুন : আচ্ছা। সমাজ পরিবর্তনের জন্য আমি কোনো অঙ্গীকার করি না বা আমি কোনো পরিবর্তনের কথা বলি না। সমাজ পরিবর্তন হওয়া দরকার বা কী পরিবর্তন হওয়া দরকার—এইটা হলো একধরনের নরমেটিভ ক্লেইম। ফিল্মকে বা অন্যান্য আর্ট ফর্মকে আমি বলবো সমাজের প্রোডাকশন। আর, যেকোনো প্রোডাকশনের দুইটা ডাইমেনশন সবসময় থাকে। বলতেছিলাম যে, শিল্প দুই অর্থেই শিল্প। ফিল্ম যেহেতু মেইনস্ট্রিম জোন, যেখানে একটা হচ্ছে আর্ট, আরেকটা ইন্ডাস্ট্রি। আমরা যারা ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করি, তারা সবাই জানি, ফিল্ম একটা আর্টও বটে এবং সেটা একটা ইন্ডাস্ট্রিও। তো দায়বদ্ধতার প্রশ্ন সেহেতু আমি করি না।
আ-আল মামুন
দায়বদ্ধতার জায়গাটা আরেকভাবে দেখা যেতে পারে, যা আমি এর আগেও বলতেছিলাম যে, লিভিং ইন দ্য প্রেজেন্ট। আগেও আমি উদাহরণ দিয়েছিলাম যে, আমার বাড়িতে দুটা জিনিস আছে। একটা ওয়াশিং মেশিন আর একটা প্রস্তর যুগের পাথর; আমার মনেও সেই দুই রকমই অবস্থা আছে। তো পরিবর্তন করে আমি কোথায় নিয়ে যেতে চাই সমাজকে? এটা খুবই প্রবলেমেটিক কোশ্চেন। আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাই পরিবর্তন করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই জায়গাটা প্রবলেমেটিক হতে পারে অন্য গ্রুপগুলোর কাছে। আসলে পরিবর্তন ঘটে না, আমরা যেটা করি সেটা আসলে একটা স্পেস তৈরি করি। যেমন আমরা একটা প্রোগ্রেসিভ সময়ের ইতিহাসের মধ্যে বসবাস করি। এই যে অনন্ত পৃথিবী, প্রতিনিয়ত এক্সপ্যান্ডিং, চেঞ্জিং, প্রতিনিয়ত রিপ্রোডিউসিং, প্রতিনিয়ত ডায়িং; এই যে প্রতিনিয়ত রিপ্রোডিউসিং, চেঞ্জিং, ডায়িং যে ওয়ার্ল্ড, এই গ্লোবাল রিয়ালিটিকে আমরা কী করছি, একটা ফ্রেমের মধ্যে আনছি—সময়ের ফ্রেম দিয়ে মাপছি এবং তার ভিত্তিতে হিস্ট্রিকে সাজাচ্ছি। এই সবই হচ্ছে সাজনদারি এবং এটা একটা হিস্ট্রিকে নির্মাণ করে।
টাইম ইটসেল্ফ একটা হিস্ট্রি তৈরি করে। টাইম দিয়ে আমরা একটা হিস্ট্রিকে নির্মাণ করি, একটা স্পেস তৈরি করি। টাইমের বাইরে যা, যেটা টেম্পোরাল স্পেসের বাইরে তা আমাদের কাছে পৌরাণিক। এই প্রোগ্রেসিভ টাইমের স্পেসেই রাষ্ট্র তৈরি হয়, সেখানে ক্যাপিটাল অপারেট করে। তাই বলতেছি, এগুলো সবই আমাদের নির্মিত স্পেসের মধ্যে ঘটতে থাকে। এই স্পেসগুলো সবই আমাদের কন্সট্রাকশন। তাই, পরিবর্তনের প্রশ্নগুলো প্রবলেমেটিক হয়ে ওঠে। আর, ওই ফিল্মগুলোর সঙ্গে এই ফিল্মগুলোর পার্থক্য—যদি টেক্সট ধরে আলোচনা করা যায়, তখন কেবল বোঝা যাবে।
যাই হোক, পর্নোগ্রাফি কি ফিল্ম? আর্টের বাউন্ডারি কোনটা? পর্নোগ্রাফি এবং আর্টের বাউন্ডারি কোথায়? আর্ট এবং লিভিং লাইফ-এর বাউন্ডারি কোথায়? একটা লিভিং লাইফও একটা আর্ট হয়ে উঠতে পারে। ধরো, চে একটা আর্ট পিচ হয়ে গেলো, চে একটা জীবন্ত মানুষ, মরে গেলো আর প্রোডাক্ট হয়ে গেলো। তাহলে আর্টের বাউন্ডারি কিংবা পর্নোগ্রাফির বাউন্ডারি, এই যে ভিজ্যুয়ালিটির বহুমাত্রিক এক্সপ্রেশন সমাজে তার পজিশন কী হবে? পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি মেইনস্ট্রিম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে বেশি উপার্জন করে, বেশি মানুষকে নিয়োগ দেয় এবং বেশি মানুষ এটার সঙ্গে যুক্ত। এখন ইন্ডিয়াতে এক পর্নো স্টার সানি লিওনের কথা খুব শোনা যায়। সে এখন হিন্দি ফিল্মে অভিনয় করে, পর্নোগ্রাফিতে সে এখনো অভিনয় করে কি না আমি জানি না—সেরকম কোনো লেখা আমি পড়িনি। তাহলে, ব্যক্তি বা পণ্য সবকিছুরই বহুমাত্রিক পজিশন থাকা সম্ভব। আর এই প্রশ্নগুলো আসলে নির্ভর করে, যে পরিস্থিতিতে, যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তার ওপরে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফির যে দৃশ্যগুলো কাটপিস হিসেবে এসেছে সেগুলোকে পর্নোগ্রাফি বলা যায় কি না, কিংবা একটা প্রোডাকশন বলা যায় কি না, নানাধরনের প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন করা সম্ভব।
মাহমুদ আপেল : স্যার, আমার প্রশ্নটা হলো সমালোচনা নিয়ে। সমালোচনার যে অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের সমাজে যেটাকে সবাই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। একই ভুল দেখি, যারা ফিল্ম সমালোচনা করে তাদের ক্ষেত্রেও। ক্রিটিক যারা আছেন, তারা যে ভুলটা করেন, ফিল্মটাকে তারা ভালো এবং মন্দ এই দুইটা মানদণ্ড বিচার করতে গিয়েই যতো সমস্যা করেন। কিন্তু ভালো-মন্দের এই দুইটা দিক না খুঁজে, ফিল্মটাকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের এটাই করা উচিত নয় কি? অনেক সিনিয়র সাংবাদিকদের দেখি, যারা পরিচালকের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে ফিল্ম নিয়ে প্রচারণা বা ফিল্ম নিয়ে সমালোচনা করে। কিন্তু এসব কিছু বাদ দিয়ে শুধু ফিল্মের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করাটাই উচিত নয় কি সব সমালোচকের?
আ-আল মামুন : না, না। দুটোই তো প্রবলেমেটিক। কোনো কিছু না পড়ে, একজনার ভ্যালু জাজমেন্ট যেটা, সেই ভ্যালু জাজমেন্টে মুশকিল আছে। আমি যেটা করি, আমার পজিশন বা ক্রিটিকের পলিটিকাল পজিশন পরিষ্কার করেই করি। সেই পজিশনটা তাহলে জাস্টিফাই করা, তার পজিশন নিয়ে আর্গুমেন্ট রেডি করা, অনেক কিছু ইম্পোর্টেন্ট। এই যে ভালো বললাম আর মন্দ বললাম, সাদা আর কালো। এই ভালো-মন্দের প্রশ্ন আসলে প্রশ্ন না। ভালো-মন্দ বলাটার সঙ্গে কখনোই আমি থাকি না—আমি দেখতে চাই যে, এই ডিপ্লয়মেন্টের মানে কী? কোনো কিছু ভালো, এটা শ্লীল এবং এটা অশ্লীল—এতে আমার কোনো কিছু যায় আসে না। এটা আসলে ইম্পোর্টেন্ট কোশ্চেন না; কারণ তাহলে আমরা একটা ভ্যালু জাজমেন্টের জায়গায় চলে যাচ্ছি। যেটাকে আমি অশ্লীল বলতেছি, সেটা অন্য কারো কাছে শ্লীল হতে পারে; কিংবা হতে পারে অন্য সমাজের জন্য।
ফিল্মে ধরো, নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনের দৃশ্য কিংবা নারী-পুরুষের ন্যুড দৃশ্য, এইগুলোকে আমরা অনেক বেশি অশ্লীল বলি। কিন্তু ধরো যদি গ্লোবাল অডিয়েন্সের কথা ভাবি, অন্য কোনো দেশের মানুষ এটাকে কি অশ্লীল বলবে? ওখানে প্রতিনিয়ত মানুষ দেখতেছে, সি-বিচে মানুষ ন্যুড হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ন্যুডদের বিশাল বিশাল এলাকা আছে, যেটা ন্যুড কালচার, হিপ্পি কালচারের অনেক রকম এক্সপেরিমেন্ট আছে। সেখানে দেখবে যে তারা পোশাক ছাড়াই আছে। রাস্তায় কার্নিভাল হচ্ছে, ন্যুডদের কার্নিভাল। হোমোসেক্সুয়াল যারা আছে; ধরো আমি আর তুমি হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি, আমাদের এখানে এটা কোনো ধরনের কোশ্চেন তুলবে না। দুজনের কী বন্ধুত্ব, এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, তাই না? কিন্তু অন্য দেশে যদি এটা হতো, তাহলে তারা বিশেষভাবেই ধরে নেবে যে আমরা দুজন হচ্ছি একটা গে কাপল (হাসি)। তাহলে, এগুলো হলো নর্মেটিভ জাজমেন্ট। এ ধরনের জাজমেন্টে যাওয়া আমি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করি।
এছাড়া যেমন ধরো, গে’দের আলাদা পোশাক আছে। কিন্তু, আমাদের কালচারে এখনো পোশাক জেন্ডার ডিটারমাইনিং হয়ে ওঠেনি ওই অর্থে। কিন্তু ইউরোপে গে কালচার একধরনের পোশাককে পপুলার করেছে; গে এবং লেসবিয়ান কালচার। কোনো বিশেষ ধরনের পোশাক যারা পরে বা ওই রঙের পোশাক যারা পরে, ভাবা হয় তারা এ রকমের, মানে অন্যরা ধরে নেয়। আমাদের এখানে আমি যদি ওই ধরনের পোশাক পরে হেঁটে যাই, কেউ ভাববে না আমি গে। কারণ এখানে ওই পোশাককে গে সাইন হিসেবে দেখা, একটা নির্দিষ্ট পিপলের সাইন হিসেবে দেখার কালচার নাই। তাই ন্যুডিটি, শ্লীলতা, অশ্লীলতা এগুলো হচ্ছে খুবই আপেক্ষিক এবং প্রবলেমেটিক। সময়ের সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে এগুলোর মানে বদলায়, ডিপ্লয়মেন্ট বদলায়; এই হলো যে পরিস্থিতি।
মামুন হায়দার : ধন্যবাদ আসলে স্যারকে।
আ-আল মামুন : আমারও যেতে হবে। আচ্ছা আমি কি এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যোগ্য মানুষ, তোমরা যে এতো প্রশ্ন করতেছো তোমাদের ইচ্ছেটা কী বলোতো!
আখতারুজ্জামান টিটন : স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমরা কয়েক বছর আগে যে ছবিগুলো দেখেছি, যেমন—শ্যামল ছায়া, মাটির ময়না, রানওয়ে—কিছুদিন আগে মানে তারেক মাসুদ প্রয়াত হওয়ার আগে যেটা তিনি এখানে প্রদর্শন করে গেছেন। সেখানে দেখেছি, মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মিডিয়া কিন্তু বলেনি যে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসলো বা এ রকম কিছু একটা। কিন্তু বর্তমানে ২০১৩-তে এসে পোড়া মন বা অনন্ত-বর্ষার ছবিগুলো মানুষ দেখছে হলে গিয়ে, উপচেপড়া ভিড়, তখনই মিডিয়ায় রব উঠলো, এই বুঝি চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরে আসলো। যখনই সুদিন ফিরে আসলো, তখনই দেখা যাচ্ছে, তার মানে সুদিনের সঙ্গে একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। ওই ছবিগুলো ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে পারেনি, এটা আমার প্রশ্ন না। যখন এই পোড়ামন বা অনন্ত-বর্ষা অনেক টাকা এনে দিতে পারছেন পরিচালকদের, তখনই মিডিয়া বলছে বা আমরা বলছি চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরে আসছে। তাহলে কি আমরা ওই ছবিগুলোকে চলচ্চিত্র বলবো না, আর যখনই ব্যবসাসফল বা কাড়ি কাড়ি টাকা এনে দিতে পারবে, কেবল তখনই তাকে চলচ্চিত্র বলবো?
আ-আল মামুন : এটা তো ওই একই কোশ্চেন, চলচ্চিত্র আর্ট নাকি ইন্ডাস্ট্রি। এটা শুধু পয়সা কামানোর যন্ত্র নাকি এটা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ যন্ত্র, এ রকম অনেক কথা আসতে পারে। তো এই প্রশ্নগুলো অবান্তর কোশ্চেন। একটা গল্প বলা, ধরো যে আমি যখন একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ি, কবিতা পড়ি, আমি কী চাই? কিংবা ধরো যে, মানুষ সক্রেটিসের সময়ও নাটক দেখতে গেছে, চাইছে ক্যাথারসিস ঘটে কি না। তাহলে আমি দেখছি, যখন একটা শিল্প ফর্ম বা শিল্প উপাদানকে চাই—সেটা দেখবো বা সেটাতে পার্টিসিপেট করবো, তখন আমি সেখানে চলে যাই। কিন্তু কেনো যাই? আমি ওখানে একটা গল্প চাই। আমি সেটাতে কিছু একটা ভিন্নতা দেখতে চাই। শুধু ইনফরমেশন না বা শুধু ওরকম কিছু না। আমি চাই, সেখানে একটা গল্প থাক এবং গল্পটার একটা বিষয় থাক। কারণ আমি মনে করি, আমি গল্পের বাইরে আছি। এ পৃথিবীর কন্সট্রাকশন এবং সেটার একটা গল্প, সায়েন্স বলো রিলিজিয়ন বলো আর যাই বলো। তো এই গল্প ফিল্ম মাধ্যমে কীভাবে আসে। যাই হোক, এই যে ফিল্ম, এর একটা সহজ বাংলা আছে, চলমান চিত্র, তাই না। যে চিত্র চলতেছে, এখন অবশ্য ফিল্ম শব্দটার এখন দরকার নাই, কেননা এখন ফিল্ম শব্দটাও একটা সমস্যার তৈরি করছে। অভ্যাসের বসে আমরা বলছি হয়তো কিন্তু এখন আর ফিল্ম শব্দটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এখন সবই ডিজিটালি তৈরি হচ্ছে। এখন তাহলে যে চিত্রটা চলমান সেটাই তো চলচ্চিত্র। তা পাঁচ মিনিট হতে পারে, ৫০ মিনিট হতে পারে, ১০০ মিনিট হতে পারে, ২০০ মিনিট হতে পারে বা আরো হাজার মিনিট হতে পারে। তো সেই দুই মিনিট থেকে হাজার মিনিট সবই চলচ্চিত্র, তাই না। সেখানে আমি গল্প বলছি কি না সেটাই গুরুত্বপূর্ণ; এইটা হলো ইম্পোর্টেন্ট।
আর, যে রিপোর্টার চলচ্চিত্র নিয়ে এমন বলছে কিংবা যে ক্রিটিক করছে, আমি বলছি যে তার একটা পলিটিকাল পজিশন থাকে। সামটাইমস সেই পজিশনগুলো ক্রিটিসিজম ডিমান্ড করে। রিপোর্টাররা যে জাজমেন্টগুলো লিখছে, রিভিউয়াররা যে মূল্যায়নগুলো করছে, সে মূল্যায়নগুলোই অনেক সময় মূল্যায়নের বিষয়বস্তু বলে গণ্য হতে পারে আমার কাছে। যে মূল্যায়নগুলো আমি মূল্যায়ন করিও মাঝে মাঝে। যেমন মনের মানুষ নিয়েও করেছিলাম; মনের মানুষ নিয়ে না চন্দ্রকথা নিয়ে করেছিলাম যে, ‘প্রথম আলো’ কীভাবে সেসময়ে ক্যাম্পেইন করতো চন্দ্রকথার পক্ষে; সেটা আমি একটু আলোচনা করেছিলাম। তাহলে ফিল্ম রিভিউ কিংবা রিপোর্টিং এটাও ফিল্ম অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের দাবিদার হয়ে ওঠে, কখনো কখনো। ঠিক আছে?
মামুন হায়দার : স্যারকে ধন্যবাদ। আসলে অনেকদিন আগে থেকেই স্যারের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো আমার, এ রকম একটা আলোচনার জন্য। আমি মনে করি, যারা ফিল্ম নিয়ে কাজ করছে বা করতে চায় তাদের জন্য এই আলোচনাটা গুরত্বপূর্ণ হবে, আমরা এই আলোচনাটা ছাপবো ম্যাজিক লণ্ঠন-এ। কথা অনেক হয়ে গেলো। স্যার যদি শেষ কিছু কথা বলে শেষ করে দেন; একেবারে শেষ যদি কোনো কথা থাকে আপনার।
আ-আল মামুন : আমি শেষ কথাও কিছু ভাবি নাই আসলে। শুরু আর শেষের প্রশ্নটা হচ্ছে, প্রাক-নির্দেশনার প্রশ্ন। আমি মনে করি, ফিল্ম দেখা এবং সে ফিল্মের যে অসংখ্য পসিবিলিটি, সেই জায়গা দেখাটা জরুরি। আমি একটা ছবি যখন দেখছি বা পোর্ট্রেট যখন দেখছি, একেকজন একেক রকম করে দেখছি। আমি যতো বেশি প্রস্তুত হয়ে উঠবো, তখন ওই স্থির ফিল্ম বা ইমেজটাকে অসংখ্য ডাইমেনশন থেকে দেখবো বা অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে দেখবো। যেমন ধরো, একজন স্থপতি যদি তোমাকে দেখে, সে কী দেখে, তোমার বডি দেখে, তোমার শরীর দেখে। এই শরীর দেখাটা যৌন তাড়না বলবো না, যৌন পার্ভার্সনের সঙ্গে তুল্য না; তাই এই শরীর দেখাটা, নারীর শরীর দেখা, সেটা হচ্ছে একটা আর্ট থিম তৈরি করার জন্য। তো আমার কাছে একজনের দেখাটা মনে হচ্ছে শুধুই এনজয়মেন্ট, খুব মজা লাগছে ফিল্মটা। আরেকজন দেখে সেই মজার মানে কী, সেই প্রশ্নটা করতেও শেখা। সবকিছুই এই মানের প্রশ্ন। যে মিনিংটা সে তৈরি করে এবং সেটা খুবই ধোঁয়ার মধ্যে থাকে এবং আমাদের আনকন্সাসে কাজ করে। তো এই মিনিং যা আমাদের আনকন্সাস ক্যাটাগরিতে কাজ করে, এই মিনিং বা মাল্টিপল লেয়ারস অব মিনিং সেই লেয়ারগুলো অনুসন্ধান করতে জানা। যে আনকন্সাস, তার রিলেশনগুলোকে জানা, যে ভিত্তি বা যে রিয়ালিটি সে কন্সট্রাক্ট করে বা প্রোডিউস করে, সেটা জানার ও দেখার চোখগুলো তৈরি করা খুব জরুরি।
আমার সঙ্গে দেখা হবে না হয়তো অনেক দিন তোমাদের, আর এ রকম সুযোগ হবে না হয়তো অনেক দিন। এখানে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো, কারণ সবাই আগ্রহী। আবার এটাও ঠিক, তোমাদের কিছুটা প্রস্তুতি আছে, যারা ফিল্ম নিয়ে আগ্রহী তাদের। আমাদের কোর্সগুলোতে যেটা হয় আর কি, বেশিরভাগই আগ্রহী থাকে না, ফলে মুশকিল হয়। আগ্রহীদের সঙ্গে কথা বলাটা এন্টারটেইন করে, আনন্দিত করে। এই সবগুলোই আমি আজ পেয়েছি, তোমাদের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখা যায়, যেমন আমি কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম বাংলা বিভাগে কথা বলতে। আমি আজকে আধা ঘণ্টা কষ্ট করে সাইকেল চালিয়ে আসছি এখানে। উপশহর থেকে সাইকেল চালিয়ে আসছি এবং সাইকেল চালিয়েই যাবো। কিন্তু সেদিন আমাকে সামাদী স্যার (বাংলা বিভাগের প্রফেসর সফিকুন্নবী সামাদী) গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। পরিস্থিতি হচ্ছে এই—তার পরও ওটা আমার জন্য খুব একটা আনন্দের বিষয় ছিলো না।
এখন যেমন কথা বলছি এবং তোমরা যেমন আমার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত এবং আগ্রহী, তখন কথা বলার অনেক কিছু পেয়ে গেছি। সেদিন আমি বোধহয় ২২ মিনিট কথা বলেছিলাম, আর উৎসাহ পাইনি। কিন্তু আজকে আনলিমিটেড একটা পরিস্থিতিতে কথা বলতে পারছি। শুধু ফিল্ম না তার সঙ্গে আরো অনেক কিছু আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, আমাদের জীবন বা আরো অনেক কিছু। অনেক আনন্দদায়ক একটা মুহূর্ত তোমাদের সঙ্গে কাটালাম। তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, আর যোগাযোগ রাইখো (সবার হাততালি)।
আ-আল মামুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান। সংস্কৃতি ও যোগাযোগ বিষয়ক পত্রিকা ‘যোগাযোগ’ এর সম্পাদক। বর্তমানে পিএইচডি ফেলো, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা।
almamu.ru@gmail.com
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন