ওম পুরি, নাসিরউদ্দিন শাহ্ ও অনুপম খের ভূমিকা ও ভাব-ভাষান্তর : অনিক ইসলাম
প্রকাশিত ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
আলাপচারিতা : 'যেকোনো চরিত্রের চাহিদামতো আমরা, আমাদের চেহারা বদলে ফেলতে পারি'
ওম পুরি, নাসিরউদ্দিন শাহ্ ও অনুপম খের ভূমিকা ও ভাব-ভাষান্তর : অনিক ইসলাম

খুবই স্বল্প স্মৃতি ধারণের শক্তি মহাকালের? না হলে কেনো সবাইকে সে মনে রাখতে পারে না, নাকি সবাইকে মনে রাখার তাগিদ তার নেই! কে এই মহাকাল, কী এই মহাকাল? মহাকাল আসলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মনের গড়। তাই একদল মানুষেরই প্রতিনিধি ম্যাজিক লণ্ঠন’কে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে দেখি যে, তারা তাদের ইতিহাসে স্থান দেবে ওম প্রকাশ পুরি’কে; তখন অবশ্য বুঝতে বাকি থাকে না নিষ্ঠুর মহাকালের অমূল্য সেই তালিকায় জায়গা হয়েছে ওম পুরি’র। মৃত্যুর পর যার স্মৃতিতে আমরা ভিজে উঠতে দেখেছি বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী মিলনমেলা অস্কারের লাল গালিচাকে।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে ভারতের হরিয়ানাতে জন্ম নেওয়া ওম ছিলেন সাত ভাই-বোনের সবচেয়ে ছোটো। আক্ষরিক অর্থেই তিনবেলা ভাত জুটতো না ওমদের। পরিবারকে সাহায্য করতে তাই চায়ের দোকানের কাপ ধুতে হতো তাকে। কে জানতো সেই ওম একদিন বিশ্বের অন্যতম মেধাবী অভিনয়শিল্পীদের একজন হয়ে উঠবেন!
আসলে বদলাতে থাকা এক সময়ের শুরুতে তারুণ্যে পা দিয়েছিলেন ওম। চারিদিকে তখন বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর গর্ভে ছোটো ছোটো দেশগুলো ক্রমেই বড়ো হয়ে উঠছিলো, যারা অচিরে নিজেই মায়ের পেট চিরে বেরিয়ে আসবে। ওম যখন অভিনয় শুরু করছিলেন, তখন ২০ বছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা শেষের পথে, বিটল্স ভেঙ্গে যাচ্ছিলো, পৃথিবী প্রথমবারের মতো সমকামি আন্দোলন দেখলো। ওই সময় পর্ন চলচ্চিত্র প্রথমবারের মতো মুক্তি পেলো প্রেক্ষাগৃহে। এদিকে সেসময় ভারতীয় চলচ্চিত্রে চেহারা সর্বস্ব অভিনেতাদের পাশাপাশি চরিত্রাভিনেতাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে; ভারতে তথা পৃথিবীতেই প্রথমবারের মতো কোনো নারী প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, সমাজের একটি পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতিনিধি হয়েও যা কিছু সময়ের দাবি, যা কিছু ওই বদলাতে থাকা সময়ের চোখে ঠিক, সে সবকিছু চিনতে ও বুঝতে পারছিলেন ওম। সঙ্গে সেই বদলাতে থাকা সকালগুলোর বদলাতে থাকা চায়ের স্বাদ, বদলে যাওয়া রাতের বদলে যাওয়া স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো, সবই নিজের ভিতর নিজের অনূভুতিতে গেঁথে নিচ্ছিলেন ওম। পরে অবশ্য দর্শক অবাক হয়ে দেখেছে ওম পুরির অভিনয় আসলে তার সেই জীবন অবলোকনেরই সম্মিলন; পরবর্তী সময়ে যিনি নিজে আরো কয়েকজন অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে বদলে দিয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের গল্প।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি ওম পুরি শেষবারের মতো পৃথিবীক চমকে দিয়েছিলেন তার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে; আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ওম পুরির মতো শক্তিশালী অভিনয় আর কখনো কাউকে করতে দেখা যাবে বলে ঠাওর হয় না। ভরা গ্রীষ্মে উপবাসে থাকা কোনো মানুষের, শীতকালে ঘরের পিছনের বরই গাছ হতে টিনের চালে বরই পড়ার শব্দের স্মৃতির কথা মনে হলে যে হাহাকার জন্মে, চিত্তে ঠিক সেই মাত্রার হাহাকার তৈরি হয় ওম পুরির কথা, তার অভিনয়ের কথা মনে পড়লে।
ম্যাজিক লন্ঠন বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছে চলচ্চিত্রের এই মহানায়ককে। অনুপম খের খের-এর সঞ্চালনায় ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘কালার্স এইচডি’-এর ‘দ্য অনুপম খের খের শো : কুচ ভি হো ছাকতা হ্যায় ...’ এ উপস্থিত হয়েছিলেন ওম প্রকাশ পুরি ও নাসিরউদ্দিন শাহ্। সেই শো-এর আলোচনা ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পাঠকদের জন্য হিন্দি ও ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। মূল ভিডিওটি দেখতে চাইলে যে কেউ https://www.youtube.com/watch?v=RTaDOvaS48k&t=124s; retrieved on 20.02.2017লিঙ্ক-এ ঘুরে আসতে পারেন।
অনুপম খের খের : বন্ধুরা, যদি ৯১ বছরের বৃদ্ধ ‘ফজা সিং’ ম্যারাথনে অংশ নিতে পারেন, তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে। যদি স্নায়বিক ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং পৃথিবী সেরা পদার্থবিদ হতে পারেন, তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে। যদি কলেজ শেষ না করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করতে পারেন, তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে। বন্ধুরা, ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককে একেকটি আলাদা পরিচয় দিয়েছেন, এই জীবনে ভিন্ন ভিন্ন কিছু অর্জনের জন্য। এই ধারণাকে সামনে রেখে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, ‘দ্য অনুপম খের খের শো- যেকোনো কিছু হতে পারে’তে। (দর্শকের হাততালি)
আমাদের জীবনের চিন্তাধারাকে পূর্বানুমান দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। যেকোনো অভূতপূর্ব ঘটনা আমাদের জন্য ব্যতিক্রম ঘটনায় পরিণত হয়। আমরা ভাবতে থাকি, এ ধরনের ঘটনা কখনোই আমাদের ক্ষেত্রে ঘটবে না; আর ভাগ্যের দোষ দেওয়া তো আমাদের ঐতিহাসিক স্বভাব। একজন নিচু কাঁধওয়ালা ব্যক্তি কখনো বাস্কেটবল খেলোয়াড় হতে পারবে না, ভারী শরীরের মানুষ কখনো নাচিয়ে হতে পারবে না, নায়কোচিত চেহারা না থাকা কেউ কখনো অভিনেতা হতে পারবে না- এসবই আমাদের জীবন সম্পর্কিত পূর্বানুমান। এই পূর্বানুমানের শিকার আমিও ছিলাম। আমি মাথার চুল কলেজ জীবনেই হারিয়ে ফেলি। সবাই বলতো যার যৌবনেই বার্ধক্য উপস্থিত, সে কীভাবে অভিনেতা হবে; এর ক্যারিয়ার তো শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে! কিন্তু একটা বিষয় দেখুন, সেই অল্প বয়সের বার্ধক্যই আমার পরিচয় নির্মাণ করেছে আর মাথার চুল না থাকায় আমাকে করেছে মর্যাদাবান। বন্ধুরা মনে রাখবেন, আপনার সবচেয়ে বড়ো বিশেষত্ব আপনি নিজেই। এ কারণে অসম্ভবের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। কারণ জীবনে ...
দর্শক : (সমস্বরে) ‘যেকোনো কিছু হতে পারে’।
অনুপম খের : বন্ধুরা, আজ আমার যে বন্ধু এখানে এসেছেন তার জীবনের যাত্রা একটা অদ্ভুত অনুভূতির মতো। তার যে নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, সাফল্য, জীবন-সংঘর্ষ তা নিজেই যেনো ভিন্ন একপ্রস্থ যুগকাল। তার জীবনের এক পৃষ্ঠা আপনার জীবনের গোটা বই হয়ে যেতে পারে। আমন্ত্রণ জানাই গোটা দুনিয়ার অসাধারণ অভিনেতাদের একজন, নাসিরউদ্দিন শাহ্কে।
নাসিরউদ্দিন শাহ্ : সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
অনুপম খের : নাসির সাহেব ...।
নাসিরউদ্দিন : ধন্যবাদ, আপনি অনেক বেশি প্রশংসা করে ফেলেছেন আমার।
অনুপম খের : একদম না, আমার তো শব্দে কম পড়ছিলো। চাইলে তো আরো অনেক প্রশংসা আমি আপনার করতে পারি। অদ্ভুত ঘটনা হলো, আজ সকাল থেকে আমি ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে আজ; কী প্রশ্ন আমি আপনাকে করবো? কারণ আপনার সম্পর্কে অনেক বিষয়ই তো আমি জানি। তাই চলুন একদম শুরু থেকেই শুরু করি। নাসির সাহেব, কতো বছর ধরে অভিনয় করছেন?
নাসিরউদ্দিন : শুধু পেশাদারভাবে না বাথরুম-অভিনয়ও ধরবো? (সম্মিলিত হাসি) হুম, ৫০ বছর তো হবেই।
অনুপম খের : গোল্ডেন জুবিলি চলছে আপনার অভিনয়ের!
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, আমার মতে ৫০ বছর, এমনকি কয়েক বছর বেশিও হতে পারে। তবে হ্যাঁ, ৫০-এর নিচে তো কোনোভাবেই হবে না। প্রথম শুরুর সময় ১৪ বছর বয়স ছিলো, ক্লাস নাইনে পড়তাম আমি।
অনুপম খের : ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আপনি ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ করেন?
নাসিরউদ্দিন : একদম ঠিক, সেসময় প্রথমবারের মতো আমার অনুভূতি হয়, এটাই আমার জায়গা। এখান থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না, যা কিছুই হোক না কেনো। বাবা অনেকদিন ধরে আমার পিছনে লেগে ছিলেন যেনো আমি অভিনয় না করি। আপনাদের অনেকের সঙ্গেও হয়তো হয়েছে এমন যে, ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও কিংবা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে যাও।
অনুপম খের : অভিনয় নিয়ে আপনার এই যে অনুভূতি, এটা কী করে তৈরি হলো?
নাসিরউদ্দিন : এটার একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমি খুবই খারাপ ছাত্র ছিলাম। ক্লাসে সবার শেষে হতো আমার রোল। পদার্থ, রসায়ন, ত্রিকোণমিতি যা-ই ক্লাসে পড়ানো হতো, কিছুই আমি বুঝতাম না। এক সাহিত্য ছাড়া কোনো কিছুই আমার মাথায় ঢুকতো না।
তো আমাদের স্কুলে সেসময় নানারকম নাটক হতো, অনেক ভালো ভালো নাটক। কিন্তু সেখানে আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি কখনো। ভালো ভালো চরিত্রগুলো পেতো ক্লাসের সব ভালো ছাত্ররা। তাই নিজের উদ্যোগে চার বন্ধুকে একসঙ্গে করে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর কিছু দৃশ্য আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম। সেসময় মি. জেফরি কেন্ডেল আমাদের স্কুলে আসতেন প্রতিবছর। তাকে আমি আমার গুরু মানতাম, অনেকটা একলব্য আর দ্রোণাচার্যের মতো, তাকে নকল করার মধ্য দিয়ে আমার অভিনয় জীবন শুরু হয়।
অনুপম খের : জেফরি কেন্ডেল ছিলেন শশী কাপুরের শ্বশুর।
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, জেনিফারের বাবা।
অনুপম খের : উনার কোন নাটকটি আপনি প্রথম দেখেছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : উনার প্রথম নাটক দেখেছিলাম ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’।
অনুপম খের : আপনি নিজে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ করার আগে উনারটা দেখেছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, নিজে করার আগে বেশ কয়েকবার ওটা দেখে আমি উনার অভিনয় দেখে ভীষণ প্রভাবিত হয়েছিলাম। কারণ উনি যখন শেক্সপিয়ারের ছোটো ছোটো চরিত্রগুলো করতেন, তখন চোখের পলকে নিজেকে বদলে ফেলতেন। তিনি কখনো শাইলক থেকে ম্যাকবেথ, কখনোবা ম্যাকবেথ থেকে হ্যামলেট হয়ে যেতেন। চোখের সামনে তার গোটা সত্তাটাই রূপান্তরিত হয়ে যেতো।
অনুপম খের : নাসির সাহেব, যেহেতু ছোটোবেলায় আপনি খুব লাজুক ছিলেন। তাই যখনই আপনার কোনো বিশেষ অভিব্যক্তির ইচ্ছে হতো- যা আপনি বাস্তব জীবনে করতে পারতেন না- তা আপনি মঞ্চে নির্দ্বিধায় করতে পারতেন। এ কারণেই কি অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকেছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : খুব ভালো গবেষণা করেছেন আপনি আমার ব্যাপারে। (হাসতে হাসতে)
অনুপম খের : তা একটু করেছি।
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ এটা সত্যি। সম্ভবত জেফরি কেন্ডেল’কে নকল করার মধ্য দিয়ে আমি সেই বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইতাম। কারণ ওই বাস্তবতাটাকে আমি ঘৃণা করতাম, যেখানে আমি বিশেষ কোনো আগ্রহ পেতাম না। আমার জীবন ছিলো বিরক্তিকর, আমার কোনো বন্ধু ছিলো না।
অনুপম খের : আর আপনার ভাইয়েরা তো সবাই ভীষণ বিদ্বান ছিলেন।
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, একজন বিদ্বান ছিলেন, আরেকজন অসাধারণ ক্রীড়াবিদ। যে কারণে আমাকে দুই দিক থেকেই চাপে থাকতে হতো। আমি না ছিলাম এদিকে ভালো, না ছিলাম ওদিকে! আর এখানে যারা ছোটো ভাই আছে, তারা সবাই নিশ্চয় জানে, ছোটো ভাইয়েরা না ঈশ্বর, না পশু, না মানুষ- কারো কাজে লাগে না। (সম্মিলিত হাসি)
অনুপম খের : আপনার এই যে লাজুকতা, অন্তর্মুখীনতা এটার কারণ কী ছিলো?
নাসিরউদ্দিন : আফসোস, আমি নিজেও আজ পর্যন্ত এটা বুঝতে পারিনি।
অনুপম খের : কারণ আমি নিশ্চিত আপনার বাবা-মা আপনাকে এবং তাদের অন্য সন্তানদের একই শিক্ষায় বড়ো করেছেন, তাহলে?
নাসিরউদ্দিন : সম্ভবত আমার কাছ থেকে বাবার প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিলো। কিন্তু তিনি কোনোদিনই আমার কাছ থেকে কিছু পাননি। এই কষ্টটা আমার আজীবন থাকবে, পরবর্তী সময়ে বাবার সঙ্গে ওই সম্পর্কটা আর কখনোই পুনরুদ্ধার করতে পারিনি।
অনুপম খের : তাহলে শাইলক-এর ওই যে অভিনয়টা, ওটা কাদের দেখালেন?
নাসিরউদ্দিন : আমরা স্কুলে একটা নোটিস ঝুলিয়েছিলাম, নবম শ্রেণি পরিবেশন করতে যাচ্ছে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’। পরিচালনায় : শাহ্ নাসির। ওই সময়ে স্কুলে সবাই আমাকে ওই নামেই চিনতো।
অনুপম খের : শাহ্ নাসির?
নাসিরউদ্দিন : হুম, শাহ্ নাসির। সবার জানা দরকার, ঠিক ওই দিনটাতেই আমার জীবন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। আর এই কারণেই থিয়েটারের প্রতি আমার এতো ভালোবাসা, এতো আনুগত্য। এবং থিয়েটারের এই অবদান আমি কোনোভাবেই শোধ করতে পারবো না। যাইহোক, আমি প্রথম যখন মঞ্চে উঠলাম, তখন প্রথমবারের মতো মঞ্চের আলো কী তা টের পেলাম! বুঝলাম, কীভাবে সেই আলো একজনকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। এখন যদিও আমাদের সবার অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু সেদিনের কথা মনে করুন তো, যেদিন আপনি প্রথম মঞ্চে উঠেছিলেন! চোখ ঝলসে দেওয়ার মতো আলো আর তার পিছনে নিকষ অন্ধকার। এবং সেই অন্ধকারের মধ্যে স্রেফ মাথার মতো কিছু আকৃতি। তারপর ধীরে ধীরে বোঝা যায়, বাবা কোথায় বসে আছেন, বন্ধু কোথায় বসে আছেন বা অন্যরা কে কোথায় আছেন। কিন্তু ওই উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগে।
শোনেন অনুপম খের , আমার জীবনে ভয়ের সবচেয়ে প্রগাঢ় অনুভূতি আমি সেই দিন টের পেয়েছি, মঞ্চে প্রথম কথা শুরুর আগের সেই ৫-১০ সেকেন্ড। আমার হৃদপিণ্ড এতো জোরে জোরে ধকধক করছিলো যে, মনে হচ্ছিলো বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে ওটা। তারপর আমি প্রথম বাক্যটি বললাম, আর দর্শক হাসলো।
অনুপম খের : কী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সেই ক্ষণগুলো মনে আছে আপনার!
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ। এবং জীবনে সেই প্রথম কেউ আমার কোনো কথায় হেসেছিলো। মনে হয়েছিলো, যেনো জীবনে প্রথমবারের মতো আমার বলা কোনো কথা কেউ শুনলো। কারণ ক্লাসে আমি একদম জিরো ছিলাম।
অনুপম খের : সম্ভবত ওই দিন প্রথম আপনি আপনার অস্তিত্বকে অনুভব করেছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, মনে হয়েছিলো এই পৃথিবীতে অন্তত একটা কিছু আমি করতে পারি।
অনুপম খের : আপনার পরিবারের সদস্যরা নাটকটি দেখতে এসেছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : না।
অনুপম খের : আপনি আমন্ত্রণ জানাননি নাকি ওরা নিজ থেকেই আসেনি?
নাসিরউদ্দিন : আমি নিজেই বলিনি, কারণ ওরা জানলে পিটুনি থেকে আমার আর কোনো নিস্তার থাকতো না।
অনুপম খের : আচ্ছা। (সম্মিলিত হাসি)
নাসিরউদ্দিন : নাটক করছো! পড়াশোনার কোনো বালাই তো নেই-ই তার ওপর আবার নাটক! দেখুন, আমাকে একটা ক্রিকেট ম্যাচ পর্যন্ত খেলতে যেতে হতো এক্সট্রা ক্লাসের দোহাই দিয়ে- ব্যাপারটা কেমন ছিলো এবার বোঝেন।
বাবা মঞ্চে আমার কোনো কাজ দেখে যেতে পারেননি। উনি শুধু আমার প্রথম চলচ্চিত্রটা দেখেছিলেন নিশান্ত, ওটা দেখে অবশ্য উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ চলচ্চিত্রে আমি আমার পরিবারের দেওয়া নামটি পরিবর্তন করিনি।
অনুপম খের : কেউ কি নাম পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলো?
নাসিরউদ্দিন : যখন নিশান্ত’র শুটিং চলছিলো, তখন এই আলোচনাগুলো হচ্ছিলো- আমার নাম অনেক লম্বা, মানুষের উচ্চারণে সমস্যা হবে। আমি তখন ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শত্রুঘ্ন সিনহা ছোটো নাম নাকি? (সম্মিলিত হাসি)
অনুপম খের : ঠিক কী প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন আপনি অভিনেতা হয়ে?
নাসিরউদ্দিন : অভিনয় করে আনন্দ পেতাম; প্রমাণ করার কিছু ছিলো না।
অনুপম খের : নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন এটাই কি কারণ ছিলো?
নাসিরউদ্দিন : শুরুটা যে ওই কারণেই হয়েছিলো তা আমি মানি। প্রত্যেক অভিনেতারই শুরুটা ওখান থেকে হয় বলে আমার ধারণা।
অনুপম খের : জি একদম তাই, কারণ এই পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো নিজের অস্তিত্ব, উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
নাসিরউদ্দিন : যারা অভিনেতা হতে চায় তাদের অনেকেই স্বীয় ব্যক্তিত্ব, চেহারায় একটা খামতি অনুভব করে। আরে আমার চেহারা কেনো শাম্মি কাপুরের মতো নয়! এই অপ্রাপ্তি থেকে একধরনের মুক্তি পেতে তারা অভিনয়কে আঁকড়ে ধরে, অভিনেতা হতে চায়। আমার ক্ষেত্রে অন্তত এটা ঘটেছিলো।
অনুপম খের : যাইহোক, এরপরে জীবনে আর কী কী হলো আপনার?
নাসিরউদ্দিন : এরপর আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। ওখানে আমি গ্রাজুয়েশন করলাম ইংরেজি সাহিত্যে। সেখানেই আমি জানতে পারলাম, ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’ (এন এস ডি) নামের এক প্রতিষ্ঠান আছে দিল্লিতে। যেখানে শিক্ষার্থীদের থিয়েটারের ওপর শুধু প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় না, সঙ্গে দুশো টাকা মাসিক বৃত্তিও দেওয়া হয়। তখন আমি ভাবলাম, আরে এ তো জান্নাতের বর্ণনা! এ কীভাবে সম্ভব! (সম্মিলিত হাসি) আপনাকে শুধু অভিনয় করতে হবে আর তার জন্য টাকা পাওয়া যাবে! আমি ভাবলাম, বাহ্, কী অদ্ভুত! তারপর আমি সেখানে আবেদন করলাম, আর আমাকে ওরা ভর্তি নিয়ে নিলো। ওখানকার ঘটনা তো আপনিও নিশ্চয় জানেন।
অনুপম খের : জি।
নাসিরউদ্দিন : আপনার হয়তো আলাদা কোনো অভিজ্ঞতা থাকতে পারে; কিন্তু আমার জন্য ওটা জীবনের সবচেয়ে সুখের তিনটি বছর ছিলো।
অনুপম খের : আমার জন্যও তাই। তিন বছর ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শুধু থিয়েটার ও বইয়ের মধ্যে বেঁচে থাকা।
নাসিরউদ্দিন : বিশ্বাসই হতে চাইতো না যে, এসব সত্যি সত্যি ঘটছে। ফিজিক্সও পড়তে হয় না, ম্যাথমেটিক্সও করতে হয় না। (সম্মিলিত হাসি)
অনুপম খের : এই সময়টাতে আপনার কি নিজের সঙ্গে কথা হতো, কিংবা আপনি কি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন ঠিক কোন ধরনের মানুষ আপনি?
নাসিরউদ্দিন : না, ওই তিন বছর আমি প্রকৃতই আনন্দ করে কাটিয়েছি। অনেকটা জান্নাতের মতো অনুভূতি হতো এবং যেকারণে ওই তিন বছরকে আমি খুব বেশি কাজে লাগাতে পারিনি যতোটা ওম (পুরি) পেরেছিলো। ওই তিন বছরে ওমের যে উন্নতি হয়েছিলো, তা দেখার মতো।
অনুপম খের : ওম আপনার সহপাঠী ছিলেন?
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ, সহপাঠী ছিলো। ও পাতিয়ালার খুব দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছিলো। একজন অভিনেতা, একজন ব্যক্তি হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস ও নিজের ক্ষমতা দরকার; এসব কিছুতে ওই তিন বছরে ওমের যে বিকাশ ও পরিবর্তন হয়েছিলো তার কিছুই আমার ক্ষেত্রে হয়নি। তিন বছর শেষ হওয়ার পর আমি অনেক বড়ো ধাক্কা খাই- আমি তো সেরকম অভিনেতাই রয়ে গেলাম, যেরকম এসেছিলাম এখানে! এই তিন বছরে আমার নিশ্চয় আরো উন্নতি করা দরকার ছিলো।
অনুপম খের : নাসির সাহেব, এই মুহূর্তে ওম’জিকে এখানে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
নাসিরউদ্দিন : আরে ডাকো ওমজিকে।
অনুপম খের : বন্ধুরা নাসির সাহেবের সঙ্গে খুব অসাধারণ আলোচনা চলছে; কিন্তু এই মহফিলে আরেক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি এখনো বাকি আছে; এই মুহূর্তে আমার যে মিত্র এখানে আসতে যাচ্ছেন তার ক্ষমতা ও শৈল্পিক দক্ষতা এক নুরানি অনুভবের মতো। তার অবয়বের মধ্যেই এতো শক্তি আছে যে, তার উপস্থিতিই আপনাকে মগ্ন করে দিতে পারে। দুনিয়ার প্রভাবশালী অভিনেতাদের একজন- প্লিজ ওয়েলকাম ওম পুরি। পুরি সাহেব, আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
ওম পুরি : কী বলো!
অনুপম খের : স্যার যে ফ্রেমে আমি আপনাকে ও নাসির সাহেবকে দেখছি, আফসোস হচ্ছে, যদি আমি এই চেয়ারের বদলে আপনাদের মাঝখানে বসতে পারতাম। এ এক ধনরত্নের ভাণ্ডার! আমি এই ফ্রেমকে আজীবন ধরে দেখে যেতে পারি। ওম স্যার আপনি আমাকে এমন সন্দেহের দৃষ্টিতে কেনো দেখছেন?
ওম : ভাই, ধনরত্নের ভাণ্ডার আবার লুটে নেবে না তো?
অনুপম খের : স্যার, এই ধনরত্নটাও যদি লুটতে না পারি, তবে অভিনেতা হয়ে লাভ কী হলো!
ওম : তাও ঠিক।
অনুপম খের : আপনার বিষয়ে নাসির সাহেব বলছিলেন; আর আমিও অনেকটা জানি, আপনার উঠে আসা অনেকটা আমাদের মতোই নিম্নবর্গীয় পরিবার থেকে; কিন্তু আপনি অভিনেতা হওয়ার কথা কী করে ভাবলেন?
ওম : এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার। স্কুলে যেমন কেউ কাবাডি, হকি খেলে, তেমনই আমি তিনটি নাটিকা করেছিলাম; কিন্তু সেসময় এটা মাথায় ছিলো না যে বড়ো হয়ে অভিনেতা হতে হবে। যখন স্কুলে ছিলাম তখন আসলে আমি আর্মিতে ভর্তি হতে চাইতাম। অভিনয়ের শখটা আমার কলেজে তৈরি হয়। তার কারণ হলো, পাতিয়ালাতে কলেজে পড়ার সময় ‘ইয়ুথ ফেস্টিভাল’ হতো, সেখানে একবার আমি নাটকে অংশগ্রহণ করি। সেখানে বিচারকদের একজন ছিলেন হারপাল টিওয়ানা, যিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’ থেকে পড়েছিলেন। উনি হঠাৎ বললেন, তুমি আমাদের থিয়েটারে জয়েন করো। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ আমি দিনে চাকরি করি, আর রাতে কলেজে পড়ি। উনি বললেন, কী চাকরি করো তুমি? আমি বললাম, কলেজের ল্যাব সহকারী। টিওয়ানাজি বললেন, তুমি দিনে পড়াশোনা করো, আর রাতে আমাদের থিয়েটারে কাজ করো- ওটাই তোমার চাকরি। আমি তো খুব খুশি। উনি আরো বললেন, কতো টাকা বেতন পাও? আমি বললাম, একশো পঁচিশ। হারপাল সাহেব বললেন, আমি দেড়শো দেবো, তুমি চলে আসো। তখন এই আমি-ই একমাত্র অভিনেতা ছিলাম, যে ওই থিয়েটারে কাজ করে টাকা পেতো।
অনুপম খের : তো আপনি আর্মিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা কেনো বাদ দিলেন?
ওম : যখন নাটকে কাজ করতে শুরু করলাম তখনই ওটা বাদ হয়ে গেলো। আসলে ছোটোবেলায় আমি চুপচাপ ছিলাম, প্রচণ্ড অন্তর্মুখী। আর প্রেমের ব্যাপারে তো মেয়েদের চেয়েও বেশি লজ্জা ছিলো আমার। চোখ তুলে তাকাতেই পারতাম না; ইচ্ছে হতো তাকাই কিন্তু চোখ উঠতোই না।
অনুপম খের : দুজন লাজুক মানুষ যারা অভিনেতা হতে চাইতো; পরে দেখা গেলো তারা ভীষণভাবে বহির্মুখী।
ওম : তখন আমার মনে নানা প্রশ্ন আসতো, জীবনে এই যে বৈষম্য, কেনো মানুষের কষ্ট হয়, কেনো দুনিয়াতে এতো অশান্তি? কেনো কেউ ধনী আর কেনোইবা কেউ গরিব? এ ধরনের নানা জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতো সবসময়। মানুষ কখনো কখনো কিছু বলতে চায় বা যোগাযোগ করতে চায় বাকি পৃথিবীর সঙ্গে; সেসময় আমরা সেটা নাটকের মাধ্যমে করতে চাইতাম। এতে যে সুখ অনুভূত হতো, দেখা গেলো পরবর্তী সময়ে তা একপ্রকার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিলো।
অনুপম খের : আপনি অনেকগুলো ছোটোখাটো চাকরি করেছেন, কলেজের ল্যাব সহকারী তো আছেই। আর কী কী করেছেন আপনি?
ওম : উকিলের মুনশি ছিলাম। একবার হলো কী, চণ্ডীগড়ে আমার একটা নাটক করতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু উকিল সাহেব কোনোভাবেই আমাকে তিন দিনের ছুটি দেবেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে করবো না এই চাকরি, আমার হিসাব চুকিয়ে দেন। তো সেই চাকরি ছেড়ে চলে আসলাম। পরে কলেজের ছাত্ররা যখন জানলো, আমি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি তারা প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বললো। প্রিন্সিপাল তখন কলেজের অধ্যাপকদের জিজ্ঞেস করলেন, কলেজে কোনো চাকরি ফাঁকা আছে কি না? অধ্যাপকরা বললেন, ল্যাব সহকারীর পদ ফাঁকা আছে। কিন্তু আমি তো কলা বিভাগের ছাত্র, বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই! প্রিন্সিপাল বললেন, আরে কোনো ব্যাপার না, ছাত্ররা নিজেরাই চেয়ে নেবে, নীল শিশিটা দে ভাই, লাল শিশিটা দে ভাই।
অনুপম খের : অসাধারণ! আপনার জীবনে তাহলে এরকম অনেকেই আছে, যারা আপনাকে যতোটুকু পেরেছে সাহায্য করেছে?
ওম : আরে, এ রকম প্রচুর মানুষ আছে। আমার বাবা-মা তো আমাকে শুধু জন্ম দিয়েছেন। আমাকে বড়ো করে তুলেছে আমার বন্ধুরা-এ রকম একজন আমার পাশে বসে আছে এখন। আমি আমার সেই প্রত্যেক বন্ধুর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।
অনুপম খের : আপনি এন এস ডি’তে কীভাবে ভর্তি হলেন?
ওম : আমি একদিন টিওয়ানা সাহেবের কাছে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম, আমি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে ভর্তি হতে চাই। ওই সময় আমি একটি সরকারি চাকরি করতাম, নিম্ন শ্রেণির কেরানি। টিওয়ানা সাহেব আমাকে নিরুৎসাহিত করলেন। তিনি বললেন, দেখো, সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন। তুমি গরিব পরিবারের সন্তান, থিয়েটারে কিন্তু কোনো টাকা নেই। তার পরও আমি লুকিয়ে আবেদন করেছিলাম এন এস ডি’তে। এরপর ইন্টারভিউ দিলাম এবং সিলেক্ট হয়ে গেলাম। তারপর টিওয়ানা সাহেবকে বললাম, আমার তো সিলেকশন হয়ে গেছে, আমি চললাম। ওখানে দুইশো টাকা করে বৃত্তি পাওয়াও শুরু হলো; আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলাম। খুব হিসাবনিকাশ করে ঝুঁকি নিয়েছিলাম জীবনে।
অনুপম খের : কারণ হারানোর বোধহয় কিছু ছিলো না। নাসির সাহেব, ওমজির সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি মনে পড়ে?
নাসিরউদ্দিন : ওম আর যশপাল, দুজনেই হরিয়ানা থেকে এসেছিলো। স্কুলে প্রথম দিন আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম, তিন তলায় ক্লাস ছিলো। তিন তলায় আগে থেকে ওম দাঁড়িয়ে ছিলো, আর যশপাল বাথরুমের মধ্যে ছিলো। দুজনেই সাদা কামিজ পরা। তো যেই আমি তিন তলায় উঠলাম, ওম এগিয়ে এসে বললো, হাই মাই নেম ইজ ওম পুরি।
অনুপম খের : ইংরেজিতেই বললেন ওমজি?
নাসিরউদ্দিন : হ্যাঁ ইংরেজিতেই। আমি বললাম মাই নেম ইজ নাসির শাহ্। তখনই আমার মনে হয়েছিলো দারুণ গলার স্বর এর! ইশ, যদি আমার আওয়াজটাও এমন হতো!
অনুপম খের : আমি দর্শককে এটা জানাতে চাই, যশপাল এনাদের সহপাঠী ছিলেন এবং খুব ভালো একজন অভিনেতা। পুরি সাহেব আপনার কি নাসির সাহেবের সঙ্গে প্রথম স্মৃতির কথা মনে আছে?
ওম : কতোদিনের বন্ধুত্ব আমাদের নাসির?
নাসিরউদ্দিন : প্রায় ৪৩ বছরের।
ওম : সেই ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
নাসিরউদ্দিন : না ভাই, ১৯৭০ থেকে।
ওম : ৪০ বছরেরও উপরে। তো সেই সময় নাসির সাহেব খুব লোভী হয়ে উঠলেন। আসলে সে না, তার সেসময়ের গার্লফ্রেন্ডই তাকে উসকানি দিলো, ভালো অভিনেতা তো তোমরা আছোই, তাই পরবর্তী সময়ে চরিত্র পেতে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তাই তুমি বরং নির্দেশনার কোর্সটি করে রাখো। তো উনি ও যশপাল নির্দেশনার কোর্স নিয়ে নিলেন। আর আমরা অভিনয়েই থেকে গেলাম। এটা দ্বিতীয় বর্ষের ঘটনা। সেসময় ‘সূর্যমুখ’ নামে একটি নাটকের জন্য কাস্টিং চলছিলো। প্রধান চরিত্রে যশপাল পড়েছিলো আর আমাদের কোনো সুযোগই দেওয়া হচ্ছিলো না। এসব দেখে আমরা স্বভাবতই ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলাম। আমি সাহস করে অলকাজি সাহেবকে ক্লাসের মধ্যে ইংরেজিতে বললাম, ‘স্যার আই ওয়ান্ট টু ছে সামথিঙ।’ উনি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন, শালা এই প্রথম কোনো শব্দ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো। আমি আরো বললাম, ‘স্যার, উই আর অ্যাক্টিং স্টুডেন্টস, দে আর ডিরেকশান স্টুডেন্টস। দ্য প্রেফারেন্স শুড বি গিভেন টু দ্য অ্যাক্টরস। ইউ আর নট গিভিং আস অ্যা চান্স টু রিড দ্য মেইন রোল। হি ইজ অ্যা ডিরেকশান স্টুডেন্ট, সো দ্য চান্স শুড বি গিভেন টু আস।’
পুরো বাক্য ইংরেজিতে বলে দিলাম। অলকাজি সাহেব ১০ সেকেন্ডের জন্য তোতলালেন আর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল পড়ে এসো। তো পরের দিন ওই রোল আমি পড়লাম আর পেয়েও গেলাম। এরপর আমি দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি নাসিরউদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর উনি একটি বাক্য বলেছিলেন।
অনুপম খের : এক মিনিট, নাসির সাহেব ওই বাক্যটি আপনার মনে আছে?
নাসিরউদ্দিন : (নাসির সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে) আই নিউ ইউ উড স্পিক।
ওম : কী অসাধারণ এক বাক্য- আই নিউ ইউ উইল স্পিক ওয়ান ডে।
অনুপম খের : বাহ্! (সবার হাততালি)
ওম : কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের শুরু কীভাবে হলো তা আপনাদের বলি। যেহেতু আমি পাঞ্জাবি মাধ্যমে পড়ালেখা করেছি, তাই ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে পড়তে আমার ভীষণ সমস্যা হচ্ছিলো। কারণ ওখানে ইংরেজিতে পড়ানো হতো। আর এই ভাইজান কনভেন্টে পড়ালেখা করেছেন, আর তার ইংরেজিও দুর্দান্ত। তো আমার এই ইংরেজি নিয়ে ভীষণ অস্বস্তি ছিলো। অলকাজি সাহেব এটা জানতেন এবং আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিলেন।
অনুপম খের : বন্ধুরা, অলকাজি সাহেব আমাদের তিন জনেরই শিক্ষক ছিলেন। উনি পরিচালনা পর্ষদের প্রধানও ছিলেন এন এস ডি’র ।
ওম : তো উনি বন্ধুদের বললেন, খোঁজ লাগাও এই ছেলে কেনো এমন মন খারাপ করে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ায়। আমি তখন মনে মনে ভাবছি, অনেক হয়েছে ভাই, আমি আর থাকছি না। কারণ আমার পক্ষে আর যাইহোক ইংরেজিতে পড়া বলা সম্ভব না। তো অলকাজি সাহেব বললেন, তোমার দরকার নেই ইংরেজিতে বলার, তুমি হিন্দিতেই বলো আর ইংরেজি উন্নত করার জন্য পত্রিকা পড়ো জোরে জোরে, বন্ধুদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলো। তোমার ভুল ইংরেজি বলায় যদি ওরা হাসাহাসি করে তো চিন্তা করো না। আমি তখন অক্ষরে অক্ষরে সেই সব কথা মেনে চলেছিলাম- সেই ওম পুরি এখন ২২-২৩টি ইংরেজি চলচ্চিত্র করে ফেলেছে।
নাসিরউদ্দিন : কে ভেবেছিলো, দিল্লির এক পাঞ্জাবির চরিত্রে আমাকে ভাবা হবে আর ইংল্যান্ডের মুসলমানের চরিত্র পাবে ওম!
অনুপম খের : এই কারণে নাসির সাহেব আমি বলি, ‘জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে।’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে চেহারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ৭০-৮০’র দশকে তো চেহারায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেতো। চেহারা ভালো কি না, চুল আছে কি না, বুক চওড়া কি না- নাসির সাহেব এ নিয়ে কোনো প্রকারের অস্বস্তি আপনার ছিলো কি?
নাসিরউদ্দিন : অস্বস্তি অবশ্যই ছিলো। যদিও সেসময় শত্রুঘ্ন সিনহা এবং অমিতাভ বচ্চনের মতো ক্যারেক্টারওয়ালা চেহারাও এসে গিয়েছিলো- যা আমাদের সাহস বাড়িয়েছিলো অনেকটাই। শুধু সুন্দর চেহারা নয়, বরং চরিত্রের প্রয়োজন মাফিক চেহারাও কদর পাবে দর্শকের কাছে। আর আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার চেহারা ফিল্মস্টারদের মতো না। যদিও এটা মেনে নিতে আমার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিলো। তবুও দিনশেষে এটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। তবে এতে আমার সুবিধা যেটা হয়েছিলো, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যেকোনো চরিত্রের চাহিদামতো আমি আমার চেহারা বদলে ফেলতে পারি। আর নায়কোচিত আকর্ষণের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে আমার মতে, একজন পুরুষ কতোটা আকর্ষণীয় সেটা নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্বের ওপর। ওম আর আমার এন এস ডি’তে পড়ার সময়ে একটা ছবি আছে, যা দেখে শাবানা আজমি আমাদের একবার ডেকে বললেন, এ রকম বদসুরত দুজন মানুষের অভিনেতা হওয়ার স্পর্ধা হলো কীভাবে! (সম্মিলিত হাসি) যাইহোক, আমার কাছে মনে হয় আত্মবিশ্বাসটাই শেষ কথা।
অনুপম খের : আর দেখতে সুন্দর যেহেতু আমরা কেউই ছিলাম না; সম্ভবত সেকারণেই আমরা আমাদের দক্ষতার ওপরে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম। পুরি সাহেব আপনার কি মনে হয়?
ওম : একদম। দেখুন, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার কাছে আমরা ভীষণ কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে অভিনয় কী, তা ওখানে শিখেছি। আর নাসির তো বললোই, যেকোনো চরিত্রের চাহিদামতো আমরা আমাদের চেহারা বদলে ফেলতে পারি। আমরা এতো ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছি, আমাদের নকল করা বেশ কঠিনই হবে। চেহারা সর্বস্ব অভিনেতাদের সঙ্গে এন এস ডি’র ছাত্রদের এটাই পার্থক্য।
অনুপম খের : নাসির সাহেব, একে অন্যের প্রতি কখনো ঈর্ষা অনুভব করেছেন?
নাসিরউদ্দিন : করেছি মানে, অবশ্যই করেছি। ইংরেজি চলচ্চিত্র কেনো ওম পাচ্ছে, আমি পাচ্ছি না! কিন্তু খুশিও হয়েছি এ ভেবে যে, আমি পাচ্ছি না, কিন্তু ওম-ই তো পাচ্ছে।
ওম : দেখুন, এটা সবার জানা দরকার, যখন অর্ধসত্যর জন্য আমি কারলভি ভেরি’তে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি পেলাম, তখন সংবাদপত্র নাসির সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আপনার অনুভূতি কী? তখন নাসির সাহেব বলেছিলেন, আমি ওম-এর জন্য গর্ব অনুভব করি, কারণ ও সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি।
অনুপম খের : আচ্ছা ঈর্ষা কিন্তু অনেক সময় ভালো ফলও বয়ে আনে।
নাসিরউদ্দিন : অবশ্যই।
ওম : দেখুন, দুই রকম ব্যাপারই হয়। একটা হলো হিংসা আর অন্যটি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। নাসির সাহেবেরটা হলো প্রতিযোগিতামূলক অনুভূতি।
নাসিরউদ্দিন : না, আমি হিংসা অনুভব করি। (সম্মিলিত হাসি) আমি নিশ্চিত অর্ধসত্যতে ওম যে অভিনয়টা করেছে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব না।
ওম : আর পার এবং স্পর্শতে ও যে অভিনয় করেছে, তা আমার পক্ষে করা সম্ভব না।
নাসিরউদ্দিন : না, ওটা তুমি করতে পারবে।
অনুপম খের : আর আপনারা দুজন যা করেছেন তার কিছুই আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি তো হিংসায় জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। ওমজি, নাসির সাহেব আপনারা কি একে অন্যের কাজ অনুসরণ করেন, মতামত দেন?
ওম : অবশ্যই আমরা সেটা করি এবং আমরা যথেষ্ট সমালোচনাও করি একে অন্যের। আমরা মুখের ওপরেই বলে দিই, তোমার ওই চলচ্চিত্রটা আমার ভালো লাগেনি, ফালতু অভিনয় করেছো তুমি।
নাসিরউদ্দিন : সম্ভবত ওমই একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি কোনো ভয় ছাড়াই বলতে পারি, ভাই তোমার ওই কাজটি আমার ভালো লাগেনি।
অনুপম খের : পুরি সাহেব আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিক কে?
নাসিরউদ্দিন : পুরি সাহেব অনেক বেশি রোমান্টিক; প্রেমিকের মেজাজ পেয়েছেন পুরি সাহেব। কিন্তু লুকিয়ে রাখেন। উনি মেয়েদের জন্য কখনো ফুল নিয়ে যেতেন, কখনো ফল, কখনোবা মিষ্টি। আমি কখনো এসব করিনি।
অনুপম খের : আপনার প্রয়োজন পড়তো না, নাকি আপনি করতেন না?
ওম : ওর প্রয়োজনই পড়তো না। আর আমাকে মেহনত করতে হতো। তার ইংরেজির এমনই প্রভাব ছিলো যে, সম্মাননীয় মহোদয়াদের তা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো। আর আমাদের ভিক্ষা চাইতে হতো, আল্লাহর নামে রাজি হয়ে যান।
অনুপম খের : নাসির সাহেব জীবনের খেরোখাতা যদি খোলেন; তবে কী মনে হয়? কী হারিয়েছেন, কী পেয়েছেন?
নাসিরউদ্দিন : বাবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটা ছিলো সেটা হারিয়েছি; এছাড়া শুধু পেয়েই গেছি। এর জন্য নিজেকে আমি অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি। অবশ্য কিছুটা প্রশংসা আমার নিজেরও প্রাপ্য, কারণ সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত ছিলাম।
অনুপম খের : পুরি সাহেব আপনার কী মনে হয়?
ওম : না, জীবনের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। কী বিশাল এক পথ চলা, কোথা থেকে শুরু করেছিলাম আর কোথায় পৌঁছে গেছি! কিন্তু কিছু অপ্রাপ্তি তো থেকেই যায়। কারণ সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি তো মৃত্যুর সমার্থক। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে এতো অসাধারণ সব অভিনয় দেখেছি যে, মাঝে মাঝে আফসোস হয়, ওই সব সুযোগ আমরা কেনো পাই না। কারণ আমাদেরও তো সামর্থ্য আছে, ওই সব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার।
নাসিরউদ্দিন : তবে আমি এভাবে বিষয়টাকে দেখি যে, আমরা এক বিশাল পট পরিবর্তনের অংশ। আমাদের ভাগে যা পড়েছে তাও নেহাত কম নয়।
অনুপম খের : নাসির সাহেব, আপনার বিরুদ্ধে আমার একটা অভিযোগ আছে। আপনি ওম পুরিজিকে ঘড়ি উপহার দিয়েছেন, আর উনি জ্বালানোর জন্য সেটা তিনবার আমাকে দেখিয়েছেন। আপনি শীঘ্রই আমাকে একটা উপহার দেবেন, যেনো আমিও সবাইকে দেখাতে পারি, এটা নাসির সাহেব আমাকে দিয়েছেন।
নাসিরউদ্দিন : অবশ্যই, অবশ্যই।
ওম : ও আমাকে অনেকবার উপহার দিয়েছে। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো ভালো কোনো শার্ট আমার ছিলো না। তখন ও আমাকে ডেকে বললো, তোমার শার্ট খোলো আর এটা পরো। আমি ওর কাছে অনেক ঋণী। না, সত্যি বলছি। গোবিন্দ নিহালানি (এড়ারহফড় ঘরযধষধহর), শ্যাম বেনেগাল আমার পথপ্রদর্শক। কিন্তু যদি নাসিরউদ্দিন শাহ্ আমাকে পিছন থেকে ধাক্কাটা না দিতো, তবে আমি এতো দূর পৌঁছাতে পারতাম না। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে পড়া শেষ করার পর ও দ্রুত ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছিলো। তো একবার ছুটিতে এসে ও আমার সঙ্গে ছিলো। এসে আমাকে বললো, তোমাকে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতেই হবে। আমি বললাম, ভাই আমার কাছে অর্থ, কড়ি, পয়সা কিছুই নেই। নাসিরউদ্দিন শাহ্ বললো, প্রয়োজনে তুমি ভিক্ষা করো, ধার করো, কিংবা চুরি করো। কিন্তু ভর্তি তোমাকে হতেই হবে।
অনুপম খের : পুরি সাহেব আজকাল এমন বন্ধুত্ব দেখা যায় না, এর বুনিয়াদটা আসলে কী?
ওম : এর কারণটা হলো আত্মবিশ্বাস। আমরা দুজনই জানি, আমাদের ভিতরে কিছু আছে। দেখুন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমরা ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত অভিনেতা। আমরা তিন বছর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে আর দুই বছর ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পড়েছি, মোট পাঁচ বছর।
অনুপম খের : ওমজি আপনার জীবনে এমন কিছু কী ঘটেছে, যা দেখার পর আপনার মনে হয়েছে, আরে এই ঘটনা যদি ঘটতে পারে তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে!
ওম : শুনুন, ছয় বছরের ছেলে, যে কিনা চায়ের দোকানে গ্লাস ধুতো, সে যদি আজ ওম পুরি হয়ে যেতে পারে; তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে!
নাসিরউদ্দিন : আমিও ওমকেই উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরবো। দেখুন, জীবনে আমি এমন অনেক কিছু চেয়েছিলাম, যা আমি পাইনি বা পারিনি। কিন্তু ওম সেটা অর্জন করেছে। আমাদের জীবনের সফর ও গন্তব্য কেমন হবে তা কেইবা বলতে পারে? আশ্চর্য হলেও সত্য, ওম সেটা বুঝতে পেরেছিলো একটা পর্যায়ে এসে। যাইহোক, প্রত্যেকেই তার জীবনের একটা না একট রাস্তা পেয়ে যায়, এবং সেই পথে যাই আসুক না কেনো সেটা তার গ্রহণ করা উচিত। কারণ জীবনে সত্যি যেকোনো কিছু হতে পারে।
(এই পর্যায়ে লটারির মাধ্যমে দর্শকের আসন থেকে প্রিয়াঙ্কা নামে একজন অভিনয় শিক্ষার্থীকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়)
অনুপম খের : প্রিয়াঙ্কা বসুন। কখনো ভেবেছিলেন এই মহান দুজন অভিনেতার সঙ্গে এভাবে মঞ্চ ভাগাভাগি করতে পারবেন?
প্রিয়াঙ্কা : না, কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারবো, এই ইন্ডাস্ট্রিতে এসে আমার সবার প্রথম অর্জন এই দুই জনের দেখা পাওয়া।
অনুপম খের : প্রিয়াঙ্কা, আপনি পুরি সাহেবকে কোনো প্রশ্ন করতে চান?
প্রিয়াঙ্কা : জি, আমি জানতে চাই, একজন অভিনয়শিল্পীর কী ধরনের মনোভাব-ভঙ্গি (attitude) থাকা উচিত, যা তার কাজে আসবে?
ওম : বাবা, অভিনয় আমরা জীবন থেকে শিখি। অভিনয়ের মাধ্যমে জীবনকে আমরা পুনরুজ্জীবন দান করি। সে কারণে রাস্তার জীবন বা সংবাদপত্রে যে জীবনের খোঁজ আমরা পাই কিংবা চলচ্চিত্রে যে জীবন দেখি, তাকে অনুভব করো, নিজের ভিতর অধিগ্রহণ করো। এটা একটা কম্পিউটারের মতো, একবার ভিতরে নেওয়া হলে, যখন দরকার হবে সুইচ অন করে নিতে পারবে।
অনুপম খের : নাসির সাহেবকে কোনো প্রশ্ন করতে চান?
প্রিয়াঙ্কা : আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, অভিনয় করার সময় একটি চরিত্রকে নিজের মধ্যে কী করে আনবো?
নাসিরউদ্দিন : প্রশ্নটি করার জন্য ধন্যবাদ। দেখুন, আপনি যে চরিত্রেই অভিনয় করুন না কেনো, আপনার উচিত তা নিজের মধ্যে খোঁজা। বাইরের কোনো ইমেজকে নিজের মধ্যে স্থাপন করা কিংবা বিশেষ করে কোনো চলচ্চিত্র থেকে তো কখনোই তা ধার করা যাবে না। রাজা থেকে ভিখারি পর্যন্ত, একজন মানুষের ভিতরে সব ধরনের চরিত্র বিরাজমান। সেটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
অনুপম খের : সুধী, আজকের এই অনুষ্ঠান জীবনের কোনো উপন্যাসের থেকে কম কিছু নয়। এই মহান দুই শিল্পীর জীবন এক অমূল্য রতনের মতো, যা তারা আমাদের সঙ্গে আজ ভাগাভাগি করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, এই অমূল্য রতন আমাদের জীবনে এক নতুন অনুভব আনয়ন করবে। এই বলে আজ আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। মনে রাখবেন, রাস্তা বানাতে গেলে পাহাড়কে কাটতেই হয়, বড়ো বড়ো ঘর ছোটো ছোটো পাথর দিয়েই তৈরি হয়। যদি কয়লার খনিতে হীরা পাওয়া যেতে পারে, তবে জীবনে যেকোনো কিছু হতে পারে।
অনিক ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে চাকরি প্রার্থী।
anikislam.ru@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন