সমীর কুমার মণ্ডল
প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
ডিশ কোনো ব্যাপার না, মোবাইল ফোনই চলচ্চিত্রশিল্পটাকে ধ্বংস করে দিলো
সমীর কুমার মণ্ডল

সমীর কুমার মণ্ডল যখন প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি কেবল মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন; সময়টা ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার নজিপুরের ‘বিনোদন’ প্রেক্ষাগৃহে সাইকেল গ্যারেজের দায়িত্ব দিয়ে চলচ্চিত্রের মাঠে সমীরের কর্মজীবন শুরু। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে গ্যারেজের কাজ তার ভালো লাগতো না। তাই মালিককে বলে কিছুদিনের মধ্যে সমীর দায়িত্ব পান প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে লোক বসানোর। একপর্যায়ে তিনি প্রেক্ষাগৃহের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর পরের ঘটনা আরো এগিয়ে যাওয়ার; আরেকজনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে সমীর ‘রংধনু’ নামে একটা প্রেক্ষাগৃহ গড়ে তোলেন নজিপুরেই। কয়েক বছর পর কিছু সমস্যায় সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। আবারও ‘বিনোদন’-এ ফিরে আসেন। এবার প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। এখনো লোকজন দিয়ে সেটাই চালান। দীর্ঘ সময়ে প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সমীর হাটের ইজারাদারি করেছেন, নির্বাচিত হয়েছেন পত্নীতলা পৌরসভার কাউন্সিলর হিসেবে। চলচ্চিত্রের পথে দীর্ঘ পথচলা এই মানুষটির সঙ্গে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ও ২০ জানুয়ারি ‘বিনোদন’ প্রেক্ষাগৃহে বসে নানা বিষয় নিয়ে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে কথা বলেছেন কাজী মামুন হায়দার।
ম্যাজিক লণ্ঠন : কতো বছর ধরে আপনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত?
সমীর কুমার মণ্ডল : ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এর সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?
সমীর : ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিই। তখনই এখানে সিনেমাহলটা হয়। এর মালিকের সঙ্গে আমাদের আগে থেকে একটা সম্পর্ক ছিলো, মানে এখানে একটা সাইকেল মেকানিকের দোকান ছিলো আমার বড়ো ভাইয়ের। এই মালিকের তখন একটা মোটরসাইকেল ছিলো, তিনি ওই দোকানে সেটা রাখতেন, একটু সময় কাটাতেন, চা-টা খেতেন—সেই সূত্রে পরিচয়।
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর এই সিনেমাহলটা চালু হয়। পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই সময় আমি বসেই ছিলাম। আমাদের সংসারও তখন অতোটা সচ্ছল ছিলো না। একদিন সিনেমাহলের মালিককে বললাম, একটা কাজ দেন। তখন মালিক বললো, সাইকেল গ্যারেজে কাজ করো। সাইকেলের গ্যারেজটা মূলত আমার এক চাচাতো ভাই ইজারা নিয়েছিলো। তখন গ্যারেজে সাইকেল রাখা ছিলো এক টাকা করে। তিন শোতে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ-ছয়শো সাইকেল হতো। আমার ভাই প্রায় সব টাকা নিতো, সামান্য কিছু আমাকে দিতো আর কি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তারপর ...।
সমীর : এর কিছুদিন পর আমার সাইকেল মেকানিক ভাই বললো, তিনি সিনেমাহলের মেশিন চালানো শিখবেন। তখন আমি সেই কথা মালিককে বললাম। মালিক বললেন, শিখবে ভালো কথা, কিন্তু না শেখা পর্যন্ত আমি তো বেতন দিতে পারবো না। আমার ভাই বললেন, ঠিক আছে। তারপর মালিক মেশিনম্যানকে আমার ভাইয়ের কথা বলে দিলেন। তারপর আমার ভাই কাজ শেখা শুরু করলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার ভাইয়ের নাম কী ছিলো?
সমীর : মিহির কুমার মণ্ডল। এরই মধ্যে আমি মালিককে বললাম, সাইকেল জমা নেওয়ার কাজ আর করবো না। আমাকে সিনেমাহলের মধ্যে একটা কাজ দেন। তখন তিনি আমাকে সিনেমাহলের ভিতরে লোক বসানোর জন্য বললেন। অন্যদিকে প্রত্যেক দিন টিকিট বেচাকেনার যে টাকাটা হতো, পরদিন সকালে আমি সেটা ব্যাংকে জমা দেওয়ার কাজটা করতাম। এছাড়া মালিকের অনেক জমিজমা আছে, সেগুলোও টুকটাক দেখাশোনা করতাম। তো মালিকের একজন ম্যানেজার ছিলো, তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পাস। এরই মধ্যে তিনি বিরামপুর কলেজে চাকরি পেয়ে চলে যান। তখন ওই দায়িত্বটা আমার আরেক ভাইকে দেন মালিক।
ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে আপনার মেকানিক ভাইকে, যিনি মেশিন চালানো শিখছিলেন?
সমীর : না, এটা আমার আরেক ভাই, তার নাম মনোরঞ্জন। তিনি অবশ্য মারা গেছেন। আর আমার ওই ভাই ততোদিনে মেশিন চালনা শিখে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তো মনোরঞ্জন দা দায়িত্ব নিয়ে ছয় মাসের মতো চালানোর পর, আর চালাতে পারলেন না। তখন একদিন মালিক মনোরঞ্জন দাকে ডেকে বললেন, তুমি তো পারতেছো না, সব দায়িত্ব সমীরকে বুঝিয়ে দাও।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এটা কতো সাল হবে?
সমীর : এই ধরো ১৯৮৯-এর দিকে। তারপর থেকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমি সিনেমাহলের ম্যানেজারের দায়িত্বের পাশাপাশি মালিকের অন্য কাজও করতাম। তখন তার অনেক ব্যবসা ছিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সেই সময়ে সিনেমার ব্যবসার কথা বলেন।
সমীর : তখন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সিনেমা নিয়ে আসলে, সাত দিনে এক লক্ষ টাকা বিক্রি হতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে, এতো ব্যবসা ছিলো সেসময়!
সমীর : তখন এমন একটা সময় ছিলো, সিনেমা মুক্তি দিলেই হাজার হাজার টাকা ব্যবসা হতো। আবার এমনও হয়েছে, ৮০ হাজার টাকা দিয়ে সিনেমা এনে ২০ দিন চালানোর পর তিন-সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যবসা হয়েছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তখন কি বিশেষ কারো সিনেমা চলতো বা আলাদা গুরুত্ব পেতো?
