মো. খালিদ হাসান
প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
কান, চলচ্চিত্রের মানুষদের তীর্থস্থান
মো. খালিদ হাসান

১৫০ বছর আগে জেলেদের মাছ ধরার এক আদর্শ জায়গা ছিলো এই গ্রাম। ১৯ শতকের মাঝামাঝি এক বৃটিশ পরিবার চিন্তা করলো ভূ-মধ্যসাগরের তীর ঘেঁষা এই জায়গাটি পর্যটন শিল্পের আদর্শ নগরে পরিণত হতে পারে। যেই কথা সেই কাজ, জেলেদের প্রিয় জায়গায় গড়ে উঠতে থাকলো পরিবেশবান্ধব এক নগরী, এখন অবশ্য তিলোত্তমা। স্বপ্নময় শহরে পাখিদের কোলাহল, নীল আকাশ আর পানি, সবমিলিয়ে কী এক মনোরম পরিবেশ! বলছিলাম দক্ষিণ ফ্রান্সের কান শহরের কথা; পর্যটনের পাশাপাশি ছোটো এই শহর এখন হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রের মানুষদের এক তীর্থস্থান।
সারা বছর পর্যটকের অভাব না হলেও প্রতিবছর বিশেষ একটি মাসে কান মুখরিত হয়ে ওঠে হাজারো তারকাদের আনাগোনায়। উদ্দেশ্য একটাই, চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মেলবন্ধন, প্রতিভার মূল্যায়ন আর সঙ্গে খানিকটা ব্যবসা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মে মাসেই অবশ্য বসছে তারকাদের এ মেলা। বিপুল পরিমাণ দর্শক-তারকা ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে কান ছাড়িয়ে এর গুঞ্জন, হইহই-রইরই অবস্থা ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। যে কান নিয়ে এতো কানাকানি, তার আদ্যোপান্ত আমরা এবারের লেখায় জেনে নিবো।
ইতিহাসের পাতায় অমলিন কান-এর জাদু
১৯৩২ সাল;ইতিহাস তখন ইতালির ভেনিসের ছাত্র। প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব হিসেবে ভেনিস নিয়ে তখন বেশ মাতামাতি। উৎসবটি বেশ সফলতার সঙ্গে পালনও হচ্ছে,আকাশে-বাতাসে প্রচুর সুনাম। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে উৎসব নিয়ে দেখা দিলো একটা বিশেষ ধরনের সমস্যা;তৎকালীন ফ্যাসিবাদী যে রাষ্ট্রগুলো ছিলো বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি, উৎসবে তাদের ঘরানার চলচ্চিত্রগুলো বেশি প্রাধান্য পেতে শুরু করলো। এমনকি উৎসবের পুরস্কারগুলোও কেনো জানি তাদের ঘরেই যাচ্ছিলো। বিষয়টি বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ করছিলেন ফরাসি ইতিহাসবিদ ফিলিপ অ্যারল্যাঙ্গার (Philipp Erlanger)।১ একই সঙ্গে এ নিয়ে তার মানসিক কষ্টেরও শেষ ছিলো না।
ইতিহাসের মানুষ হলেও চলচ্চিত্রপ্রেমী অ্যারল্যাঙ্গার মূলত একটু অন্য ধরনের উৎসবের স্বপ্ন দেখতেন। যেখানে শিল্পী-শিল্প যথাযথ সম্মান পাবে,সে যে দেশের,ধর্ম-বর্ণের বা মতেরই হোক না কেনো। তার এই স্বপ্নের কথা তিনি পরিচিত দু-চারজনকে জানালেন। একপর্যায়ে তার এই স্বপ্নের সঙ্গী হলেন ফ্রান্সের তৎকালীন শিক্ষাবোর্ডের প্রধান জিয়ান জে (Jean Zay)। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে জিয়ানের বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিলো কি না সেটি যদিও স্পষ্ট নয়,তবুও তিনি অ্যারল্যাঙ্গারের ব্যাপারটি অনুধাবনের চেষ্টা করলেন। জিয়ান এরপর বৃটেন ও আমেরিকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অ্যারল্যাঙ্গারের স্বপ্নের চলচ্চিত্র উৎসব বাস্তবায়নের পথে পা বাড়ালেন। একটু দেরি হলেও অবশ্য তাদের এ-প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি।
তাদের এই চিন্তার কাল ছিলো ১৯৩৯ সাল। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল। সবমিলে ওই বছর সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সে একটি উৎসবের সিদ্ধান্ত হলেও তিন সেপ্টেম্বরেই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। তবে এতে কিন্তু পিছু হটে যাননি উদ্যোক্তারা। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও স্বপ্ন নিয়ে তারা কেবল অপেক্ষায় ছিলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার। তার প্রমাণও পাওয়া যায় ১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ফেস্টিভাল দ্যু ফিল্ম ডি কান’ নামের উৎসবটি আয়োজনের মধ্যে। ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই উৎসবই ছিলো আজকের বিখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসর।
শুরুর বছরেই উৎসবটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রথম উৎসবেই ১৬টি দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন রে মিল্যান্ড এবং মিশেল মরগান।২ আর গ্র্যান্ড প্রিক্স জেতে তিনটি চলচ্চিত্র-রেনে ক্লিমেন্ট-এর দ্য ব্যাটল অব দ্য রেইলস্, ওয়াল্ট ডিজনি ও রবার্ট করম্যাক-এর মেইক মাইন মিউজিক, আলেকজান্দ্র তুসকোর দ্য স্টোন ফ্লাওয়ার।৩ উৎসবে ১৮টি দেশের একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে জুরি বোর্ড গঠন করা হয়। জুরি বোর্ডের প্রধান ছিলেন সোর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জর্জ হুইসম্যান। তিনি বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে উৎসবের মূলনীতি নির্ধারণ করেন। এই জুরি বোর্ডই নির্বাচন করে প্রথম উৎসবের চলচ্চিত্রগুলো। এই হলো কান উৎসবের প্রাক্কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এরপর বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে উৎসবের কাঠামো, নাম, রীতিনীতির পরিবর্তন করা হয়েছে।
শুরম্ন থেকেই কান-এর(দক্ষিণ ফ্রান্স) সমুদ্র উপকূলবর্তী রিভারিয়ায় অনুষ্ঠান করা হয়েছে এই উৎসব। ফেস্টিভাল প্যালেস (Palais des Festivals et des Congrès) নামের যে ভবনটিতে উৎসবের মূল অনুষ্ঠান হয়,তা শুধু উৎসবের জন্যই বিশেষভাবে নির্মিত। শুরুর কয়েক বছর কান উৎসব বছরের নির্ধারিত কোনো সময়ে অনুষ্ঠিত না হলেও ১৯৬৭ সালের পর থেকে প্রতিবছর মে মাসেই তা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
তবে ৫০ এর মাঝামাঝি থেকে ৬০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উৎসবে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়।১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড প্রিক্স অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল (Grand Prix du Festival) নামে যে পুরস্কারটি দেওয়া হতো সেটি পরিবর্তন করে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা হয়।১৯৫৫ সাল থেকে গ্র্যান্ড প্রিক্স অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল পরিবর্তন হয়ে পাম ডি'অর(PALM D'or) নামে পরিচিত হয়;এর নকশাতেও আনা হয় পরিবর্তন। আর এটি সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে কান-এর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার।
এছাড়া ১৯৫৯ ও ১৯৬২-এই দুই বছরে যুগান্তকারী দুটি বিষয় যোগ হয় উৎসবে। বিভিন্ন পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য যেমন বাজার থাকে,তেমনি সারা বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্র ক্রয়-বিক্রয়ের জন্যেও একটি বাজার হতে পারে-এমন ধারণা থেকে ১৯৫৯ সালে শুরু হয় ‘মার্চে দ্যু ফিল্ম’ (Marche du Film) নামের চলচ্চিত্রবাজার। এর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র-শিল্পের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তারা সহজেই চলচ্চিত্র বিনিময় করতে পারে। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্রের মান নির্ধারণ,সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ-সর্বোপরি চলচ্চিত্রের সমালোচনায় ‘ক্রিটিকস্ উইক’ বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। এটি গঠন করে ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক সমিতি। যার মূল লক্ষ্য ছিলো বিভিন্ন দেশের পরিচালকদের নির্মিত প্রথম ও দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সবার কাছে তুলে ধরা এবং নতুন প্রতিভা আবিষ্কার। এর দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে পাম পুরস্কার নিয়ে কপিরাইটজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এটিকে আবার গ্র্যান্ড প্রিক্স-এ ফেরত আনা হয়।তবে ১৯৭৫-এ ঝামেলা মিটে গেলে তা পাম ডি’অর নামেই প্রচলিত হয়।
১৯৬৮ সাল,প্যারিসে ছাত্র-শ্রমিক প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছে,আর কান-এ চলছে ২১তম চলচ্চিত্র উৎসব। জ্যঁ লুক গদার আর ফ্রাঁসোয়া ক্রফোর নেতৃত্বে একদল তরুণ নির্মাতা স্টেজের পর্দা ধরে ঝুলে পড়ে মাঝপথে উৎসব বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভ-বিপ্লবে উৎসব দুই ভাগ হয়ে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ থেকে কান-এ শুরু হয় দুটো উৎসব। প্রচলিত উৎসবের পাশাপাশি বিশিষ্ট পরিচালকদের উদ্যোগে ‘নির্মাতাদের উৎসব,নির্মাতাদের জন্য উৎসব’,‘ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট’ ইত্যাদি ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করে আলাদা এক ধারা।৪ সময়ের ডানায় ভর করে সেটিই আজকের কান উৎসবের একটা অত্যন্ত সম্মানজনক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
১৯৭২ সালে উৎসবের প্রেসিডেন্ট ও সাংগঠনিক নির্দেশক পদে নির্বাচিত হন রবার্ট ফ্যাভরি ও ম্যাউরিস বেসি। তারা দায়িত্বে এসেই উৎসবের চলচ্চিত্র নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন আনেন। আগে যেখানে বিভিন্ন দেশ নিজস্ব উদ্যোগে কান-এ প্রদর্শনের জন্য চলচ্চিত্র নির্বাচন করতো;সেখানে ফ্যাভরিরা দুটি কমিটি গঠন করেন। এর মধ্যে একটির দায়িত্ব ফ্রান্সের চলচ্চিত্র নির্বাচন এবং অন্যটি বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চলচ্চিত্রগুলো নির্বাচন করতো। ১৯৭৮ সালে উৎসবে যোগ হয় ক্যামেরা ডি অ’র (Caméra d'Or) নামের আরেকটি পুরস্কার। কোনো পরিচালকের প্রথম কাহিনীচিত্রের জন্য এ পুরস্কারটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ পুরস্কারটি পুরোপুরি নতুন পরিচালকদের জন্য।
দিনদিন উৎসবে মানুষের ঢল বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে এর জনপ্রিয়তা। দর্শকদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় স্বভাবতই উৎসবের পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। ফলে ১৯৮২ সালে একটি নতুন ভবন উৎসবের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।অবশ্য এতেও কাজ হয়নি,১৯৯৯ সালে উৎসব ভেন্যুতে যোগ করা হয় আরো ১০ হাজার বর্গমিটার। বর্তমানে এখানে শুধু ২৫ হাজার বর্গমিটার আছে কেবল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য,এর মধ্যে রয়েছে ১৮টি মিলনায়তন।৫ এখানে একটি তথ্য না দিলেই নয়,আজকের দিনের এতো জমজমাট কান উৎসব শুধু বাজেটের অভাবে বন্ধ ছিলো ১৯৪৮ ও ১৯৫০-এ।
কান উৎসব সংক্রান্ত আরেকটি তথ্য না দিলে অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে,সেটা হলো ‘রেড কার্পে’।এই রেড কার্পেটে হেঁটেই উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের মূল আয়োজনে ঢুকতে হয়। এই রেড কার্পেটের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই কিলোমিটার। রেড কার্পেটের ‘রেড’ ধরে রাখার জন্য উৎসব কর্তৃপক্ষ দিনে তিনবার করে এটি পরিবর্তন করে।
কতো রঙ,কতো ফুল ফোটে শাখায় শাখায়
সময়টা বছরের মাঝামাঝি; মে মাস। ফ্রান্সের আকাশে তখন ঝলমলে রোদ আর রাতে আলোকিত চারিদিক। বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার, মেলা, প্রদর্শনী আর নানা রঙের পসরায় কান হয়ে ওঠে স্বর্গপুরী। উৎসবের আয়োজন চলে মূলত চার ভাগে-প্রতিযোগিতামূলক বাছাই, অপ্রতিযোগিতামূলক বিভাগ, ডিরেক্টরস্ ফোর্টনাইট ও ক্রিটিকস্ উইক।
প্রতিযোগিতামূলক বাছাইয়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে স্বর্ণপাম (Palme d'Or) পুরস্কারটি। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০টি চলচ্চিত্র পুরস্কারটির জন্য প্রতিযোগিতা করে। নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো থিয়েটার লুমিয়ের (Théâtre Lumière) এ প্রদর্শন করা হয়।আগেই বলেছি, এটি উৎসবের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। নয়জন বিচারকের একটি প্যানেল সর্বশ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রের পরিচালককে এর জন্য মনোনীত করেন। পুরস্কারটির বর্তমান যে নকশা,তাতে রয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনা। পাশাপাশি সেরা অভিনেতার জন্য রয়েছে প্রিক্স ডি’ইন্টারপ্রিটেশন ম্যাসকুলিন (Prix d'interprétation masculine) ও অভিনেত্রীর জন্য প্রিক্স ডি’ইন্টারপ্রিটেশন ফেমিনিন (Prix d'interprétation féminine) পুরস্কার।
আর চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ‘সিনেফাউন্ডেশন’ (La Cinéfondation) নামে একটি বিভাগ। সারা বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র স্কুল থেকে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী তাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য এখানে আবেদন করেন। এর ভিতর থেকে নির্বাচিত ১৫-২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য,মিডিয়াম দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র সেল বুনুয়েল (Salle Buñuel) প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন হয়। এ চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ তিনটি চলচ্চিত্র সিনেফাউন্ডেশন-এর জুরি বোর্ড নির্বাচন করে এবং তাদের পুরস্কার দেওয়া হয়।এছাড়া শুধু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্যেও রয়েছে আরো একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা। এখানে সিনেফাউন্ডেশনের জুরি বোর্ড সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ১০টি সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই করে এবং এদের মধ্যে সেরা একটিকে শর্ট ফিল্ম পাম ডি’অর (Short Film Palme d'Or) পুরস্কার দেওয়া হয়।এসব চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয় বুনুয়েল ও ডেবাসি থিয়েটার হলে।
অপ্রতিযোগিতামূলক বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোও লুমিয়ের থিয়েটারে প্রদর্শন করা হয়। জুরি বোর্ড দ্বারা বিভিন্ন দেশের নির্বাচিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এটি; নবীন চলচ্চিত্রনির্মাতাদের উৎসাহিত করতে এখানে রয়েছে ‘ইউ এন সার্টেইন রিগার্ড’ নামের একটি বিভাগ। নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে নির্বাচিত প্রায় ২০টি চলচ্চিত্র নিয়ে এ বিভাগের আয়োজন করা হয় সেল ডেবাসি (Salle Debussy) থিয়েটারে।
উৎসবের অন্যতম একটি বিভাগ ‘প্যারালাল সেকশন’।তবে এটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কারের ব্যাপার নয়।এখানকার মূল কাজ প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর ‘অনন্য’ দৃষ্টিকোণগুলো আবিষ্কার করা। তবে প্যারালাল সেকশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ক্যামেরা ডি’অর পুরস্কার। এটি এমন একজন পরিচালককে দেওয়া হয়,যার প্রথম চলচ্চিত্র (ফিকশন, ডকুমেন্টারি,অ্যানিমেশন যাই হোক না কেনো)কান-এ প্রদর্শন করা হচ্ছে। অর্থাৎ পুরস্কারটি এমন একটি চলচ্চিত্রের জন্য দেওয়া হয়,যা ওই পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্র এবং কান-এ তা প্রথম প্রদর্শন হচ্ছে। এটি নির্বাচনের জন্য আলাদা কোনো জুরি বোর্ড লাগে না। কান-এর সবগুলো বিভাগে নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য থেকে নবীন একজন পরিচালককে এটি দেওয়া হয়।
এছাড়া ‘কান ক্ল্যাসিক’ (Cannes Classics) নামে অপেক্ষাকৃত নতুন ব্যতিক্রমী একটি বিভাগ রয়েছে। ২০০৪ থেকে শুরু হওয়া এ বিভাগ মনে করিয়ে দেয় ‘Old is gold’ প্রবাদটি। এখানে মূলত বিভিন্ন দেশের কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শন হয়।এই বিভাগে এবার অর্থাৎ ৬৬তম উৎসবে দেখানো হয় সত্যজিৎ পরিচালিত চারুলতা। মজার ব্যাপার হলো,৪৮ বছরআগে ১৯৫৬-তে উৎসব কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনে রাজি ছিলো না। অথচ ওই বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে চারুলতার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক নির্বাচিত হন সত্যজিৎ। কান কর্তৃপক্ষ সেসময় চলচ্চিত্রটি দেখাতে কেনো রাজি ছিলো না,এর কারণ আজও জানা যায়নি। তবে সেসময় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন স্যার ডেভিড লিন,ইঙ্গমার বার্গম্যানের মতো কিংবদন্তির পরিচালকেরা।৬ এছাড়া সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়গুলো ‘তু লে সিনেমা দু মন্ড’ (Tous les Cinémas du Monde) নামের উপবিভাগে প্রদর্শন করা হয়। এখানে প্রত্যেকদিন এক একটি দেশকে তাদের বর্তমান ধারার বিষয়গুলো,সংস্কৃতির অনন্যতা,আত্মপরিচয় এবং সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা হচ্ছে ‘সিনেমা ডি লা প্লাজ’ (Cinéma de la Plage) বিভাগটি। এ বিভাগটি শুধুই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য। উৎসবে যতোগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্য,পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় (কান ক্ল্যাসিকের চলচ্চিত্রগুলোসহ) তা এ বিভাগের মাধ্যমে ‘ম্যাস বিচ’-এ (Macé beach) প্রদর্শিত হয়। তবে এর জন্য দর্শককে অবশ্যই টিকিট কিনতে হয়;এরপর আপনি সাগরতীরের মনোরম পরিবেশে বসে প্রিয়জনদের সঙ্গে চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে এই উৎসবের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে পারেন। আকাশ যখন গোধূলী বেলায় অদ্ভুত রঙ ধারণ করে,ঠিক এমন সময় চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনী শুরু হয়।একদিকে আকাশের স্বপ্নীল রঙ,অন্যদিকে সাগরের পানি আর বাতাসের মৃদু শব্দ-সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি;আর সঙ্গে থাকে উৎসবেই প্রথম প্রিমিয়ারে সবার আগে চলচ্চিত্র উপভোগ করার আনন্দ।
এছাড়া কান-এ থাকে উৎসব বহির্ভূত সংগঠনগুলোর আয়োজনে কয়েকটি বিভাগ। এখানেই রয়েছে সেই বিখ্যাত ‘ডিরেক্টরস্ ফোর্টনাইট’ (Directors' Fortnight) ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস্ উইক’ (International Critics' Week) বিভাগ দুটি। এখানে জুরি বোর্ডের নির্বাচিত সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও সাতটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এদের মধ্যে থেকেই দেওয়া হয় উৎসবের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্র্যান্ড প্রিক্স (Grand Prix) পুরস্কার। এখানে জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে থাকেন বিশ্বখ্যাত সব চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক। প্রতিটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পর তারা ভোট দেন এবং তার ভিত্তিতে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। এখানকার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো আবার বেস্ট স্ক্রিনপেস্ন (Prix du scénario) পুরস্কারের জন্যও প্রতিযোগিতা করে। ২০০২ সালে তারেক মাসুদের মাটির ময়না অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস্ উইক পুরস্কার অর্জন করে;একই বছর চলচ্চিত্রটি কান উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শিত হওয়ার বিরল সম্মানও লাভ করে। এছাড়া উৎসবে ‘প্রডিউসার্স নেটওয়ার্ক’সহ আরো বেশকিছু আয়োজন থাকে।
ওগো নদী তুমি আপন বেগে পাগলপারা
কান-এর ৬৫তম আসরে ইতালিয়ান ফিল্ম ডিরেক্টর ন্যনি মরেত্তি ছিলেন জুরি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। উৎসবটি ছিলো একটু ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ,উৎসবে অতিথি হয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে একসময়ের বিস্ময়কর তারকা মেরিলিন মনরো। উৎসব কমিটি তাদের বিজ্ঞাপনে বলেছিলো,‘মৃত্যুর ৫০ বছর পর এখনও বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল তারকা মেরিলিন। এক চিরসবুজ আইকন। যার সৌন্দর্য,আবেদনময়তা,রহস্যময় হাসি এবং বশীকরণ গুণাবলীকে এখনও অনায়াসে সমসাময়িক বলা চলে।’৭ তাই তার মৃত্যুর ৫০ বছর পূর্তিতে পুরো উৎসব জুড়ে ছিলেন তিনি। উৎসবজুড়ে তার ছবি;উৎসবের পোস্টারে তার মৃত্যুর আগের বছর জন্মদিনের কেক নিয়ে তোলা ছবি স্থান পায়।
আর এবারের অর্থাৎ ৬৬তম উৎসবে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন অভিনেতা পল নিউম্যান ও তার স্ত্রী জোয়ানে উডওয়ার্ড। তাদের চুম্বনের একটি সাদাকালো স্থিরচিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে এবারের উৎসবের অফিসিয়াল পোস্টার। ২০০৮-এ নিউম্যান ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে পোস্টারের বাইরেও নিউম্যান উপস্থিত ছিলেন উৎসবে। তার স্ত্রী উডওয়ার্ড প্রযোজিত নতুন চলচ্চিত্র শেপার্ড অ্যান্ড ডার্ক (২০১৩)উৎসবে দেখানো হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে।
১৫ মে উঠেছে ৬৬তম কান-এর পর্দা। মূল প্রতিযোগিতার জুরি বোর্ডের প্রধান ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। সুচারু এই শিল্পীর ৪০ বছরের কর্মজীবনে রয়েছে ২৭টি চলচ্চিত্র,যার মধ্যে দুটি অস্কারজয়ী। তবে ভারতের জন্য এবারের কান যেনো ছিলো একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বছর ভারতিয় চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উদ্যাপন করছে তারা। উৎসবে জুরি বোর্ডে অংশ নিয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা বালান। এটা অবশ্য নতুন নয়,এর আগেও বলিউড থেকে জুরি বোর্ডে অংশ নিয়েছেন পরিচালক শেখর কাপুর ও অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। মূল প্রদর্শনীতে ছিলো অনুরাগ কশ্যপ,করণ জোহর,দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও জয়া আখতার পরিচালিত চারটি ভিন্ন চলচ্চিত্র নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বোম্বে টকিজ। ডিক্টেরস্ ফোর্টনাইট বিভাগে প্রদর্শন করা হয় অনুরাগ কশ্যপ-এর আরেকটি ছবি আগলি। এছাড়া অভিনেত্রী সোনম কাপুর-এর একদিনের রুটিন নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রও উৎসবে প্রদর্শন করা হয়।একই সঙ্গে সোনমসহ ঐশ্বরিয়া রাই,ভারতিয় বংশোদ্ভুত অভিনেত্রী ফ্রিদা পিন্টো কান-এ উপস্থাপন করেন বলিউডের প্রচলিত সৌন্দর্য চর্চার এক ঝলক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলো বাজ লারম্যান পরিচালিত জনপ্রিয় অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর দ্য গ্রেট গেট্সবাই নামের ত্রি-মাত্রিক চলচ্চিত্রটি। এবং অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়েছে জুলু চলচ্চিত্রটি দিয়ে।
কান-এর গুরুত্ব নিয়ে আরেকটি তথ্য দিয়ে শেষ করছি,২০১২ সালে উৎসব কাভার করতে কান-এ গিয়েছিলেন সারা বিশ্বের তিন হাজার সাতশ ৬৭ জন সাংবাদিক। বলা হয়,অলিম্পিকের পরে এতো সাংবাদিকের সমাগম ঘটে কেবল এই উৎসবেই।৮ এই তথ্য আবারো প্রমাণ করে কান-এর বিশালতা।
লেখক : মো.খালিদ হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
khalidj78@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. http://wikipedia.qwika.com/fr2en/Philippe_Erlanger
২. http://en.wikipedia.org/wiki/1946_Cannes_Film_Festival
৩. http://www.imdb.com/event/ev0000147/1946
৪. ‘কান নিয়ে কানকথা’; প্রথম আলো,১৬ মে ২০১৩।
৫.http://en.wikipedia.org/wiki/Palais_des_Festivals_et_des_Congr%C3%A8s
৬. ‘কানে কানে’; সমকাল-এর বৃহস্পতিবারের বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘নন্দন’,১৬ মে ২০১৩।
৭. ‘কান উৎসবে মেরিলিন’; কালের কণ্ঠ,২ মার্চ ২০১২।
৮. http://shopnobuzz.com/entertainment/joya-ahsan-joins-at-66th-cannes-film-festival-in-france
৯. ‘তথ্য সত্য’, প্রথম আলোর শনিবারের বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’,২৫ মে ২০১৩।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ৫ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন