জ্যঁ লুক গদার ভাব-ভাষান্তর : শফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সমালোচনার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না
জ্যঁ লুক গদার ভাব-ভাষান্তর : শফিকুল ইসলাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। অর্থনীতির পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ে শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রেও। কাঁচা ফিল্ম নেই, স্টুডিওগুলো গুঁড়িয়ে গেছে; কিন্তু তাই বলে কি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিবে স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা? না, বরং যা যেভাবে আছে তা নিয়েই স্বপ্ন বুনতে শুরু করে তারা, জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের নব্য-বাস্তববাদ ধারা। ইতালিতে শুরু হওয়া এ ধারার স্রোত কিছুদিন পরে গিয়ে পড়ে ফ্রান্সেও। এ সময় ফ্রান্সে অবশ্য চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখিও চলছিলো সমান তালে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে জ্যঁ জর্জ আরিয়েল-এর সম্পাদনায় ‘ফিল্ম রিভিউ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন প্রকাশ হয়নি এটি। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আঁন্দ্রে বাঁযার নেতৃত্বে জ্যঁ লুক গদার, ক্লদ শ্যাব্রল, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, অ্যাঁলা রেঁনে, লুই মালা প্রমুখ তরুণদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকা। এর আধেয়তে ছিলো চলচ্চিত্র সমালোচনা, নির্মাতাদের কথা ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত নানা লেখালেখি। কিন্তু শুধু লিখেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না এই তরুণরা। একপর্যায়ে ফ্রান্সের চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে তারা সচেষ্ট হন। যে হাতে কলম ধরেছিলেন, সেই হাতেই তারা ক্যামেরা তুলে নেন। নতুন এই ধারাকে বলা হলো Camera-stylo; অর্থাৎ, লেখকের কাছে যেমন কলম, একজন নির্মাতার কাছে তার ক্যামেরা। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হলো ফ্রান্সের নবতরঙ্গ চলচ্চিত্রধারা বা ফ্রেঞ্চ নিউওয়েভ বা নুভেলভাগ। সামনে থেকে এই ধারাকে নেতৃত্ব দেন খ্যাতিমান নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, সিনেমাটোগ্রাফার, সম্পাদক, প্রযোজক, অভিনেতা ও সমালোচক জ্যঁ লুক গদার।
ফ্রান্সের এক ফ্রাঙ্কো-সুইস পরিবারে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর গদারের জন্ম। তার জন্মের চার বছরের মাথায় পুরো পরিবার সুইজারল্যান্ডে চলে যায়। সেখানেই শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। এরপর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গদার প্যারিসে ফিরে ঐতিহ্যবাহী লিসি বুফোন স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় প্যারিসের বেশ কয়েকটি সিনে-ক্লাবে তার অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে ‘সিনেমাথেক’, ‘সি সি কিউ এল’ ও ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার সিনে ক্লাব’ উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তার পরিচয় হয় জ্যাকুয়েস রিভেটি, ক্লদ শ্যাব্রল, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো প্রমুখ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সঙ্গে। আর সে সুবাদে চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে নাম লেখান গদার; প্রকাশ করেন চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘গ্যাজেট দ্যু সিনেমা’।
এরপর ১৯৫২-তে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান গদার। সেখানে তিনি একটি বাঁধে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন। এই কাজ করার সময়ই বাঁধটি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের চিন্তা তার মাথায় আসে। সে অনুযায়ী ৩৫ মিমিতে তিনি নির্মাণ করেন অপারেশন কনক্রিট; এরপর একে একে অল দ্য বয়েস আর কলড প্যাট্রিক (১৯৫৭), চার্লট অ্যাট সান জুলস (১৯৫৮) ইত্যাদি। এরপর তার নাম-ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গদারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ব্রেথলেস (১৯৬০)। এটি ‘নবতরঙ্গ’কে আরো শক্তিশালী করে। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—লি পিটিট সোলড্যাট (১৯৬০), অ্যা উইম্যান ইজ অ্যা উইম্যান (১৯৬১), মাই লাইফ টু লিভ (১৯৬৩), কনটেম্পট (১৯৬৩), অ্যা মেরিড উইম্যান (১৯৬৪), পিয়েরট লি ফো (১৯৬৫), মেইড ইন ইউ. এস. এ. (১৯৬৬), উইক য়েন্ড (১৯৬৭), ওয়ান প্লাস ওয়ান (১৯৬৮), ব্রিটিশ সাউন্ডস (১৯৬৯), ওয়াইন্ড ফ্রম দ্য ইস্ট (১৯৭০), স্ট্রাগল ইন ইটালি (১৯৭১), নাম্বার টু (১৯৭৫), হাউ’স ইট গোয়িং (১৯৭৬), প্যাশন (১৯৮২), ডিটেকটিভ (১৯৮৫), কিং লিয়ার (১৯৮৭), নিউ ওয়েভ (১৯৯০), জেএলজি/জেএলজি (১৯৯৪), গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪)। গদার ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য বিশেষ অস্কার পান। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জে. হবারম্যান-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তিনি বর্তমানে নতুন চলচ্চিত্রের কাজ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফিল্ম সোসাইটি অব লিঙ্কন সেন্টার’-এর চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘ফিল্ম কমেন্ট’-এর জন্য গদারের এই সাক্ষাৎকারটি নেন এর লেখক ও ইমেরিটাস সম্পাদক গ্যাভিন স্মিথ। ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় ভাব-ভাষান্তর করা হয়েছে।
গ্যাভিন স্মিথ : আপনার নির্মিত আগের যেকোনো চলচ্চিত্রের চেয়ে হিস্তোরি(স) দ্যু সিনেমা (চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে তৈরি করা দুইশো ৬৬ মিনিটের একটি ভিডিও প্রোজেক্ট) থেকে শুরু করে পরের চলচ্চিত্রগুলো অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। এগুলোর প্রতিটি অনুভূতিই যেনো চলচ্চিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একেকটি প্রচেষ্টা।
জ্যঁ লুক গদার : হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। পিকাসোর একটি কথা আমাকে খুব ভাবিয়েছিলো—তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি ততোদিন পর্যন্ত ছবি আঁকবো, যতোদিন আঁকাআকি আমাকে ছেড়ে না যায়।’ আমি সে সুরেই তাল মিলিয়ে বলতে চাই, আরো কিছু চলচ্চিত্র না করা পর্যন্ত, আরো কয়েক দশক কাজ না করা পর্যন্ত, চলচ্চিত্র আমাকে ছেড়ে যাবে না। অর্থাৎ এটাই চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার মিলন। কিন্তু এই মিলন যা চাই তার সঙ্গে নয়; কারণ আমি জানিইনা আমি কী চাই; বরং আমার যা আছে তার ভিত্তিতে আমি যা চাই, তার সঙ্গে মিলন। এবং আমাকে সেই সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, যাতে এর বেশি কিছু চাইতে না হয়। তবে সেটাই করা উচিত, যা তুমি সত্যিই পছন্দ করো, অবশ্যই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। এটাই সবচেয়ে সহজ দৃষ্টিভঙ্গি। যখন আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, তখন সেটা ভালো না হলেও আমি বিরক্ত হই না। চলচ্চিত্রটি এমন হওয়া উচিত, এমন হলো না কেনো—এটা ভেবে ক্ষিপ্ত হওয়া যাবে না। বরং নিজের মতো কাজ করে যেতে হবে।
স্মিথ : আপনি যে রকম চলচ্চিত্র করেছেন, সেগুলো তো কাউন্টার সিনেমা?
গদার : এটা সত্যিই আজ বিরুদ্ধবাদী; কিন্তু এটি নিয়ে আমি খুব বেশি উদ্বিগ্ন নই। যখন আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, তখন কখনোই ভাবি না এটা হলিউড বা ফরাসি চলচ্চিত্রের বিপরীতে নির্মিত। এটা শুধুই একটি চলচ্চিত্র, যা আমি নির্মাণ করেছি। জানি, অবশ্যই আমি তাদের বিরোধী, কিন্তু এটাও ঠিক চলচ্চিত্রশিল্প একটি বিশাল জায়গাও বটে।
স্মিথ : আপনার গোটা কর্মজীবন এবং একজন সমালোচক হিসেবেও আপনার কাজ চলচ্চিত্রের সঙ্গে মধ্যস্থতার কথাই বলে।
গদার : আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সমালোচনার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। কারণ আমি যখন কোনো চলচ্চিত্র দেখা শুরু করি, তখন সেটাও নির্মাণের অংশ হয়ে ওঠে। যখন আমি হল হার্টলি’র (আমেরিকান চলচ্চিত্রনির্মাতা) সদ্য নির্মিত চলচ্চিত্রটি দেখি, তখন সেটাও চলচ্চিত্র নির্মাণেরই অংশ। আমি নিজেই তো চলচ্চিত্র নির্মাণের অংশ এবং চারপাশে যা ঘটছে তার দিকে অবশ্যই আমাকে নজর রাখতে হবে। আমার মতে, প্রতি বছর বড়োজোর একটি আমেরিকান চলচ্চিত্র দেখাই যথেষ্ট। কারণ এগুলো কমবেশি সব একই রকম। আসলে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, এটি তাকে দেখারই একটি প্রক্রিয়া।
স্মিথ : আচ্ছা, চলচ্চিত্র-নির্মাণ কি আপনার কাছে অতি-কল্পনা (ইউটোপিয়া) মনে হয়?
গদার : হ্যাঁ, আমি মনে করি চলচ্চিত্র-নির্মাণ অতি-কাল্পনিক হওয়া উচিত। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা অতি-কাল্পনিক কিছু নয়।
স্মিথ : কিন্তু জার্মানি ইয়ার ৯০ নাইন জিরো ও হিস্তোরি(স) দ্যু সিনেমায় আপনি চলচ্চিত্রকে অকার্যকর মাধ্যম বলেছেন।
গদার : হ্যাঁ, ওটা আমার নিজস্ব মতামত।
স্মিথ : তাহলে কখন এটি অকার্যকর হয়ে পড়ে?
গদার : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকান চলচ্চিত্রকে সুযোগ করে দেয় তখনকার সময়ের শক্তিশালী ফরাসি চলচ্চিত্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। তখন তো প্যাথে, গোমন্ট, মিলস’রা সুপরিচিত; আর ম্যাক্স লিনডার তো বিরাট তারকা; তবুও যুদ্ধের পর ফরাসিরা দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে প্রথমবারের মতো আমেরিকানরা ইউরোপের কলাকুশলী ও চলচ্চিত্র বাজার দখল করে নেয়। তাছাড়া জার্মান চলচ্চিত্রের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিলো। আসলে সেসময় হলিউডের অর্ধেক কলাকুশলীই ছিলো জার্মান। এমনকি তখনকার অন্যতম বড়ো স্টুডিও ‘ইউনিভার্সাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কার্ল ল্যামেল নামের একজন জার্মান।
(অন্যদিকে আমেরিকানদের জন্য আবার দ্বিতীয় সুযোগটি আসে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী নরম্যান্ডি সৈকত দখল করে।) এর ফলে ইউরোপ একেবারেই অধীনস্ত হয়ে পড়ে। এবং আপনি এখনো ইউরোপের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখবেন, আমেরিকার অনুমতি ছাড়া তারা কিছুই করতে পারে না। এখন চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও আমেরিকা সারাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই এই সময়ে অনেক ধারণার মধ্যে গড়ে ওঠা গণতন্ত্র হারিয়ে গেছে, যা আমি আমার পরবর্তী চলচ্চিত্রে [হিস্তোরি(স) দ্যু সিনেমা] বলার চেষ্টা করবো—একটি সুনির্দিষ্ট সময়, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বাস্তবতা, এসব আসলে দেখানো হয়নি, এর উত্তরও দেওয়া হয়নি।
স্মিথ : এ প্রেক্ষাপটে সিন্ডলার’স লিস্ট সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
গদার : এর কোনো অর্থ নেই। এখানে কোনো কিছুই দেখানো হয়নি; এমনকি জার্মান সিন্ডলারের গল্পটিইও উঠে আসেনি। গল্পটি ঠিক মতো বলাই হয়নি। এটা একটা জগাখিচুড়ি হয়েছে।
স্মিথ : আপনি কি মনে করেন না, ইতালিয়ান নব্য-বাস্তববাদ ও ফরাসি নবতরঙ্গ ধারা যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে ওঠারই পরিচায়ক ছিলো?
গদার : না, সেটা তাদের শেষ বিপ্লব ছিলো। যেটাকে আমরা আঁভগার্দ বলছি। যদিও সেটা হবে আঁরিগার্দ (পিছু ফেরা)।
স্মিথ : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, ফান্সে ৬০-এর দশকে আপনার চলচ্চিত্রও আমেরিকানদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো?
গদার : আমরা ঠিক সেভাবে ভাবিনি। কারণ একই সময়ে আমরা অল্প হলেও আমেরিকান চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করেছি। উইলিয়াম ওয়াইলার, জর্জ স্টিভেনস-এর চেয়ে আমরা স্যামুয়েল ফুলার ও বাড বুয়েট টিচার’কে বেশি পছন্দ করতাম। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, অন্তত রিভেটি ও আমি বড়ো ধরনের একটা মিউজিকাল তৈরি করতে পারবো। এটা এখনো আশা করি! তবে আমরা স্বীকার করতাম, হিচকক একজন বড়ো মাপের চিত্রশিল্পী, ঔপন্যাসিক; কেবল সেলুলয়েডে হত্যা কাহিনির নির্মাতা নন। সুতরাং এটা আরো বেশি গণতান্ত্রিক ছিলো। কিন্তু এটা অতি-কাল্পনিকও, কারণ আমরা এতো ছোটো ছিলাম যে তখন আসলে কী ঘটছিলো তা বুঝিনি। এটা আজ বলতে পারছি, কারণ সম্ভবত একমাত্র আমিই বিষয়টিকে এভাবে দেখেছি। আমি ইতিহাস পড়ি কান ও চোখ দিয়ে; অন্যরা চোখ দিয়ে শুধু শব্দ পড়ে।
স্মিথ : কিন্তু আপনারা যেভাবে নির্দিষ্ট কিছু আমেরিকান চলচ্চিত্রকে সাদরে গ্রহণ করেছেন, তা কি খাল কেটে কুমির আনার মতো হয়নি?
গদার : মোটেই না। আমরা হিচকককে পছন্দ করতাম, কিন্তু শার্লি ক্লার্ক, জন কাসাভেটস অথবা এড এমশউইলারদেরও পছন্দ করতাম। সম্প্রতি আমি এক আমেরিকান সমালোচকের লেখা পড়লাম, যেখানে উনি হেলাস পুওর মুই চলচ্চিত্রটিকে স্টান বারখেজ-এর চলচ্চিত্রের সমমানের বলেছেন। এটা পড়ে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম।
আমি ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’য় যোগ দেওয়ার অনেক আগে থেকেই গ্রেগরি মারকোপুলাস আমার বন্ধু ছিলেন। যদিও তার চলচ্চিত্র আমার ভালো লাগে না। কিন্তু তাকে এবং অন্যান্য স্পষ্টভাষী চলচ্চিত্রনির্মাতাদের আমি স্মরণ করতাম। এটাই ছিলো গণতন্ত্র। আমরা কখনোই বোঝার চেষ্টা করিনি, সাম্যবাদী রাশিয়ার চেয়ে আমেরিকা ভালো গণতন্ত্রের চর্চা করে না।
স্মিথ : আপনি হিস্তোরি(স) দ্যু সিনেমার দ্বিতীয় ধাপে বলেছেন, ‘প্রযুক্তি জীবন থেকে জীবন এবং আত্মপরিচয়ের পুনরুৎপাদন ও নিকাশ করে।’ এর মানে কী?
গদার : আমাদের ভেবে দেখা দরকার, আলোকচিত্র কিন্তু উদ্ভবের সময় থেকেই রঙিন হতে পারতো; এবং সেটা হয়তো সম্ভবও ছিলো। তার পরও এটি দীর্ঘ সময় সাদাকালোই ছিলো, আর সেটা এমনি এমনি নয়। এটার একটি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিলো; কারণ ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বে কালো রঙ শোকের চিহ্ন। ফলে আমরা পেইন্টিংয়ের বাইরে প্রকৃতির ছাপটা নিচ্ছিলাম এবং নিশ্চিতভাবেই সেটাকে নিধন করছিলাম।
স্মিথ : সাদাকালো ছবি তুলে?
গদার : শুধু ছবি তুলেই; এটা ধরেই নেওয়া হয়, পাসপোর্টে ব্যবহৃত আলোকচিত্র একজন মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করে। কিন্তু এটা শুধুই একটি আলোকচিত্র, কারো পরিচয় নয়। যদিও চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে আলোকচিত্র বড়ো ধরনের পরিবর্তন আনে। এর ফলে চিত্রগুলো তখন আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ হয়, প্রথাগত বাস্তবতার আরো বেশি বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। আসলে এর মধ্য দিয়ে আমরা চিত্র থেকে প্রকৃতির পরিচয়টা মুছে দিচ্ছিলাম। কিন্তু তখনো সংস্কৃতিতে নৈতিকতা ছিলো; যেজন্য চিত্রগুলো ছিলো সাদাকালো, শোকের রঙ। এর সঙ্গে আমি আরেকটি বিষয় যোগ করতে চাই, সেই প্রথম রঙিন চিত্র থেকে শুরু করে, এখন পর্যন্ত যতো রঙিন চিত্রই হয়েছে; সেই রঙ কিন্তু জীবন্ত ফুলের নয়, মৃত ফুলের।
স্মিথ : ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে আপনি যখন পুনরায় চলচ্চিত্র-নির্মাণে ফিরে আসলেন, তখন থেকেই চলচ্চিত্রিক সৌন্দর্যের ওপর নতুন করে জোর দিচ্ছেন। মনে হয়, আপনি চলচ্চিত্রের নিগূঢ় বক্তব্যের সঙ্গে এটাকে মিলাতে চান।
গদার : হ্যাঁ। অধিকাংশ সময় চলচ্চিত্রে মোটেও নিগূঢ় কোনো বক্তব্য থাকে না, কোনো সৌন্দর্যও ছিলো না—ছিলো শুধু সাজসজ্জা। সিন্ডলার’স লিস্ট বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার একটি ভালো উদাহরণ। এটি সর্বোচ্চ ফ্যাক্টর। এটা সাদাকালো ফিল্মে নির্মাণ করা; কারণ রঙিন ফিল্ম থেকে ল্যাবে প্রকৃত কালোসাদা তৈরি করা সম্ভব না। আর স্পিলবার্গের মতে, রঙিনের চেয়ে সাদাকালো বেশি সিরিয়াস। অবশ্য আপনি চাইলে এখনো সাদাকালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবেন, কিন্তু তা সহজসাধ্য নয়। তাছাড়া রঙিনের চেয়ে সাদাকালোয় খরচ বেশি হবে। তাই তিনি তার কাজের পদ্ধতির ওপর আস্থা রেখেছেন—এটা চোরাই পদ্ধতি! তবে তার কাছে এটা ফাঁকিবাজি নয়। আমি মনে করি, তিনি নিজের কাছে সৎ ছিলেন; কিন্তু খুব বেশি মেধাবী ছিলেন না। যার ফলে তার পদ্ধতিটাও মার খেয়ে যায়। সম্প্রতি আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখলাম, তেমন ভালো নয়; কিন্তু এটাতে আপনি অন্তত সিন্ডলার সম্পর্কে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবেন। স্পিলবার্গ সেই ব্যক্তি, যিনি তার গল্প ও ইহুদি সঙ্কট নিয়ে একটি দারুণ গল্প ফেঁদে বসেছেন—বড়ো একটা বাদক দল যেভাবে সাদামাটা কোনো গল্প থেকে বহুমাত্রিক সুর বের করে, অনেকটা সেরকম।
স্মিথ : ও, তাহলে উনি (স্পিলবার্গ) আপনাকে ঐতিহাসিক সত্য দেখাতে পারেননি?
গদার : তার সেই সক্ষমতা নেই। হলিউডেরই সেই সক্ষমতা নেই। আসলে আমার নিজেরই যতোটুকু তুলে ধরার কথা, সেটুকু তুলে ধরতে পারবো না। আমি তা নির্মাণের চেষ্টা করতে পারি; হয়তো একটি খণ্ডাংশ তুলে ধরতেও পারবো, সেটা দুই-তৃতীয়াংশ অথবা কখনো কখনো দশে নয়! খুব বেশি গুণী নন, বরং উইলিয়াম ওয়াইলার-এর মতো সাধারণ নির্মাতা যেভাবে সিন্ডলার’স লিস্ট তৈরি করতে পারতেন, স্পিলবার্গের তেমন করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ক্ষমতা নেই। উইলিয়াম ওয়াইলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই দ্য বেস্ট ইয়ার্স অব আওয়ার লাইভস নির্মাণ করেছিলেন। আজকের দিনে আপনি সেই চলচ্চিত্রটি দেখলে অবাক হবেন। কারণ তখন হলিউডের কিছু সৎ ও দক্ষ কলাকুশলীর সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো। সবমিলে মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের ক্ষমতা ওয়াইলারের চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে; তবে তিনি কিন্তু তার জায়গায় শতভাগ সক্ষম ছিলেন। আজকে আর সেটা নেই। প্রতিযোগিতায় নামলে উইলিয়াম যদি ১২ সেকেন্ডে একশো গজ যেতে পারেন, স্পিলবার্গের সেটা অতিক্রম করতে লাগবে দুই মিনিট।
স্মিথ : হেলাস পুওর মুই-এর একটি অন্যতম বিষয় হলো, সেখানে বলা হচ্ছে, আখ্যান বা ন্যারেটিভ সমাজ-সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, মাধ্যম হিসেবে এটা প্রকৃত ঘটনা ও সত্য ধারণ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অক্ষম।
গদার : হেলাস পুওর মুই-এ আমিও ঠিক এই ভুলটিই করেছি। কিন্তু আমি যেহেতু স্পিলবার্গের চেয়ে একটু মেধাবী নির্মাতা, সেজন্য চলচ্চিত্রটি ভালোই হয়েছিলো। যদিও বাণিজ্যিকভাবে এটি ততোটা ভালো করতে পারেনি। আর আমি এতে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার বিষয়টি এড়িয়ে গেছি। ফলে চলচ্চিত্রটি যেভাবে শুরু করেছিলাম, সেভাবে শেষ করতে পারিনি।
স্মিথ : চলচ্চিত্রটিতে সত্যান্বেষী বা ব্যাখ্যাকারী, যিনি সাক্ষীদের জেরা করে ন্যারেটিভের বিনির্মাণ করেন, তার ভূমিকাটি আমাকে ওয়েলেস-এর মিস্টার আরকাডিন চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।
গদার : হ্যাঁ, মিস্টার আরকাডিন-এর কথা আমারও মনে আছে এবং তা নিয়ে ভেবেছিও। এই চলচ্চিত্রটি সম্পাদনার কাজ অর্ধেক হয়ে যাওয়ার পর আমি সত্যান্বেষী চরিত্রটি যোগ করি। কারণ পুরো চলচ্চিত্রটি একসঙ্গে শুট করা হয়নি। আসলে চলচ্চিত্রটির উদ্দেশ্য এটা ছিলো না। তবে মিস্টার আরকাডিন-এ এটা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিলো। এজন্যই আমি বলি, ওই চলচ্চিত্রটি আরো ভালো; কারণ এটি অরসন ওয়েলেস-এর। যদিও সেসময় চলচ্চিত্রটিতে তিনি তার সক্ষমতার ৮০ ভাগ দিতে পেরেছিলেন।
স্মিথ : চলুন এবার জেএলজি বাই জেএলজি নিয়ে কথা বলি ...।
গদার : সঠিক নাম হলো জেএলজি/জেএলজি। এতে কোনো ‘বাই’ নেই—গোমন্ট এটি কেনো বসিয়েছে তা জানি না। এখানে ‘বাই’ থাকলে তার অর্থ দাঁড়াতো জেএলজি’র অধ্যয়ন, আমার নিজেকে নিজের উন্মোচন করা; অনেকটা আত্মকাহিনি আর কি! যেটাকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় ‘আন এক্সামেন দ্য কনসায়েন্স’। কিন্তু চলচ্চিত্রটি মোটেও তা নয়। এ কারণে আমি এটাকে জেএলজি/জেএলজি সেল্ফপোর্ট্রেট (আত্মপ্রতিকৃতি) বলি। আত্মপ্রতিকৃতিতে কোনো ‘আমিত্ব’ নেই। শুধু চিত্রাঙ্কনে এর একটি অর্থ আছে, আর কোথাও নেই। আর চিত্রাঙ্কন ছাড়াও চলচ্চিত্রে এর উপস্থিতি আছে কি না তা খুঁজে দেখতে আমি আগ্রহী ছিলাম।
স্মিথ : চলচ্চিত্রটিতে আপনাকে অধিকাংশ সময়ই একাকী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে—এটা কি আপনার বাস্তব জীবনের প্রতিফলন নাকি সেল্ফপোর্ট্রেট ধারাটিই এমন?
গদার : আমি সত্যিই একা, বাস্তবতা এটাই—আমি এটা অস্বীকার করতে পারি না। অবশ্য ভিতরে ভিতরে আমি কিন্তু অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগে লিপ্ত থাকি। তবে তারাও এটা জানে না যে, আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর বাহির থেকে দেখতে গেলে, এটাই আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনের বাস্তবতা; মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের এই জটিলতাগুলোই আমাকে একাকী করেছে। অবশ্য যারা হেনরি ডেভিড থুরিও’র ‘ওয়ালডেন’ (আত্ম উপলব্ধির জন্য একাকী প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকার প্রত্যয় এই গ্রন্থের বিষয়) গ্রন্থের মতো বেঁচে থাকে, তাদেরকেও আমি বুঝতে পারি অনেক সময়। আবার এমনও হতে পারে, ছোটোবেলায় আমার পরিবার অনেক বড়ো ও ধনাঢ্য ছিলো; আমরা সেখানে অনেক চাচাতো ভাইবোন একসঙ্গে ছিলাম। আমার মনে হয়, যুবা বয়সে আমি অনেক পেয়েছি, তাই এখন যে আমার বেশি কিছু নেই, তা ঠিকই হয়েছে।
স্মিথ : আপনি কি জেএলজি/জেএলজিতে মৃত্যুকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন? সেখানে তো মৃত্যু নিয়ে অনেক আলাপ আছে।
গদার : মৃত্যু? না, মোটেই না। অন্য কোনো সময়েও এটি খুব বেশি ভিন্ন হতো না। যদি আপনি কোনো ফাঁকা ঘরে থাকেন; তখন আমি নিজেকে অপরাধী ও বিষণ্ন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। ওখানে ঘরের দেয়ালগুলো খালি, সেখানে কোনো পরিবার নেই, এমনকি পরিবারের একটি পেইন্টিংও নেই। সেখানে দু-একজন বন্ধু ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
যদি আমি চলচ্চিত্রে অন্য আরো লোক রাখতাম, তাহলে তখন এটা আত্মজীবনী হয়ে উঠতো; এটা ভিন্ন কিছু হতো, আত্মপ্রতিকৃতি আর হতো না। আত্মপ্রতিকৃতি হলো শুধু আয়না কিংবা ক্যামেরায় একটি মুখ/দৃশ্য। অন্য কিছু দেখালে তা হাস্যকর হবে। কারণ আপনাকে তখন নিজের ছোটোবেলার চরিত্রে দেখানোর জন্য অন্য কোনো অভিনেতাকে ভাড়া করতে হবে—এটা হাস্যকর। এভাবে হয় না।
স্মিথ : ‘জীবন হচ্ছে মৃত্যুর পথে বাধা এবং এই চলচ্চিত্রই আমার চূড়ান্ত পরিণতি ঠিক করবে’—এই লাইনটিই কি মৃত্যু নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য নয়?
গদার : হ্যাঁ ... না। কারণ যখন আমার ছোটোবেলার এই ছবিটি খুঁজে পেলাম (চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখানো ছবিটি), সেটাতে ছয় বছর বয়সেই আমাকে এতো বিষণ্ন দেখাচ্ছিলো যে, আমি অবাক হই। বুঝতে পারছিলাম, আমার মা আমাকে চড় মেরেছিলো—শুধু এজন্যই আমি বিষণ্ন ছিলাম, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। এর পিছনে আরো গভীর কোনো কারণ ছিলো। সেসময়েও আমি সুখী ছিলাম না!
স্মিথ : জেএলজি/জেএলজির শুরুর শটে খুব ধীর গতিতে আপনার বাল্যকালের দৃশ্য ধারণ করা হয়। ওই দৃশ্যে তো ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানের ছায়াও দেখা যায়।
গদার : এটা একবারের জন্য; এখানে দর্শকের কথা আমি অল্প সময়ের জন্য ভেবেছিলাম, যাতে দর্শক বুঝতে পারে এটা ‘আমি, আসলেই আমি।’ এটা চিত্রশিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতির মতো, প্যালেট থেকে রঙ নিয়ে যেমন শিল্পী তার নিজস্ব চিত্রকল্প ক্যানভাসে আঁকেন।
স্মিথ : সেখানে জানালার দিকে মুখ করা ভিডিও ক্যামেরার পিছন থেকে বেশকিছু শট নেওয়া হয়েছিলো। এখানে প্রতিটি দৃশ্যের ফোকাসে গোটা ইমেজকে বাদ রেখে, শুধু ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারটুকু রাখা হয়েছিলো, কেনো?
গদার : আসলে আমি শুধু দর্শকদেরকে ফোকাসিংয়ের চিন্তা ও ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সাহিত্য, পেইন্টিং অথবা সঙ্গীত দিয়ে শ্রোতার মানসপটে চিত্র তৈরিতে ফোকাসিংয়ের প্রয়োজন হয় না; চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সাবজেক্টকে ফোকাস করা হয়।
স্মিথ : একইভাবে হেলাস পুওর মুইতে রাসেলের (লরেন্স মাসলিয়াহ) মিডিয়াম লঙ শটে ফোকাসের বাইরে অসাধারণ একটি শট রয়েছে; যেখানে তিনি ধীরে ধীরে ক্যামেরার দিকে আসেন এবং ক্লোজ-আপ করা হয়।
গদার : হ্যাঁ, ওটা আমি পছন্দ করি। হিস্তোরি(স) দ্যু সিনেমার লা বেলি ইট লা বেটায় একটি শট রয়েছে, যেখানে জসিটি ডেই লম্বা করিডোর দিয়ে নীচে নামতে থাকেন, ককেশু এখানে ট্র্যাকিং শট নিতে পারেননি। বরং তিনি ডেইকে একটি ছোটো ডলির উপর রেখে ক্যামেরার দিকে ধীরে ধীরে এনেছিলেন। এখানে ফল একই হলো, কিন্তু অর্থটা ভিন্ন দাঁড়ালো। হেলাস পুওর মুইতে এর একটি অর্থ আছে, তিনি ফোকাসের মধ্যে আসছেন। এটা এমন যে কেউ ডুবন্ত থেকে উপরিতলে উঠে আসছে। কারণ আসলে পর্দাই একটি তল। আমি দর্শকদের ওটাই মনে করাতে চাই। এটা গানের মতো—স্পষ্ট নয় বা কোনো কিছু স্পষ্ট করে বোঝানোর ভান করে না। আমেরিকানরা মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ঠিক কী বোঝাতে চান?’ আমি উত্তর দিই, ‘আমি বোঝাতে চাই, কিন্তু স্পষ্ট করে নয়।’
স্মিথ : হেলাস পুওর মুইতে আপনি চলচ্চিত্রের টেকনিকাল ভোকাবুলারির একটি স্পষ্ট প্রতিফলন দেখিয়েছেন—ফোকাস, এক্সপোজার, ক্যামেরা মুভমেন্ট, মন্তাজ—এমনকি একটি জুম আউট ও জুম ইন করেছেন। কিন্তু এর আগে আপনি চলচ্চিত্রে এগুলো কখনোই করেননি।
গদার : না। খুবই কম।
স্মিথ : জেএলজি/জেএলজির অন্য একটি উক্তি রয়েছে এমন—‘একটি ইমেজ হচ্ছে মনের মধ্যে অঙ্কিত দুটি ভিন্ন ধরনের বাস্তবতার একত্রিত চিত্র; বাস্তবতা থেকে যতো দূর যাবে, ইমেজ ততো শক্তিশালী হবে।’
গদার : ওটা পুরনো উক্তি। জেএলজি/জেএলজির অধিকাংশই আমার নিজের বক্তব্য নয়; কিন্তু যেহেতু আমি পড়ছিলাম এবং তাদের নোট নিচ্ছিলাম; সে কারণে সেগুলো আমার হয়ে উঠেছিলো।
স্মিথ : প্যাশন-এ চলচ্চিত্রনির্মাতা এ কথা বলেছেন।
গদার : কিং লিয়ার-এও এ কথা বলা হয়েছে। এটা পিয়েরে রিভারডি’র লেখা দাদাইজমের প্রথম দিকের কবিতা। জুরিখে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে যখন দাদাইজম যাত্রা শুরু করে, তখনকার আর কি। আমার যে মতামত, এটি তার ভালো একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে—একটি ইমেজ শক্তিশালী নয়, কারণ আপনি একজন মৃত মানুষকে দেখছেন ... খুব কম সময়ই একজন মৃত ব্যক্তির প্রভাব থাকে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমরা অসংখ্য মৃত্যু দেখেছিলাম, তবুও যুদ্ধ থামছিলো না। বরং যখন আমেরিকানরা দেখলো যে, তাদের একজন ছাত্র কেন্ট স্টেট-এ নিহত হয়েছে—শুধু একজনই, হাজার নয়—আর ওটাই যুদ্ধ থামানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো। পরের দিন সকালে তারা আর যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলো না। তিন-চার বছর লেগেছিলো আবারও যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় ফিরে আসতে এবং তারপরই হ্যানয়ে বোমাবর্ষণ হয়।
স্মিথ : এই ধারণা আপনি কীভাবে প্রয়োগ করবেন, এক রকম নির্দিষ্ট ইমেজের বাইরে চূড়ান্ত বিপরীতে?
গদার : কিন্তু একটি ইমেজের অস্তিত্ব থাকে না। যার অস্তিত্ব থাকে সেটা ইমেজ নয়, ছবি। ব্যক্তি যখন কোনোকিছু তার কল্পনায় ফুটিয়ে তোলে, তা ইমেজ; ইমেজ হলো একটি যৌগিক অবস্থা।
স্মিথ : মন্তাজের যে প্রকৃত ধারণা, সেটা কোথায়?
গদার : লা ভ্রাই মিশন চলচ্চিত্রের প্রকৃত লক্ষ্য ছিলো মন্তাজ কী এবং এর ব্যবহার ও চর্চা নিয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি; অনেক নির্মাতাই মনে করে, তারা এটা করতে পেরেছে, কিন্তু তারা আসলে অন্য কিছু করেছিলো। বিশেষ করে আইজেনস্টাইন। তিনি মন্তাজের কাছাকাছি গিয়েছিলেন, কিন্তু পৌঁছাতে পারেননি। তিনি সম্পাদক ছিলেন না, তিনি কিছু দৃষ্টিকোণ তুলে আনতেন। যেহেতু তিনি দৃষ্টিকোণ তুলে আনতে দক্ষ ছিলেন, তাই সেখানে মন্তাজের একটি ধারণা ছিলো।
অক্টোবর-এর তিনটি সিংহ একই ছিলো, কিন্তু তাদেরকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়ায় মনে হয় সিংহগুলো চলন্ত। আসলে এই দৃষ্টিকোণগুলো মিলেই একটা মন্তাজ হয়ে ওঠে। মন্তাজ অন্য কিছু, যা কখনো আবিষ্কার করা যায় না। সবাক চলচ্চিত্র আসার পর এই ধারাটি থেমে যায়। সবাক চলচ্চিত্রে এটাকে শুধু নাটকীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়।
স্মিথ : আপনার এই দুটি চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার অস্বাভাবিক—এক্সপোজার প্রায়ই আউটডোরের জন্য সেট করা হয়, যখন ক্যামেরা ইনডোরে অথবা আনুভূমিক দিকে থাকে। যদি এটা একটি আউটডোর শট্ হয়, তবে কেনো এ ধরনের একটা হাই কনট্রাস্টকে গুরুত্ব দেওয়া হলো?
গদার : কারণ আমি বিপরীত দিকটি দেখেছি। এটি হচ্ছে দুটি ইমেজ পাওয়ার উপায়; একটি অন্যটির চেয়ে ভিন্ন; একটা অন্ধকারে, অন্যটা সূর্যের আলোতে। আমি আলোর মুখোমুখি হতে পছন্দ করি এবং আপনি যদি আলোর মুখোমুখি হন, তখনই বৈপরীত্য দেখতে পাবেন এবং তারপর সীমাসূচক রেখা দেখতে সক্ষম হবেন ... যা সবসময়ই ইউরোপিয়ান চিত্রকলার সমস্যা। আমি আলো পিছনে রাখতে পছন্দ করি না, কারণ পিছনের আলো প্রজেক্টরের অধীনে থাকে। আমাদের জীবনের মতো ক্যামেরার আলোও সামনে রাখতে হবে। আমরা গ্রহণ করি এবং তারপর প্রদর্শন করি।
স্মিথ : তো আপনি কখনো কৃত্রিম আলো ক্যামেরার পিছনে রাখেননি?
গদার : কখনোই না।
স্মিথ : কিন্তু আপনি এখনো কৃত্রিম আলো ব্যবহার করছেন।
গদার : কারণ আমার কাছে ৫০ বছর আগের মতো ভালো কোনো ফটোগ্রাফার নেই। সুতরাং আমাকে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা কোনোকিছু পরিবর্তন করতে নয়। তবে কোনো কিছু ফোকাস করার প্রয়োজন পড়লে শক্তিশালী আলোর দরকার পড়তে পারে। আমার মতে, বর্তমানে আর তেমন কোনো ফটোগ্রাফার-ই নেই। এরা নিজেদের ধ্বংস করেছে টেলিভিশনের জন্য কাজ করে, সেখানে পুরো সেটে আলো ফেলতে হয়, ফিল লাইট ব্যবহার করতে হয়; সেখানে কোনো ছায়া নেই, কোনোকিছুই নেই। আমি মূলত সেই সব সিনেমাটোগ্রাফারদের ব্যবহার করি, যারা নিজ থেকে অতিরিক্ত আলো ব্যবহারে অনিচ্ছুক এবং অ্যাপারচার বড়ো করে খুলে তারা প্রধানত কাজ করে।
স্মিথ : ডিটেকটিভ-এর একটি লাইনে বলা হয়েছে, ‘সেখানে কখনো কোনো আলো ছিলো না, কেবল ছিলো তীব্র আলো।’
গদার : ডিটেকটিভ-এ আলোর ব্যবহার ভালো ছিলো, ওর ফটোগ্রাফারও (ব্রুনো নয়টেন) ভালোই ছিলেন। তিনি অপরিচিত অভিনেতাদের ওপর যথাযথ আলো ফেলেছিলেন, কারণ তাদের পর্দায় দেখা না গেলেও তা নিয়ে তারা চিন্তিত ছিলো না। কিন্তু যখনই নাথালি বে কিংবা জনি হ্যালিডে’র মতো বিখ্যাত তারকারা আসলো, তখন তাদের উপর তিনি কৃত্রিম আলো ফেললেন; সেটা মোটেও ভালো ছিলো না। তিনি তাদের ওপর আলো ফেলেছিলেন কারণ দর্শকরা টিভিতে তারকাদের দেখতে চায়। কিন্তু বক্তাদের দেখার গুরুত্বটা কী? তারা কী বলে সেটা শুনলেই তো চলে!
স্মিথ : এবং আপনি ওটার সঙ্গে দ্বিমত ছিলেন।
গদার : হ্যাঁ, পুরোপুরি। সেখানে তো রীতিমতো যুদ্ধ লেগেছিলো। কিন্তু আমি এটা এড়াতে পারিনি, কারণ আগেই স্বাক্ষরিত হয়েছিলো চুক্তিটা; আপস করতে হয়েছিলো। চলচ্চিত্র সবসময়ই আপস করে চলে।
সূত্র :http://www.filmcomment.com/article/jean-luc-godard-interview-nouvelle-vague-histoires-du-cinema-helas-pour-moi/;retrieved on 24/01/2016
শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
shafiqulislamru32@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন