‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার’ ফ্যাসিবাদের গর্ভেই যার জন্ম

১৯৪২ সালে ভিসকন্তি নির্মাণ করেন ওসেসিয়োনে (Ossessione)। বলা হয়,এটাই ইতালির নব্যবাস্তববাদ ধারার প্রথম ছবি।এই চলচ্চিত্র
দেখে মুসোলিনি নাকি তীব্র রাগে চিৎকার করে বলেছিলেন,‘দিস
ইজ নট ইতালি’।
মুসোলিনির শাসনে এতোদিন চলচ্চিত্রে যে ‘সুস্থ দেহ, সুস্থ মন’-এর অধিকারী মানুষের রূপকথা দেখানো হতো,তুলে ধরা হতো এক
বাধ্যতামূলক আশাবাদ-ওসেসিয়োনে ছিলো তারই বিরুদ্ধে এক প্রবল প্রতিবাদ। যেখানে প্রথম
দেখানো হয়েছিলো ইতালি নিয়ে মুসোলিনির নির্মিত রূপকথার বাইরে সাধারণ মানুষের জীবনের
গভীর হতাশা ও যন্ত্রণা।মুসোলিনি সরকার চলচ্চিত্রকে মানুষের ‘সুস্থ
দেহ,সুস্থ মন’
রূপকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।তিনি মনে করেছিলেন,চলচ্চিত্রের চরিত্র রূপকথাতেই
থাকবে,তা মানুষের বাস্তব চিন্তাকে,বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যাবে না।কিন্তু চলচ্চিত্র যখন শিল্প,তখন
তা মুসোলিনির প্রয়োজন মতো রূপকথাতে আর থাকেনি।‘রূপকথার রাজার’ কাছ থেকে তা বেরিয়ে এসেছে পথের মানুষের কাছে।কিন্তু এতো
কিছুর পরও ইতালির চলচ্চিত্র ইতিহাসে ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল অর্থাৎ বেনিতো মুসোলিনির শাসনামল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।
আসলে মুসোলিনি সরকার চলচ্চিত্রকে রূপকথার আঙ্গিকে নির্মাণের কথা
বললেও চলচ্চিত্র সম্পর্কে তার যে বাস্তবজ্ঞান একেবারেই ছিলো না,তা কিন্তু নয়। তাই নব্যবাস্তববাদ
ধারা শুরুর অনেক আগেই কেবল বিনোদনমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে কিভাবে আরো রঙ লাগিয়ে উন্নত
সংস্করণে পরিবেশন করা যায়-সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিলো মুসোলিনি সরকার।সেই ভাবনা
থেকেই তার সরকার চলচ্চিত্রের জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা চিন্তা করেন।তিনি
হয়তো ভেবেছিলেন,এই প্রতিষ্ঠান তার রূপকথার চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিবে।কিন্তু ১৯৩৫ সালে
প্রতিষ্ঠিত ‘এক্সপেরিমেন্টাল
ফিল্ম সেন্টার’
মুসোলিনির চিন্তার উল্টোটাই করেছিলো।
কারণ ব্যাটলশিপ পটেমকিন,মাদার কিংবা স্ট্রাইক-এর মতো চলচ্চিত্র
দেখা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র-সমাজ পরিবর্তনকামী ধারার চলচ্চিত্রনির্মাণে নিজেদের যুক্ত
করবেন এটাই স্বাভাবিক;হয়েও ছিলো তাই। সেন্টারটিকে মুসোলিনির থাবা থেকে বেরিয়ে আজকের
এই গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে আসতে অনেক পথ পেরোতে হয়েছে। আমাদের এবারের আলোচনার বিষয় ইতালির
এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার বা ইতালিয়ান ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল।কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিক্রমার
সেই স্কুলটি সম্পর্কে জানার আগে চলুন ফিরে যাই,সেই সময়ের ইতালির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ও চলচ্চিত্রের গতিপ্রবাহে।
ইতিহাসের পুনর্পাঠ : চলচ্চিত্রে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি
১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্রের যান্ত্রিক উদ্ভাবনের ঠিক বছর দশেক পর ১৯০৫-এ
ক্যামেরাম্যান রবার্তো ওমেগার সহায়তায় নির্মাণ হয় ইতালির প্রথম চলচ্চিত্র লা প্রেসা ডি রোমা।রবার্তো ওমেগার সাফল্যের
পর ইতালিয়ান চলচ্চিত্রনির্মাতারা একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকেন;তবে তা ছিলো
প্রধানত পৌরাণিক ও কমেডি ঘরানার।যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেপোলিয়ন (১৯০৭),এনরিকো ৩
(১৯০৯),লা কাডুকা ডি ট্রুইয়া (১৯১০),ক্যাবেরিয়া (১৯১২)ইত্যাদি।প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলোতে
দর্শকের বিনোদনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো।তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেই ভাবনায় পরিবর্তন
হতে থাকে।নির্মাতারা একপর্যায়ে চলচ্চিত্রের কারিগরি ও শৈলীগত উৎকর্ষতায় মনোনিবেশ করেন।যার
প্রমাণ পাওয়া যায় নিনো আরতোগলিওর লস্ট ইন ডার্কনেস
(১৯১৪)চলচ্চিত্রে।মূলত এর মধ্য দিয়েই ইতালিতে চলচ্চিত্র একটা শিল্প হিসেবে নিজেকে প্রমাণের
পথে একধাপ এগিয়ে যায়।আর এরপর থেকেই সেখানে শিল্পমান সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রনির্মাণ উত্তরোত্তর
বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিন্তু চলচ্চিত্রের এ অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
যুদ্ধের ছোবলে একেবারেই ভেঙে পড়ে ইতালির চলচ্চিত্রশিল্প। কিন্তু তাই বলে দর্শকদের চলচ্চিত্র
দেখা থেমে থাকেনি। কারণ প্রাক-বিশ্বযুদ্ধ দর্শকদের মধ্যে চলচ্চিত্রের যে চাহিদা সৃষ্টি
করেছিলো যুদ্ধোত্তরকালেও তা অব্যাহত ছিলো। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি চলচ্চিত্রনির্মাণ
প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে ছবি প্রদর্শন শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইতালির চলচ্চিত্রে
বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর একধরনের আধিপত্য তৈরি হয়। তবে এ অবস্থা বেশিদিন চলেনি, বিশ্বযুদ্ধ
শেষ হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ইতালির পরিচালকরা নিজস্ব উদ্যোগে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে
শুরু করেন।
১৯২২ সালে ইতালিতে লুইগি ফাকটা সরকারের পতনের পর দেশটির ক্ষমতায়
বেনিতো মুসোলিনি আসায় আবার বিপর্যয় নেমে আসে চলচ্চিত্রশিল্পে।মুসোলিনি সরকার দেশের
অন্যান্য বিষয়ের ওপর তদারকির পাশাপাশি চলচ্চিত্রশিল্পের দিকেও নজর দেয়। এজন্য শুরুতেই
চলচ্চিত্র সংক্রান্ত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ রাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রীভূত করার উদ্যোগ নেয়
তারা। যদিও চলচ্চিত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীভবনের এই শিক্ষা মুসোলিনি নিয়েছিলেন
সোভিয়েত রাশিয়া থেকে,তবে একটু উল্টো পথে।লেনিন ক্ষমতায় আসার শুরুতেই চলচ্চিত্রকে জাতীয়করণ
করেছিলেন,তিনি চেষ্টা করেছিলেন পুরো সোভিয়েতের উন্নয়নে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করতে।আর
বিপরীতে মুসোলিনি চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করলেন রাজনৈতিক প্রচারণা মানে প্রোপাগান্ডা চালানোর
মেশিন হিসেবে।কেননা,প্রোপাগান্ডা চালানোর ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের যে অসীম ক্ষমতা তা বুঝতে
মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের খুব একটা সময় লাগেনি।
শুরুতেই মুসোলিনি সরকার চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি কমিটি
গঠন করে।এই কমিটির কাজ ছিলো বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইতালিয় চলচ্চিত্রে
তা প্রয়োগ করা।কমিটির সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলেসান্দ্রো র্সাদি ও লুইগি ফ্রেদি।
আলেসান্দ্রো র্সাদি ছিলেন ১৯২৯ সালে তৈরি ‘শিক্ষামূলক’ চলচ্চিত্র সংস্থা ‘লুনিয়োনে সিনেমাতোগ্রাফিক এদুকাতিভা’ (লুস)এর
সভাপতি।মুসোলিনির উত্থানের ওপর তিন খণ্ডে নির্মিত তথ্যচিত্র-এই সংস্থার অন্যতম কাজ।অন্যদিকে
লুইগি ফ্রেদি ছিলেন মুসোলিনির চলচ্চিত্রবিষয়ক পরামর্শক।তারই নেতৃত্বে ১৯৩৩ সালে গড়ে
ওঠে ভর্তুকিভিত্তিক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র পরিচালনা সংস্থা ‘দিরেজিওন
জেনেরাল পার লা সিনেমাতোগ্রাফিয়া’ (ডিজিসি)।মুসোলিনির মনের মতো করে এই সংস্থাটি একের পর
এক চলচ্চিত্র নির্মাণসহ চলচ্চিত্রের নানাধরনের উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপও নেয়।এমনকি এই
সংস্থাটি ফ্যাসিবাদী ধারার কোনো কোনো চলচ্চিত্রকে শতভাগ ভর্তুকি দিতে এতোটুকু কার্পণ্য
করতো না।
কিন্তু তারপরও হঠাৎ করেই ফ্যাসিবাদী মুসোলিনি সরকারের সন্দেহ জাগে,কিছু
পরিচালক তাদের বিরোধিতা করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন।এবারও সেই ফ্রেদির নেতৃত্বে চলচ্চিত্র
সেন্সর বোর্ড গঠন করা হয়।এর আগে অবশ্য ইতালিয় চলচ্চিত্রে কোনো সেন্সর ছিলো না। ফ্যাসিবাদী
আইন করে একজন মানুষকে যেমন ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হতো,ঠিক তেমনি সেন্সর দিয়ে ইতালির স্বাধীন
চলচ্চিত্র নির্মাণের পথকেও আটকে দেওয়া হয়।সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন অনেক বিদেশি চলচ্চিত্রকে
হরহামেশাই নিষিদ্ধ করা হতো।মুসোলিনি সরকার মূলত এটিই বুঝাতে চাইতো যে,চলচ্চিত্র প্রমোদ-পণ্য
ছাড়া আর কিছু নয়।ফলে কারো বুঝতে আর বাকি থাকে না,চলচ্চিত্র নিয়ে মুসোলিনির উন্নয়নের
কথা তার সরকারের প্রচারণার উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে এর বাইরে ইতালির চলচ্চিত্রের প্রকৃত উন্নয়নে কিছু কাজ কিন্তু
মুসোলিনি করেছিলেন। আগেই বলেছি,১৯৩৫ সালে ইতালি তথা সারাবিশ্বের চলচ্চিত্রের জন্য সবচেয়ে
বড়ো কাজটি করলেন মুসোলিনি।তিনি আলেসান্দ্রো র্সাদি ও লুইগি ফ্রেদি-কে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন
এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার।এর ঠিক দুই বছর পর ১৯৩৭-এ চলচ্চিত্র উন্নয়নে স্থাপন
হলো এক লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে স্টুডিও কমপ্লেক্স।আয়তনে এটি এতোই বড়ো ছিলো
যে,সেখানে বিশাল বিশাল ১৬টি স্টুডিও ছিলো।
মুসোলিনির ওই স্কুল পরবর্তী সময়ে পঠন-পাঠনে ইতালিসহ পুরো বিশ্বের
চলচ্চিত্রপ্রেমী শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।আজ কিউবার যে চলচ্চিত্র স্কুলটি
সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত প্রত্যাশিত ও আকাঙ্ক্ষার বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠেছে,তার
পিছনেও কিন্তু এই স্কুলটির ভূমিকা রয়েছে।কারণ,কিউবার এই স্কুলটি যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা
হয়েছিলো সেই উদ্যোক্তা বা শিক্ষকের চারজনই ইতালির এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।এছাড়া রোবের্তো
রোসেলিনি,মাইকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি,লুইগি জাম্পা’র মতো ইতালির বিখ্যাতসব চলচ্চিত্রনির্মাতারাও এই স্কুল
থেকে শিক্ষালাভ করে হয়ে উঠেছিলেন জগদ্বিখ্যাত।পরবর্তী সময়ে আবার এদেরই হাত ধরে ভিত্তোরিও
ডি সিকা,ফেদরিকো ফেলিনি,বার্নাদো বার্তোলুচ্চির,ডি সান্তিস-এর মতো ভুবনজয়ী চলচ্চিত্রনির্মাতাদের
আবির্ভাব হয়েছিলো এই ইতালিতে।
এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার
রাজধানী রোমে প্রতিষ্ঠা হয় ইতালির চলচ্চিত্র উন্নয়নের ‘ফার্স্ট
বিল্ডিং’
হিসেবে খ্যাত এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার।প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক হিসেবে লুইগি চিয়ারিনির
হাত ধরেই সেন্টারের যাত্রা শুরু;উদ্দেশ্য ছিলো নানাধরনের গবেষণার মধ্য দিয়ে ইতালিয়
চলচ্চিত্রের উন্নয়নে শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উন্নততর নিশ্চয়তা প্রদান করা।মূলত
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সেন্টারে শিক্ষা,গবেষণা,প্রকাশনা ও তত্ত্বগত দিকগুলোর প্রতি
বেশি গুরুত্বারোপের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়।সেই পরিকল্পনার হাত ধরে আজও এই প্রতিষ্ঠানটি
ইতালিয় চলচ্চিত্র ও অডিও ভিজ্যুয়াল শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
স্কুলটি প্রতিষ্ঠার দুই বছর যেতে না যেতেই অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে ‘বিয়ানকো
ই নিরো’
নামে একটি জার্নাল বের করা হয় সেন্টার থেকে। শুরুতেই এ ধরনের সফলতায় অবশ্য অনেকে চমকে
গিয়েছিলেন।সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো,কিন্তু এই সময় সেন্টারের গায়ে আঁচড় কাটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।যুদ্ধে
একদিকে যেমন মুসোলিনি সরকারের পতন হয়,আরেকদিকে জার্মান সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে সৃষ্টি
হয় এক ভয়ঙ্কর অরাজকতার।ইতালির সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন ছাড়াও সরকারিভাবে গড়ে ওঠা
প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে তারা চালাতে থাকে ব্যাপক লুটতরাজ।এমনকি
সেই লুটতরাজ থেকে বাদ পড়েনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টারটিও।এখানেও
তারা বড়ো ধরনের লুটতরাজ চালায়,লুট হয় চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যবহৃত অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি।যুদ্ধ
শেষে স্কুলটি হারিয়ে ফেলে তার সাধারণ শিক্ষাকার্যক্রম চালানোর ক্ষমতা।
ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের
স্বপ্নগুলো ধূসর হতে থাকে।কিন্তু খারাপ সময়তো আর চিরকাল থাকে না,জার্মান সেনাবাহিনী
ইতালি থেকে চলে যাওয়ার দুবছর পর ১৯৪৬ সালেই খুলে দেওয়া হয় বন্ধ সেন্টারটি।সেই সঙ্গে
প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পরিচালনা কমিটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে।ফলে
সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে খুব দ্রুতই তা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে।‘পুনর্জন্মের’ প্রথম
পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৪৯ সালে এই সেন্টারের আওতায় স্থাপন করা হয় ‘ন্যাশনাল
ফিল্ম আর্কাইভ’।
ধীরে ধীরে এখানে গড়ে উঠতে থাকে চলচ্চিত্রের এক বিশাল সংগ্রহশালা।এভাবে চলচ্চিত্রের
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ফিল্ম আর্কাইভটিও ইতালির চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে।
১৯৬৫ সালে এসে ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার’-এর
নামে পরিবর্তন আনা হয়।ইতালিয় চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সেন্টারের নামকরণ করা হয়
প্রথম পরিচালক লুইগি চিয়ারিনির নামে।এরপরও অবশ্য দুবার এই সেন্টারটির নামে পরিবর্তন
আনা হয়।১৯৯৭ সালে নতুন নামকরণ করা হয় ‘ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল’।সর্বশেষ ২০০৪ সালে জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি
পুনরায় তার আদি নাম ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার’-এ
ফিরে যায়।বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সারাবিশ্বে ‘ইতালিয়ান ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল’ নামে
সমধিক পরিচিত।
যা পড়ানো হয়
চলচ্চিত্রের নয়টি বিষয়ের ওপর তিন বছর মেয়াদি কোর্স করানো হয় এই
স্কুলে। বিষয়গুলো হলো :অভিনয়,পাণ্ডুলিপি লিখন,চিত্রগ্রহণ,সেট ডিজাইন,কস্টিউম ডিজাইন,শব্দ
প্রকৌশল,ব্যবস্থাপনা (প্রোডাকশন),সম্পাদনা ও পরিচালনা।নয়টি বিষয়ের প্রতিটির জন্য রয়েছে
নির্ধারিত আসনসংখ্যা।দেশ-বিদেশের যে কেউ এখানে পড়তে চাইলে তাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার
মধ্য দিয়ে আসতে হবে।স্বল্পসংখ্যক আসনের বিপরীতে বেশি আবেদনপত্র জমা পড়ায় মূলত এই পরীক্ষাটি
নেওয়া হয়।বছরে একবার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে।স্কুলে ভর্তির পর যে বিষয়টি এখানে
আবশ্যক তাহলো,শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হয়।
নিয়মিত তাত্ত্বিক ক্লাসের পাশাপাশি এখানে শিক্ষার্থীদের সব কোর্সে
আলাদা আলাদাভাবে হাতে-কলমে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।ফলে শিক্ষার্থীরা কোনোরকম
একঘেয়েমি ছাড়াই আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।এখানকার শিক্ষার্থীরা সাধারণত
৩৫ মিমি চলচ্চিত্রনির্মাণে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।তবে মূল কোর্সের বাইরে শিক্ষার্থীরা
স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রনির্মাণ,ভিডিও সম্পাদনার মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।মূলত
প্রতিটি বিভাগ থেকে ছয়জনকে নির্বাচন করে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়।তাছাড়া এর কোর্স
শেষে মূল ডিপ্লোমার জন্য তাদের নানাধরনের প্রজেক্টের কাজও করতে হয়।ডিপ্লোমা শেষে সবচেয়ে
ভালো করা শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে পুরস্কারের ব্যবস্থা।এর চেয়েও আনন্দের কথা হলো,সেন্টারের
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝেই ইতালির বিখ্যাত সব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান-রাই সিনেমা,মিডুসা
ফিল্মস্ ও লুসির সঙ্গে নির্মাণ করেন বিশাল বাজেটের সব চলচ্চিত্র।
আর শিক্ষকদের কথা যদি বলেন,স্কুলে পড়াতে আসেন আন্তর্জাতিকমানের
বিখ্যাত সব ইতালিয় শিক্ষক।যাদের মধ্যে রয়েছে ফ্রানকো বারনিনি (পাণ্ডুলিপি লিখন),আন্দ্রে
ক্রিসানটি (সেট নির্মাণ),ড্যানিয়েল লুচিট্টি (পরিচালনা),গিয়ানকারলো গিয়ান্নিনি (অভিনয়),ডোমেনিকো
মাসেল্লি (প্রোডাকশন),রোবার্তো পারপিগনানি (সম্পাদনা),গিয়ুসপি রুতুননো (চিত্রগ্রহণ),ফেডেরিকো
সাভিনা (শব্দ প্রকৌশল) এবং পিয়েরো টোসি (কস্টিউম) এর মতো শিক্ষকেরা।লক্ষণীয় ব্যাপার
হলো,শিক্ষকদের অনেকেই কিন্তু এই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী।আর তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের
মধ্যে সুসম্পর্কটাও অনেক বেশি।তবে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের আশার কথা হলো,এখানে পড়তে
তাদেরকে খরচ নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা করতে হয় না।কেননা,এই স্কুলটি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত
সরকারি অর্থেই পরিচালনা হচ্ছে।
স্কুলটির অনন্যতা আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে।স্কুলের রয়েছে
নিজস্ব একটি প্রেক্ষাগৃহ,যেখানে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর বাইরে বছরের বিভিন্ন সময়ে
সেমিনার ও উৎসবের আয়োজন করা হয়।এছাড়াও একটি কম্পিউটার ল্যাব,তিনটি ফিল্ম স্টুডিও,একটি
মিক্সিং রুম, তিনটি শরীরচর্চা কেন্দ্র, অনেকগুলো ব্যবহারিক কক্ষ ও শ্রেণিকক্ষ স্কুলটিকে
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করেছে।সম্প্রতি চলচ্চিত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির জোরালো
প্রভাব পড়ায় স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে ‘টেলিকম ইতালিয়া’ নামে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নিয়ে একটি ডিপার্টমেন্ট চালু
হয়েছে।
সবমিলে এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম সেন্টার ইতালির চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির
জন্য যেনো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অতীতে যেমন ইতালিয় চলচ্চিত্রের পুরোধারা এই স্কুল থেকেই
এসেছিলেন,এখনো ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ পরিচালক,অভিনেতা,টেকনিশিয়ানরা কিন্তু এই স্কুলেরই
সাবেক শিক্ষার্থী।
যোগাযোগের ঠিকানা
CENTRO SPERIMENTALE DI CINEMATOGRAFIA
( EXPERIMENTAL
CINEMATOGRAPHY CENTRE)
Via Tuscolana, 1524-00173 Rome-ITALY
Phone : +39 06.722941 Fax : +39 06.94810162
লেখক : রায়হানুল রানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
পাঠ সহায়িকা
আচার্য,নির্মাল্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পাদিত (২০০৯); শতবর্ষে
চলচ্চিত্র ২; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা।
হায়াৎ,অনুপম (২০০৪); চলচ্চিত্রবিদ্যা; বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অধ্যয়ন
কেন্দ্র,ঢাকা।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ৫ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।