সমীর : বিষয়টা ঠিক ওই রকম নয়; তবে আমি যখন সিনেমাহলের সঙ্গে যুক্ত হই, তখন বেশি চলতো আলমগীর-শাবানা। সিনেমাহলের প্রথম দিকে ৮৩, ৮৪, ৮৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে চলতো অঞ্জু-ওয়াসিম, আর পরিচালক ছিলো এফ কবীর চৌধুরী। এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত এবং অঞ্জু-ওয়াসিম থাকলেই কোনো কথা নাই। আলমগীর-শাবানার পর আসলো জসীম, তারপর ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি চললো কিছুদিন। তার পর শেষের দিকে মান্না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সালমান শাহ ...।
সমীর : হ্যাঁ, সালমান শাহও ভালোই চলছিলো। তবে সেটা বেশিদিন ছিলো না। অল্পদিন পর তিনি মারা গেলেন, তার সিনেমাও বেশি ছিলো না।
তখন আসলে ‘বিনোদন’ ছাড়া আশেপাশে কোনো সিনেমাহল ছিলো না, ডিশের প্রভাবও ছিলো না, তাই এই সিনেমাহলটা খুব চলতো। ডিশ আসার পরও সিনেমা চলেছে, কিন্তু মোবাইলে মেমোরি কার্ড আসার পর এই অবস্থা হলো! এটাই সিনেমাহলের ব্যবসা ধ্বংসের মূল কারণ। এই মেমোরি কার্ডে বৈধ-অবৈধ অনেক সিনেমা ভরে নিয়ে ছেলেরা বাসায়, মাঠেঘাটে বসে দেখতেছে। সিনেমাহলে আর আসতেছে না।
সেসময়ের তুলনায় এখন তো লোকসংখ্যা অনেক, সিনেমাহলে তাই আগের চেয়ে অনেক লোক হওয়ার কথা। আর একটা কথা, এখনকার সিনেমার মানও কিন্তু আগের চেয়ে ভালো। তার পরও মানুষ সিনেমাহলমুখী হচ্ছে না। আগের চেয়ে সিনেমাহলের পরিবেশও এখন ভালো। আগে সিনেমাহলের ভিতরে ঢোকার পর ধোঁয়ায় আপনার চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে যেতো। যতো নিষেধই করেন, দর্শক বিড়ি-সিগারেট খাবেই। এখন দর্শক সেটা পারে না। আমার মতে, ডিশ কোনো ব্যাপার না, মোবাইল ফোনই চলচ্চিত্রশিল্পটাকে ধ্বংস করে দিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি ম্যানেজার থাকার সময় খুব ব্যবসাসফল হয়েছিলো, এ ধরনের কোনো সিনেমার কথা মনে আছে?
সমীর : সেসময় অনেক সিনেমা ভালো ব্যবসা করেছে; যেমন : আলমগীর-শাবানার পিতা মাতা সন্তান, সালমান-মৌসুমীর কেয়ামত থেকে কেয়ামত, এ জে মিন্টুর বাংলার বধূ, জসীমের অবদান, সালমানের সত্যের মৃত্যু নেই। এ রকম আরো অনেক ভালো সিনেমা তখন ছিলো।
আর একটা ব্যাপার, এখন তো সিনেমা চালানোর খরচ অনেক কম। আগে তো একটা সিনেমা আনার জন্য ঢাকায় যাওয়া-আসা করতেই চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন সেটা লাগে না। সিনেমাহলে সিনেমা চালাতেও দুই-তিন জন লোক লাগতো; এখন একজন লোক সিনেমা চালিয়ে তালা দিয়ে চলে যায়। অন্য কাজও করে। ডিজিটাল প্রজেক্টর আর পেনড্রাইভে সিনেমা আছে; একজন লোক চালু করে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ম্যানেজারের দায়িত্বে কতো দিন ছিলেন?
সমীর : ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে আমি এই সিনেমাহলের চাকরি বাদ দিই। তারপর জিল্লুর রহমান বাবুল নামে একজনকে নিয়ে ‘রংধনু’ নামে একটা সিনেমাহল করি। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ জুড়ে সিনেমাহল নির্মাণের কাজ চলে। পরে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সিনেমাহলটা চালু করি। ওখানে আমি ছিলাম ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই সময়ের মধ্যে আপনি বোধ হয় কাউন্সিলর নির্বাচনও করেছিলেন?
সমীর : হ্যাঁ, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এখানে পৌরসভা হওয়ার পর কমিশনার নির্বাচন করে আমি জয়ী হই। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ভোটেও জয়লাভ করি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : নিজে সিনেমাহল করার গল্পটা আরো একটু বলেন।
সমীর : এ সিনেমাহলের নির্মাণ শেষে তা চালু হয়। কিন্তু পার্টনারের সঙ্গে মনোমানিল্য হওয়ার কারণে আমি ওখান থেকে চলে আসি। সিনেমাহলের ব্যবসার বাইরেও আমার আরো দু-তিনটা ব্যবসা ছিলো। ২০ জন মিলে আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো, পুঁজি ছিলো এক কোটি টাকা। ওই টাকা দিয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গায় হাট ইজারা নিতাম। ওই সিনেমাহল থেকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চলে আসার সময়ও আমার হাটের ব্যবসা ছিলো। ‘বিনোদন’ সিনেমাহলটা তখন মালিক বন্ধ রাখছিলো, চালাতে পারছিলো না, লোকজন নাই। নবায়ন না করায় লাইসেন্সও বাতিল হয়ে গিয়েছিলো। আমার ওই অবস্থায় মালিক একদিন ডাক দিয়ে বললো, লাইসেন্সটা একটু নবায়ন করে দাও। টাকা-পয়সা দিলো, আমিও সব ঠিকঠাক করে আনলাম।
‘বিনোদন’-এর প্রথম লাইসেন্স ছিলো মূলত রাজশাহী জেলার ভিতরে, পরে সেটা নওগাঁ জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মালিক এরপর সিনেমাহলটা আবার চালু করে; কিন্তু ঠিকঠাক চালাতে পারছিলেন না। তারপর একদিন আমাকে ডেকে ভাড়া নিতে বললেন। এই মালিকের দুই ভাইয়ের দুইটা সিনেমাহল—এখানে একটা, অন্যটা সাপাহারে। দুইটা সিনেমাহলই আমি আর আমার আরেক পার্টনার মিলে ভাড়া নিই। এখনো ভাড়া নেওয়া আছে—সাপাহারের সিনেমাহলের জন্য দুই লক্ষ ৭০ হাজার এবং এটাতে দুই লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা দেওয়া আছে।
আমি কাউন্সিলর হওয়ার পরে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিনেমাহল চালিয়েছি। তারপর স্থানীয় কয়েকটা ছেলেকে সিনেমাহলটা চালানোর জন্য ছেড়ে দিই। লাভ-লোকসান যা হয় ওরাই দেখে। আমি টাকা পয়সা নিই না; এখানে বসে থাকি, মালিকের সঙ্গে গল্প করি—এই আর কি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ‘বিনোদন’ সিনেমাহলের মালিকের সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
সমীর : মালিক আসলে অন্য ভাবের লোক। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরে শেখ হাসিনা দেশে ফেরা পর্যন্ত; দেশে ফেরার পর ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে হাসিনা ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত পত্নীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার এমনকি নওগাঁ জেলায়ও উনার টাকায় দল চলতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : উনার নাম কী?
সমীর : আমিনুল হক। এই সিনেমাহলের টাকায় বিভিন্ন জায়গায় দল চলতো। আমি অনেক জায়গায় টাকা-পয়সা দিয়ে আসতাম। হক সাহেবকে আসলে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিলো ১৯৯১ ও ৯৬ খ্রিস্টাব্দে। রাজনৈতিক নানা কারণে তিনি মনোনয়ন পাননি। যাহোক ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এখানকার মেয়র নির্বাচিত হন। পরের বার অবশ্য ভোট করে ৩২০ ভোটে হেরে গেছেন। উনি বহু কিছু করেছেন দলের জন্য। এখন অবশ্য বয়স হয়ে গেছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : যাহোক, সিনেমাহলের ব্যবসাটা কী এইভাবে শেষ হয়ে যাবে! আপনি বললেন, পাঁচ হাজার টাকার সিনেমা ব্যবসা করছে এক লক্ষ টাকা, তাহলে সেই দিন কি শেষ হয়ে গেলো?
সমীর : এখন তো পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সিনেমা এনে সেই টাকাই ওঠে না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে এতো বড়ো একটা প্রতিষ্ঠান সারাদেশেই শেষ হয়ে যাবে?
সমীর : আমার জ্ঞান থেকে বলতেছি, এটা কেবল মেমোরি কার্ডের জন্য। এটা আসার আগে ডিশের প্রভাব থাকার পরও আমরা পাল্লা দিয়ে সিনেমা চালিয়েছি। এই সময়ে আমরা আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে সিনেমা এনেও তা মুক্তি দিয়েছি ঈদগুলোতে। সে টাকাও আমরা তুলতে পেরেছিলাম। কিন্তু মেমোরি কার্ড এসে আর পারছি না। এবার ঈদেই সিনেমা নিয়ে এসে অনেক টাকা লোকসান দিয়েছি। তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : কোনো ধরনের সম্ভাবনার জায়গা কি আছে বলে আপনার মনে হয়?
সমীর : এখন সরকার যদি কোনোভাবে মোবাইল ফোনে মেমোরি কার্ডের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে কিছু একটা হতে পারে। ডিশ কোনো সমস্যা নয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : মেমোরি কার্ডের ব্যবহার তো আর বন্ধ করা সম্ভব নয়। পাইরেসি বন্ধ করলে কি কিছুটা উপকার হবে?
সমীর : পাইরেসি না হলে মেমোরি কার্ড থেকেও তো কোনো লাভ নেই। ঢাকাতে আমি অনেক দিন চলচ্চিত্র আনার জন্য গিয়েছি, থেকেছি। সেখানে পাইরেসি করার একটা সংঘবদ্ধ চক্র আছে। যেকোনোভাবেই হোক এটা তারা করবেই। যদি মেমোরি কার্ড না থাকে, তাহলে তাদেরকে ডিস্ক বানাতে হবে। এটা দেখার জন্য তখন ভিসিডি, টেলিভিশন লাগবে; সেটা অনেক ঝামেলা।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে আপনি-আমি যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছি, সেখানেও তো মেমোরি কার্ড আছে। আদৌ কি মেমোরি কার্ডের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব!
সমীর : না করা গেলে তো ব্যবসা এ রকমই হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : যদি আমরা ভারতের কথা ধরি, সেখানেও তো মেমোরি কার্ডের ব্যবহার চলছে। তাহলে ...।
সমীর : ওখানেও এখন অনেক সমস্যা হচ্ছে। আসলে আমি নিজে থেকে সিনেমার ওপর কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক ভারতে সিনেমা দেখে। আর সিনেমা থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করে আমেরিকা। এখন ওগুলোর কী অবস্থা তা ঠিক জানি না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সিনেমা মুক্তি পায় ভারতে।
সমীর : যাহোক, এখন আমাদের দেশের নতুন এক নায়ক অনন্ত জলিল কয়েকটা সিনেমা বানালো; উনি সেগুলো বিদেশে দেখানোরও নাকি চেষ্টা করছে। জানি না ঠিক কী খবর। আমি বছর তিনেক হলো সিনেমার কাজে আর ঢাকা যাইনি। এখন ওই ছেলেরাই সিনেমা নিয়ে আসে, আমি তেমন একটা খোঁজখবর রাখি না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : অনন্ত জলিলের কোনো সিনেমা আপনি দেখছেন কিংবা এ নিয়ে আপনার কোনো মূল্যায়ন আছে?
সমীর : তার সিনেমার দৃশ্যগুলো ভালোই; মনে হয় টেকনিকাল হ্যান্ডগুলো ভালো; অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। কিন্তু তার পরেও তো চললো না। উনি অনেক চেষ্টা করছেন, ভর্তুকিও দিয়েছেন। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিনেমার দাম এক লক্ষ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে তিনি ৩০-৪০ হাজার টাকায় সেটা দিয়েছেন। তিনি এ রকম কথা বলতেন, এই সিনেমার যে ইনভেস্ট সেটা আমি এই দেশে উঠাবো না, অন্য দেশে উঠাবো; আপনারা শুধু আমার সিনেমা চালান, সিনেমাহল বাঁচুক, শিল্প থাকুক। তার পরেও তো খুব একটা ভালো করতে পারলো না।
আর একটা ব্যাপার, এখন সিনেমা কিন্তু আগের চেয়ে ভালো দেখা যায়। এখন ডিজিটাল মেশিন, কোনো কাঁপাকাপি নাই। তার পরও তো চলছে না। ঢাকাতে মনে হয় দু-একটা সিনেমাহল চলে ‘বলাকা’, ‘বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স’। আগে তো ‘মধুমিতা’ চলতো, এখন খুব একটা চলে না। আগে ‘মধুমিতা’তে প্রথম যে সিনেমাটা মুক্তি পেতো, সেদিন সেই সিনেমার নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আসতো; আমাদেরও দাওয়াত করতো। আমরা যেতাম। সাধারণত ছয়টা থেকে নয়টার শো-টার পর নয়-১২টার শো বন্ধ করে দিয়ে হলমালিকসহ সবাই মিলে নতুন কোনো সিনেমা দেখা হতো। প্রযোজক আমাদের আপ্যায়ন করাতো। সিনেমা দেখার পর ভালো লাগলে আমরা হয়তো সঙ্গে সঙ্গে বুকিং দিয়ে দিতাম।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এভাবেও মার্কেটিং হতো!
সমীর : আমরাও সিনেমাহলে নতুন কোনো সিনেমা আনার পর মুক্তির আগের রাতে দুই-তিনটা রিল দেখতাম। এখন আর আগের সেই অবস্থা নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আর একটা ব্যাপার, সিনেমাহলে নারী দর্শক আসা যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো!
সমীর : এর প্রধান কারণ একসময় সিনেমার অশ্লীলতা। এমনভাবে সিনেমা বানায়, যেখানে কিছু না কিছু অশ্লীলতা থাকেই। আগে যে সিনেমাগুলো ছিলো, সেগুলো অশ্লীলতা ছাড়াই চলেছে। এখন ওই অবস্থা আর নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : দেখেন, এখন ঘরে বসে টেলিভিশনে আমরা যা দেখি, সেখানেও তো এ ধরনের উপাদান থাকে।
সমীর : টেলিভিশনে ফ্রি দেখছে, সেটা আলাদা; কিন্তু টাকা দিয়ে এগুলো দেখবে, সেটা হয়? তবে মান্না বেঁচে থাকতে উনি কিছুটা রোধ করেছিলেন। তার পরে আর কেউই তো পারছে না। মান্না চলচ্চিত্রের জন্য ভালোই ছিলো। এখন সরকার বিভিন্ন দিক থেকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে, কিন্তু কেউ তো নিচ্ছে না। শুনলাম সিনেমাহলের মালিকদের সরকার টাকা দিতে চাচ্ছে সংস্কারের জন্য। ২০ বছরে এই টাকা শোধ করতে হবে। কেউ সেটাও নিতে চাচ্ছে না। এখন ধরেন, এই যে এতো বড়ো জায়গা পড়ে আছে, মালিক সেখান থেকে কোনো টাকা পাচ্ছে না। অথচ মার্কেট করে দিলে মাসে অনেক টাকা পেতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে বড়ো আকারের এসব সিনেমাহলও এখন সমস্যা।
সমীর : সেটা তো অবশ্যই। এখন মনে হয়, এই সিনেমাহলটা ভেঙে মালিক মার্কেট করবে। আমরা যদি সেখানে সিনেমাহল করতে চাই, তাহলে হয়তো উপরে জায়গা দেবে। তখন ছোটো করে তিন-সাড়ে তিনশো আসনের একটা সিনেমাহল করা হবে। সেক্ষেত্রে হয়তো পরিবেশ ভালো করলে সিনেমাহলটা চলতে পারে। এসি লাগাতে হবে, দর্শক তো এখন সবকিছুই উন্নত চায়। আগে এখানে তিন টাকা, পাঁচ টাকা টিকিট ছিলো, এখন সেখানে ৪০ টাকা। আরো ভালো মান দিতে পারলে হয়তো ৭৫-১০০ টাকা পর্যন্ত টিকিট করা যেতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি তো অনেক দিন ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সিনেমাহলের লাইসেন্সের ব্যাপারে কিছু বলেন।
সমীর : সিনেমাহলের লাইসেন্সের ফি চারশো টাকা, কিন্তু খরচ হতো ২০ হাজার টাকা। সিনেমাহলের লাইসেন্স নিতে ২০টা শর্ত লাগে। কোনো সিনেমাহলই এই শর্ত পূরণ করতে পারে না। ধরেন, এখানে যদি এক হাজার দর্শক হয়, তাহলে গড়ে একশো জনের জন্য কমপক্ষে একটা পায়খানা, দুইটা প্রস্রাবখানা লাগবে। এটা কি কোনো সিনেমাহলে আছে, বলেন?
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে এক হাজার দর্শকের সিনেমাহল হলে, সেখানে ২০টি প্রস্রাবখানা থাকতে হবে।
সমীর : হ্যাঁ। এটা বাংলাদেশের কোনো সিনেমাহলে আছে?
ম্যাজিক লণ্ঠন : মনে হয় না।
সমীর : ধরেন, কর্মচারী লাগবে ২৫ জন; আমরা চালাই ১০ জন দিয়ে। আগে সিনেমা চালানোর জন্য ছয় জন লাগতো, আমরা দুই জন দিয়ে চালাতাম। তিনটা শো, দুই জন করে একটা শো চালাবে। কারণ ৩৫ মিলিমিটার প্রজেক্টরে তো সবসময় একজনকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একজন লোকের পক্ষে তো তিন শো-এ নয় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। সেখানে আমরা দুই জন লোক দিয়ে চালাই।
মনে করেন, ওই দুই জনের কারো একটু সমস্যা হলো, আমি গিয়ে খানিকক্ষণ চালালাম। অথচ আমার তো ওখানে ঢোকাই নিষেধ। নিয়ম অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া ওই কক্ষে কারো ঢোকাই নিষেধ, বিষয়টা বেশ কড়াকড়ি ছিলো। এ ধরনের নানা বিষয়ে প্রশাসনকে বিভিন্ন দিক থেকে ম্যানেজ করতে হতো আর কি। তারপর ধরেন, যদি একশো টাকা বিক্রি হয়, তাহলে আপনাকে ৫০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে ট্যাক্স কি ৫০ শতাংশ ছিলো?
সমীর : সম্পূরক শুল্ক ছিলো ৩৫ শতাংশ আর মূসক ১৫ শতাংশ; তার মানে তো ৫০ শতাংশই। তাহলে আমার এখানে যদি সারাদিনে ২০ হাজার বিক্রি হয়, ট্যাক্স দেওয়া দরকার ১০ হাজার। আমরা কি সেটা দিই? আমি তো মাসে ১০ হাজার দিই। অফিসার এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, ভাই এটা করছেন! মালিক হয়ে আপনি যদি এতো কিছু করেন, তাহলে আমাকে তো কিছু দিতে হবে। আমরা বলতাম, নেন।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সিনেমাহলের ট্যাক্সের বিষয়টা দেখাশোনা করতো কারা?
সমীর : কাস্টমস।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এরা কি তখন নিয়মিত আসতো?
সমীর : হ্যাঁ, নিয়মিত আসতো। তবে মাসওয়ারি চুক্তি থাকলে আসতো না, টাকা পৌঁছায় দেওয়া হতো। আগে এর নাম ছিলো ক্যাপাসিটি ট্যাক্স। আপনার সিনেমাহলে আসন এক হাজার, এই আসনের জন্য মাসে আপনি ১০ হাজার টাকা দিবেন। কিন্তু পরের সরকার এই নিয়মের পরিবর্তন করলো—আগে ক্যাপিটাল ট্যাক্স জমা, পরে খরচ। আগে আপনি এক হাজার আসনের জন্য সম্পূরক ট্যাক্স দেবেন ১০ হাজার আর মূসক পাঁচ হাজার। এরপর প্রতিদিন খাতায় এর নোট দেবেন, কাস্টমসের লোক এসে দেখবে কতো টাকা করে প্রতিদিন কাটা যাচ্ছে। জমা টাকা শেষ হয়ে গেলে আবার টাকা জমা করতে হবে। মাস শেষে হিসাব দিতে হবে, আপনি কতো বেচাকেনা করলেন, কতো ট্যাক্স দিলেন। তখন প্রচুর ঝামেলা ছিলো। একজন ম্যানেজারের পক্ষে সেটা কাভার করা কঠিন হতো।
আমি তো, তখন সারাদিন হিসাব করতাম, আর সারারাত খাতায় তুলতাম। এছাড়া উপায় ছিলো না। এ নিয়ে মামলাও হয়েছিলো দুই-এক বার। আমি অবশ্য পরে ট্যাক্সের কাজটা শিখে ফেলি। এই এলাকা মানে ধামইরহাট, সাপাহার, মহাদেবপুর, বদলগাছি, মান্দার সিনেমাহলের মালিকরা এসে এই হিসাব আমার কাছ থেকে করে নিয়ে যেতো।
এই সিনেমাহল থেকে মাসে আমি ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ট্যাক্স দিয়েছি। যদিও সেটা অরিজিনাল নয়। সেসময় ঈদে একদিনে এক লক্ষ টাকা বিক্রি হতো। সেখান থেকে প্রকৃত ট্যাক্স ছিলো ৫০ হাজার। এখনো কাস্টমস এগুলো এভাবেই চালায়। এই ইটেরভাটাগুলো আছে, এগুলোর অবস্থাও তাই। অরিজিনাল ট্যাক্সের ১৬ ভাগ করে এক ভাগ পায় সরকার।
সিনেমাহল মালিকদের যে সমিতি আছে, সেখানে অনেক বড়ো বড়ো লোক আছে‘রাজমণি’র মালিক আহসানউল্লাহ, ‘মধুমিতা’র মালিক, ‘মণিহার’-এর মালিক সিরাজ সাহেব। এরা সেসময় ক্যাপাসিটি ট্যাক্স ফেরত আনার জন্য বহু চেষ্টা-তদবির করেছিলেন। ওটা থাকলে আমাদের অন্তত ঘুষের টাকাটা দেওয়া লাগতো না। নতুন সিনেমাহল হলে একজন অফিসার এসে দুই-চার দিন বেচাকেনা দেখে একটা ট্যাক্স নির্ধারণ করে যেতো। তারপর সেটা মাস শেষে দিয়ে আসলেই হতো। তাতেও অনেকটা টাকা সরকার পেতো—সারাদেশে বছরে প্রায় তিনশো কোটি। কিন্তু এই নিয়মটা আসার পরে সিনেমাহলের মালিকরা, অফিসাররা সুযোগ নিলো; মাঝখানে সরকার ফাঁকা পড়ে গেলো।
তার পরও তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো, ট্যাক্স দিতে সমস্যা হয় নাই। কিন্তু এখন তো মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাইলেও সমস্যা। এখন দিনে পাঁচ-সাতটা করে লোক হয়। এ ধরনের নানা কারণে সিনেমাহলগুলোর আজ এই অবস্থা, সঙ্গে আমাদের জীবনও এখন দুর্বিষহ।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে তো নানাভাবে অনেক লোক জড়িত ছিলো।
সমীর : এই সিনেমাহলে লোক ছিলো ২০ জন। এখন তো দুই জন।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে বরফ (আইসক্রিম) বিক্রি করতো, ফিরোজ নামে একজনের সঙ্গে গতকাল কথা হলো।
সমীর : হ্যাঁ, ফিরোজ অনেক ছোটো থেকে এখানে বরফ বিক্রি করতো। ওরা বিক্রি করে নিজেরা ভালো লাভ তো করতোই, উপরন্তু আমাদেরও টাকা দিতো। ওরা হয়তো বরফ বিক্রি করতো দুই জন, এজন্য মাসে আমাদের পাঁচশো টাকা করে দিতো। সেই টাকা সাধারণত মালিককে দেওয়া হতো না, জমা করে সিনেমাহলের স্টাফরা সবাই মিলে হয়তো দুই-তিন মাস পরে এখানেই রান্না করে খাওয়া-দাওয়া হতো। ভাবেন, সেসময় কতো ভালো দিন ছিলো!
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার সেই ‘রংধনু’ সিনেমাহল তো দেখতে বেশ সুন্দর। আমি গতকাল ওখানে গিয়েছিলাম। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর সিনেমাহল তো ‘রংধনু’।
সমীর : মূল নকশা অনুযায়ী ওটার কাজ তো আমরা শেষ করতে পারিনি। ওটার ডিজাইনার ছিলো ঢাকার প্রফুল্ল কুমার হাওলাদার। উনার যে নকশা, সেটা আমরা শেষ করতে পারিনি, অনেক কাজ বাকি ছিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ‘রংধনু’ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওখানে নারী দর্শক হতো প্রচুর। এর কি আলাদা কোনো বিশেষত্ব ছিলো?
সমীর : ওখানে সেসময় আমরা মূলত নারীদের নিরাপত্তার দিকে বেশি জোর দিয়েছিলাম। এছাড়া তাদের জন্য ভালো ওয়েটিং রুম, বাথরুমেরও ব্যবস্থা ছিলো। মেয়েরা বেশ নিরাপদে সেখানে থাকতে পারতো। পুরুষদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততাই ছিলো না। ওখানে নারীদের জন্য আয়না ও চিরুনির ব্যবস্থাও ছিলো। এছাড়া সিনেমাহল থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তায় যাতে রাতে নারীদের যাতায়াতের সমস্যা না হয়, সেজন্য নিজের খরচে আমরা আলোর ব্যবস্থা করেছিলাম। এমনকি বিদ্যুৎ চলে গেলেও জেনারেটর দিয়ে এসব আলো জ্বলতো। আমাদের স্টাফরাও রাতে রাস্তায় থাকতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে আপনারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।
সমীর : হ্যাঁ, আমরা নিজস্ব উদ্যোগে এই ব্যবস্থাটা করেছিলাম।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সিনেমাহলের ব্যবসাটাকে আপনারা বেশ অন্য ধরনের একটা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছে!
সমীর : আমি সেই ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এর সঙ্গে জড়িত, তাই কীভাবে দর্শক বেশি আসবে এগুলো নিয়ে নানাধরনের কাজ করতাম। ‘বিনোদন’ তখন খুব ভালো চলতো না। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এরা এক লক্ষ টাকার সিনেমা এনেও ভালো ব্যবসা করতে পারছিলো না; আমরা ২০ হাজার টাকায় যেটা করতাম। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো নিরাপত্তা; সেটা কেবল নারীদের জন্য নয়, পুরুষদেরও। ‘রংধনু’তে এতো লোকের ভিড়ের মধ্যেও কোনো টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হতো না। আমরা কোনো দর্শককে ফেরাতাম না। এমনকি কারো টাকা কম পড়লে, আমাদের জানালে, ওই টাকাতেই সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করা হতো। বাকিতেও (হাসি) লোকজনকে আমি সিনেমা দেখিয়েছি।
তারপর রাতের বেলা দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন বাস, গাড়ি, টেম্পু, ভটভটি নিয়ে আসতো; সিনেমাহলের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় সেগুলো পার্কিং করে আমাদের লোকজন পাহারা দিতো। আর যারা বাস, ট্রাক, টেম্পো নিয়ে আসতো, প্রতি গাড়ির দুই জন করে, মানে হেলপার, ড্রাইভার ফ্রি সিনেমা দেখতে পারতো। এর ফলে ওরাও আগ্রহী হতো; লোকজনকে আমাদের সিনেমাহলে নিয়ে আসতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে দর্শকদের জন্য একটা মার্কেটিং পলিসি ছিলো আপনাদের।
সমীর : মূলত এই চিন্তাগুলো আমারই ছিলো। আমার পার্টনার এগুলো নিয়ে তেমন কথা বলতো না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ‘রংধনু’ নিয়ে আপনার পার্টনারের সঙ্গে সমস্যা কখন শুরু হলো?
সমীর : এটা ধরেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে। পার্টনারের সঙ্গে আমার কথা ছিলো, সিনেমাহল চালুর পরে আমরা হিসাব করবো কে কতো বিনিয়োগ করলাম। জমিটা প্রথমে পার্টনারের নামেই কেনা হয়। টাকাও ওরই ছিলো। আর জমি দুই নামে কিনলে লাইসেন্স নিয়েও একটু সমস্যা হয়। সিনেমাহল চালুর পরে সব বাকি-বকেয়া যখন শোধ হয়ে গেলো, তখন আমি বললাম, আসেন বসি কার কতো ইনভেস্ট হলো সেটা নিয়ে কথা বলি। তখন আর আমার পার্টনার বসে না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে এসে আবার ‘বিনোদন’ ভাড়া নিলেন কবে থেকে?
সমীর : ওই যে বললাম, ২০০৪-এর দিকে। এখানে এসে প্রথমে কিছু সংস্কারের কাজ করলাম। তারপর প্রতিদিন সকালে সিনেমাহলের ভিতর ভালো করে পরিষ্কার করাতাম। আর সকাল-বিকাল দুই বার পরিষ্কার করাতাম সিনেমাহলের বাইরের দিকটা। বাথরুমও দুই বার করে পরিষ্কার করা হতো। আমি প্রতিদিন সকালে এসে সিনেমাহলের ভিতরে চেক করতাম দর্শকের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। তখন এক বছর সিনেমাহল চালিয়ে আমার প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা লোকসান হয়, পরে অবশ্য সে টাকা উঠেছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন কি সরাসরি সিনেমাহলের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা আছে?
সমীর : ওইভাবে নাই, যেটা আছে সেটা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে ...।
সমীর : মালিক এখন সিনেমাহলটা ভাঙতে চাচ্ছে। উনারা তিন ভাই। তিন জনই হজ করেছে। অন্য দুই ভাই সিনেমাহল না রাখার পক্ষে। যদিও এই জমিটা বড়ো ভাই মানে আমিনুল সাহেবের। তিনি যদি ভেঙে মার্কেট করেন; লাইসেন্স যেহেতু আছে, আমি চিন্তাভাবনা করেছি, ছেলে দুইটাকেও বলেছি, তোমরা যদি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারো, তাহলে মার্কেটের দোতলায় আড়াই শো-তিনশো সিটের একটা স্পেস নিয়ে, বাথরুম করে ছোটো একটা সিনেমাহল করবো আর কি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আল্টিমেটলি আপনারা যেটা ভাবছেন, এখনকার সিনেমাহলের প্যাটার্ন কিন্তু তাই।
সমীর : হ্যাঁ, সিনেমার ব্যবসাটা ঢাকার পরে আমিই এখানে করেছি। নওগাঁ থেকেও অনেকে আমার কাছে আসে, পরামর্শ নেয়। আমিও যাই ওই সব সিনেমাহলে বসি। এই এলাকায় কীভাবে ব্যবসা হবে সেটার পরামর্শ আমিই করেছি। নওগাঁ, সান্তাহারের সিনেমাহল মালিকরা আমার আগে কখনো সিনেমা কিনতে পারেনি। নতুন সিনেমা রিলিজ হবে, সবার আগে আমি কিনেছি। এমনও হয়েছে, একটা সিনেমা হচ্ছে, ছয় মাস পরে মুক্তি পাবে, আমি ছয় মাস আগেই টাকা দিয়ে রেখেছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে খোঁজখবরগুলো রাখতে হতো?
সমীর : হ্যাঁ, রাখতে হতো। নিয়মিত ঢাকাতে যাতায়াত করতাম, খোঁজখবর রাখতাম। কোনো প্রোডিউসার বলতো, আমার অমুক সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে; বলতাম, ঠিক আছে আপনি আমার নামটা রাখেন। হয়তো দেখা গেলো ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে যেসব সিনেমা চলবে আমার হলে, তার ছয় মাসের সিনেমা ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দেই আমার বুকিং দেওয়া হয়ে গেছে। আবার এই ছয় মাসে পরের ছয় মাসের সিনেমাগুলো কিনে ফেলেছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে, এটা একরকম টাকার খনি ছিলো?
সমীর : হ্যাঁ, এতে টাকা ছিলো প্রচুর। হয়তো পাঁচটা সিনেমা, তার জন্যে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে রাখলাম। ২০ হাজার বা ৩০ হাজার টাকা দিলেও কোনো কোনো সিনেমা বুকিং দেওয়া যেতো। আমরা ঢাকায় গিয়ে পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতাম। সবমিলিয়ে খুব ভালো পরিবেশ ছিলো আর কি। এখন যে অবস্থায় আছি, এটা তখন ভাবা যেতো না। আগে আমার যখন কাজ কম থাকতো, ঢাকাতে চলে যেতাম। ওখানে অনেকের সঙ্গে কথা হতো, পরামর্শ করতাম; অনেক সময় তারাও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতো; যেহেতু আমি দূর থেকে যাই।
তাদের মানে প্রযোজক-পরিচালক-প্রদর্শক সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলে আমাদের দাওয়াত করতো। যেমন : সিনেমাহল মালিক সমিতির নির্বাচন হচ্ছে, কোনো মালিক আমাকে বললো, ‘আসেন, আপনি আমার সঙ্গে থাকেন।’ কিংবা শিল্পী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে; বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পিকনিক, আমাদেরকে ডাকতো বড়ো বড়ো হোটেলগুলোতে। আমি কাকরাইলের ঈশা খাঁ হোটেলে গিয়েছি, ওখানে আমাদের জন্য রুম দিয়ে দিতো সবাই। সেই ব্যবসাটা শেষ হয়ে গেলো।
ডিশ আসার পরও আমরা অনেক যুদ্ধ করেছি, কিন্তু মেমোরি কার্ডের সঙ্গে আর পারলাম না। এটার সঙ্গে আর পারাই গেলো না। আর ছবিগুলোও এমন হতে লাগলো, মেয়ে-ছেলেরা দেখলো না। তাদেরকে সিনেমাহল ছাড়তে বাধ্য করা হলো আর কি। আমাদের তো সিনেমার ব্যাপারে করার কিচ্ছু নাই। এই যে ওরা পোস্টারগুলো (সিনেমাহলের সামনে লাগানো পোস্টার দেখিয়ে) দিচ্ছে, ওরা যদি না দেয় তাহলে আমরা এগুলো কোথায় পাবো? আমরা কি ছাপাবো? আমি তো এখানে পোস্টার লাগাতেই দিবো না, অনেক লোকজন এই দিক দিয়ে যাতায়াত করে, গালিগালাজ করে। কিন্তু এছাড়া তো এখন পোস্টার নাই; এদেরকে তো প্রচার করতে হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আবার নতুন সিনেমা নিয়ে আসলে যেটা হচ্ছে, সিনেমাহলে আসার অভ্যস্ততা যেহেতু নেই, তাই লোকজনও আর আসছে না।
সমীর : আমি তো এখানে এসেও অনেক চেষ্টা করেছি। একটা সিনেমা ছিলো চুরিওয়ালা; ফেরদৌস আর ইন্ডিয়ান নায়িকা মনিকা দেবী। এই সিনেমা আনলাম, মেয়ে-ছেলেরা তো আসলো না। আমি এই এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকিট দিয়ে আসছি। বলেছি, যান আপনারা সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমাটা দেখেন; যদি ভালো লাগে তাহলে সিনেমা দেখে টাকা দিয়ে আসবেন, না হলে দেওয়া লাগবে না। এতে কাজ হয়েছিলো; বেচাকেনা হয়েছিলো অনেক।
ম্যাজিক লণ্ঠন : দর্শক আনার জন্য আপনি অনেক ভালো একটা কৌশল বললেন। তার মানে আপনি তো ব্যবসাটা ধরে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন! আর সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার আলাদা একটা ব্যাপার আছে।
সমীর : সেটা ঠিক। এখানে আপনি সিনেমা দেখতে আসলেন, আপনি তো শুধু সিনেমা দেখলেন না। আপনি আসলেন, ১০ জন মানুষের সঙ্গে দেখা হলো, ১০টা কথা হলো; এক কাপ চা খেলেন বা একটা পান খেলেন, সিগারেট খেলেন, যার যেটা লাগে আর কি। তবে আমি ওই চুরিওয়ালা ছবিতে এ রকম করে ভালো ফল পেয়েছিলাম।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি সেই সময় ঠিক কী করেছিলেন?
সমীর : সব এলাকায় পোস্টার লাগানোর পর ব্যান্ডপার্টি দিয়ে একটা প্রচার দিলাম। তারপর প্রায় হাজার খানেক টিকিট নিয়ে আশেপাশের পাড়ায় পাড়ায় মেয়ে-ছেলেদের কাছে গেলাম। তাদের বললাম, ‘টিকেট দিতে আসছি, নেন আপনারা, সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমাটা দেখেন।’ অনেকে নগদে নিয়ে নিলো। অনেকে নিলো না। আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এই নেন পাঁচটা টিকেট, সিনেমা দেখে যদি ভালো লাগে, তাহলে টাকা দিবেন, যদি ভালো না লাগে, তাহলে টাকা দেওয়া লাগবে না।’ সবাই অবশ্য টাকা দিয়েছিলো। আমি না থাকলেও আমার যে লোক রাখা ছিলো, তাকে খুঁজে বের করে তারা টাকা দিয়ে গেছে।
তবে এখন এই বড়ো সিনেমাহলের মেইনটেন্যান্স খরচ অনেক, তাই ছোটো করে নিলে আমার ধারণা আবার চালানো সম্ভব। কিন্তু এটা দিয়ে আর হবে না। ছোটো করে, একটু ছিমছাম পরিবেশ করে নিলে হবে। এখানকার থানা, পৌরসভা, কলেজ স্টাফদের আমি সিনেমা দেখিয়েছি এভাবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার সামনে একটা ইয়ং জেনারেশন আছে, যেই জেনারেশনটা সিনেমাটা দেখতে চাইবে।
সমীর : এভাবে আমি সব স্টাফকে সিনেমা দেখিয়েছি। আর এই পাশে আমার অফিস ছিলো, ওই দোকানটায়। আমি সন্ধ্যায় এখানে বসতাম। আশেপাশের সব কলেজের স্যাররা চলে আসতো। তখন ছবির মানটা ভালো ছিলো। তারা আসতো, গল্প করতো, চা খেতো, কেউ ইচ্ছা করলে সিনেমাও দেখতো। খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো। এখন তো সব স্যারেরা ব্যস্ত প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে। সবমিলে খুব কষ্টে আছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আসলে মানসিক কষ্টও তো খুব ভয়ঙ্কর!
সমীর : সেটা তো বটেই। এখন আমার তো এখানে কিছুই নাই। তার পরও সবার আগে সকাল আটটা-নয়টায় আমি সিনেমাহলে চলে আসি। সবার সঙ্গে গল্প করি, কোনো কাজ থাকলে সেটা সেরে আবার দুপর ১২টার দিকে চলে যাই। খাওয়া দাওয়া করে, রেস্ট নিয়ে আবার চলে আসি। আবার রাত আটটার দিকে চলে যাই। বাইরে কোথাও না গেলে আমি নিয়মিত এই রুটিন পালন করি এখনো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : যদি সুযোগ থাকে সিনেমাহলটা নষ্ট করবেন না। ভালো সময় ফিরবে নিশ্চয়। ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কিছু ভালো সিনেমা হচ্ছে। আমাদের পরিচালকরাও চেষ্টা করছে।
সমীর : দেখি, তবে এখানে একটা সমস্যা আছে। সিনেমাহলটা তো আমিনুল সাহবের নামে। এখন আমি যদি কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করি, তাহলে তো হবে না। এটা তাকে করা লাগবে। কিন্তু উনি এক টাকাও কারো কাছ থেকে ধার করার পক্ষপাতী না। তার অবশ্য প্রয়োজনও নাই। উনি তো বড়োলোক মানুষ। এখন এই মুহূর্তে আমাকে যদি এখানে পাঁচ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করতে হয়, তাহলে সেটা তো সম্ভব হচ্ছে না। তাই উনার ইচ্ছায় ছোটো করে কিছু করার যদি সুযোগ পাই, দেখি কিছু করা যায় কি না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আগের দিনের ব্যবসাসফল সিনেমাগুলো নিয়ে কিছু বলুন।
সমীর : কমলার বনবাস লাগানোর পর প্রথম শো-এ কিছুটা সমস্যা হয়েছিলো। নারীদের জন্য নির্ধারিত জায়গাটা ভরে যাওয়ার কারণে অনেকে প্রথম শো দেখতে পারলো না। ডি সি’তে কিছু নারী দর্শক প্রথম শো দেখার পরও অনেকে থেকে গেলো। তখন আমরা একটা কৌশল অবলম্বন করলাম; ‘রংধনু’ সিনেমাহলে মূলত নারীদের জন্য একশো ২৫টি আসন আর বাকি এক হাজার ছিলো পুরুষদের জন্য। আমরা এই হিসাবটা উল্টে দিলাম, পুরুষদের জন্য মাত্র একশো ২৫টি আসন রেখে বাকিগুলো নারীদের জন্য দেওয়া হলো। তখন আর ডি সি বলে কিছু রাখা হলো না। নারী দর্শক একই টাকায় যেকোনো জায়গায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেলো। কারণ সাধারণত নারী দর্শকরা খুব বেশি টাকা নিয়ে আসে না। বাচ্চাদের খাওয়া, যাতায়াতসহ তারা একটা নির্দিষ্ট টাকা নিয়ে আসে। তাই এ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আর পুরুষ যারা টিকিট পেতো না, তাদের বসে থাকতে বলা হতো পরের শো-এর জন্য। নারীদের তো আর বাইরে বসিয়ে রাখা যায় না। পুরুষদের সেটা আমরা বুঝালাম, তারা বুঝলোও।
স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ সিনেমাতেও অনেক নারী দর্শক হয়েছিলো। আমরা এখানে রূপবান, বেদের মেয়ে জোস্না চালিয়েছি। অনেক নারী দর্শক ছিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আরেকটা বিষয় আপনি বললেন (রেকর্ড ছাড়া কথায় কথায় বলছিলেন), সব নায়ক-নায়িকা সব জায়গায় সমানভাবে জনপ্রিয় হবে বিষয়টা তেমন নয়।
সমীর : এই বিষয়টা পরের দিকে একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো; বিশেষ করে যখন আর কেউ থাকলো না মান্না ছাড়া। মান্না-মৌসুমীর সিনেমা একই সঙ্গে গোটা দেশে জনপ্রিয় হয়েছিলো। এছাড়া কমলার বনবাস, বেদের মেয়ে জোস্না, রাখাল বন্ধু, খায়রুন সুন্দরী এই সিনেমাগুলোও সারাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়। আর মান্নার সিনেমা মানেই বেশি দাম। বর্তমানে যেমন শাকিব খান।
আমাদের সিনেমাকে বেশি নষ্ট করে দিয়েছে শাকিব খান। মান্নার সিনেমা সেসময় যেভাবে চলছেতিনি যদি কোনো সিনেমা করে ৫০ লক্ষ টাকা দাবি করতেন প্রযোজকরা সেটা দিতে বাধ্য থাকতো। কিন্তু মান্না সেটা করেন নাই। তার লক্ষ্য ছিলো সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দিকে। তাই তিনি টাকা কম নিয়ে প্রযোজকদের ব্যবসা করতে বলতেন। তিনি সর্বোচ্চ সাত-আট লক্ষ টাকা নিতেন। কিন্তু শাকিব খান শেষের দিকে একটা সিনেমার জন্য ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা দাবি করতো। আমি যতো দূর জানি, শেষ পর্যন্ত অনেক পরিচালক শাকিবকে দিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করার পরও সিনেমা করে নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সেই শাকিব খান অবশ্য এখন আবার সাত-আট লক্ষ টাকায় নেমে এসেছে!
সমীর : সাত-আট লক্ষ কেনো, শাকিবকে আর কিছু দিন পর মাঙনা (বিনা টাকায়) সিনেমা করে দিতে হবে। ওকে কে নেবে? এক শাকিব খানের জন্য এ শিল্পই ধ্বংস হয়ে যাবে। ওর সিনেমাগুলো যখন ভালো চলতে লাগলো, তখন যদি ও একটা নির্দিষ্ট টাকা ডিমান্ড করতো, তাহলে হয়তো কিছু লাভ হতো। তার ওপর শুটিংয়ের সময় এরা ঠিক মতো সেটে যায় না, ব্যবহার খারাপ করে ইত্যাদি।
তবে এই সব ব্যাপারে মান্না খুবই ভদ্র ছিলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে উনার সঙ্গে বসেছি, কথা বলেছি। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করতো, কীভাবে, কোন ধরনের সিনেমা নির্মাণ করলে ভালো ব্যবসা হবে। এসব বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ হতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতো?
সমীর : হ্যাঁ, আমার এখানে তো উনি আসতে চেয়েছিলেন। আমরা উনার সব সিনেমা এখানে চালিয়েছি। দেখা হলে বলতো, আপনারা আমার সিনেমা এতো চালান, একবার আপনাদের ওখানে যাবো। আপনারা কী অবস্থায় কেমন আছেন, সেটা দেখার জন্য হলেও যাবো। ঈদে একবার উনার দিনাজপুর যাওয়ার কথা ছিলো, ফেরার পথে পত্নীতলা হয়ে যাওয়ার কথা। এটা অবশ্য একেবারে ব্যক্তিগতভাবে, কোনো অনুষ্ঠানের জন্য নয়। একবার অবশ্য এখানে আহমদ শরীফ বেড়াতে আসছিলো। আর মান্নার তো অনেক টাকা-পয়সা ছিলো। উনার প্রযোজিত লুটতরাজ কয়েক কোটি টাকা ব্যবসা করেছিলো।
আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, রাজীব, মিজু আহমেদ কিন্তু খুব ভালো মানুষ। উনাদের একটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিলো। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে উনারা সিনেমা বানাতো। উনাদের একটা সিনেমা ছিলো মহৎ নামে। আমি সেই সিনেমাটা একবার নিতে গেলাম। সেই অফিসে গিয়ে দুজনের সঙ্গে দেখা। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভাই একটা কথা বলবো। উনারা বললেন, ছোটোভাই বলো। আমি বললাম, ‘আপনারা দুই অসৎ মিলে একটা সিনেমা বানিয়েছেন মহৎ। সিনেমার নামটা কে দিয়েছে?’ আমার কথা শুনে দুই জন বেশ হাসলো; তারপর বললো, ছোটোভাই এমন কথা বলেছে এজন্য আজ সারাদিন ওর সব খরচ আমাদের। ম্যানেজারকে ডেকে এ কথা বলে দিলো।
আমি বললাম ওই ব্যবস্থা করা লাগবে না ভাই, আমাকে মহৎ সিনেমাটা দেন। সিনেমাটা তখন এক সপ্তাহের জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো আর কি। উনারা বললো, নিয়ে যাও তুমি, কতো দিবা দিও। আমি বললাম, না, আপনারা একটা দাম বলেন। উনারা বললেন, তুমিও তো অনেক দিন ধরে ব্যবসা করছো, একটা দাম বলো, সেটাতেই হবে । আমি বললাম, ৩০ হাজার টাকা দিবো। এটা শুনে উনারা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার কথাই থাকলো।
কাজী মামুন হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।
kmhaiderru@yahoo.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন