তাসবীর সজিব
প্রকাশিত ২০ আগস্ট ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘সুপারবয়েজ অব মালেগাঁও’
মানুষের অন্তর্লীন স্বপ্নের হদিশ করে যে চলচ্চিত্র
তাসবীর সজিব

স্বপ্ন কেবল বড়ো শহরের উজ্জ্বল আলোয় জন্মায় না; অনেক সময় তা জন্ম নেয় ধুলোভরা গলিতে, অপ্রস্তুত ক্যামেরার ঝাপসা ফ্রেমে, আর মানুষের অবদমিত হাসির ভেতর। সুপারবয়েজ অব মালেগাঁও (২০২৪) সেই অন্তর্লীন স্বপ্নের হদিশ করে— যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ মানে কেবল বিনোদন নয়, বরং বেঁচে থাকার আর্তি, সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, আর অগণিত মানুষের নীরব আকাঙ্ক্ষার উন্মোচন।
ভারতের ছোট্ট শহর মালেগাঁও বরাবরই তার ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রচর্চার জন্য পরিচিত। পাইরেটেড সিডি, স্থানীয় সিনেমাহল, এবং সিনেমার প্রতি বিরল অনুভূতি—এই মিশ্রণে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ডকুমেন্টারি Supermen of Malegaon সেই উপলব্ধিকেই তুলে ধরেছিলো। প্রায় দেড় দশক পর মুক্তি পাওয়া সুপারবয়েজ অব মালেগাঁও যেনো সেই গল্পের ধারাবাহিকতাকেই আরো বিস্তৃত করে। এই চলচ্চিত্রে যে গল্পটি দেখা যায় তা আসলে কয়েকজন বন্ধুর অন্তর্লীন স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকা, যে স্বপ্ন শেষমেশ নিজেদের সিনেমা বানানোর, নিজেদের গল্পটা বলতে চাওয়ার এবং এর পাশাপাশি প্রান্তিক একটি শহরে তাদের সামাজিক, মানসিক, নানারকম সঙ্কটকে ঘিরে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে চলচ্চিত্রের গল্পটা এ রকম—মহারাষ্ট্রের একটি ছোট্ট শহর মালেগাঁও, এই শহরেই নাসিরের দাদার একটি ভিডিও পার্লার ছিলো। নাসির এখানেই একটু ভিন্নরকমের সিনেমা দেখাতো। শহরের অন্যান্য প্রান্তে যখন দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে রমরমিয়ে চলছে, নাসির তখন বাস্টার কিটন, চার্লি চ্যাপলিন, ব্রুস লি দেখান দর্শকদের। সচরাচর মানুষ তা দেখতে ভিড় জমায় না। এছাড়া নাসিরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে নানান অনুষ্ঠানের ভিডিও করতে দেখা যায়, নিজের তাগিদেই তিনি ভিডিও এডিটিংয়ের আধুনিক পদ্ধতিও শিখে নেন। এবং বিভিন্ন সিনেমা থেকে কাটিং–এডিটিং করে তিনি সিনেমা দেখাতে থাকেন। কিন্তু, একদিন পাইরেসির কবলে পড়ে সেটাও তাকে ছাড়তে হয়। তারপর নাসির মনস্থির করেন মালেগাঁওয়ের মানুষদের জন্য ওরিজিনাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। নাসির ও তার বন্ধু আক্রাম, ফারোখ, শফিক, ইরফান মিলে তৈরি করে ‘মালেগাঁও কি শোলে’, যেটা সেখানকার মানুষ খুব পছন্দও করে। মানুষের চাহিদা বুঝে নাসির তখন রমেশ সিপ্পি থেকে যশ চোপড়া (ভারতীয় নির্মাতা)’দের সুপারহিট চলচ্চিত্রের সাকসেসফুল প্যারোডি বানাতে থাকেন, যেগুলো মালেগাঁও বাসিন্দাদের নির্মল আনন্দও দেয়।
এরপর অতিবাহিত হয় অনেকগুলো বছর। ফারোখের রাইটার হওয়ার স্বপ্ন তখনো অধুরাই থেকে যায়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় তার কেটে যায় বিভিন্ন প্রোডিউসারের পেছনে ঘুরে ঘুরেই। তবুও একটা সুযোগ তাকে কেউ দেয় না। আক্রম-ও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইরফান চলে যান অন্য এক শহরে। এতে করে নাসিরের ভিডিও পার্লার এক পর্যায়ে পরিণত হয় রেস্টুরেন্টে। সেখানে জুরমানা, রাজা হিন্দুস্থানীর পোস্টারও আর চোখে পড়ে না! কেবল শফিক-ই থেকে যায় নাসিরের সঙ্গে। এদিকে নাসির তখনো তার প্রথম প্রেম মল্লিকাকে ভুলতে পারেন না। নাসির ভয় পান, যদি তিনি কখনো মল্লিকাকে ভুলে যান, তাই মল্লিকার প্রিয় ব্রুস লি-র চলচ্চিত্র দেখতে থাকেন।
দেখতে দেখতে আরো অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। শফিকের শরীরে জটিল রোগ ধরা পড়ে। তার চিকিৎসার জন্য বেশ অর্থের প্রয়োজন। নাসির ও তার বন্ধুরা যে যার মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সময় ফুরিয়ে এসেছে শফিকের, ডাক্তার এমনটাই জানান। শফিক সারাজীবনই নাসিরের ছত্রছায়ায় থেকেছে, বিনিময়ে কিছুই চাননি। অভিনয়শিল্পী হতে চাওয়ার এই স্বপ্নের কথাটা তার প্রেমিকা তৃপ্তিকে জানালেও বন্ধু নাসিরকে কখনোই মুখ ফুটে বলতে পারেননি। অবশেষে জীবনের এমন একটা পর্যায়ে এসে তার সুযোগ তৈরি হয় সুপারম্যান হওয়ার, যখন নিজের জীবন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে! আসলে জীবন বোধ হয় এমন-ই। এটা থেকে তখন মনে হয় সিনেমার ভেতরে স্বপ্ন, স্বপ্নের ভেতরে সিনেমা আর এই স্বপ্নের ভেতরেই মানুষের মুক্তি, মানে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা!
সবশেষে এই চলচ্চিত্র কেবল হাসিতামাশা বা কমেডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং চলচ্চিত্রকে বা যেকোনো শিল্পকে দেখার যে প্রচলিত বাইনারি, অর্থাৎ ‘পপুলার কালচার’ বনাম ‘সাবলটার্ন' বা ‘জনমানসের সংস্কৃতি' অনেক পুরনো যে আলাপ সেটাকেই সামনে নিয়ে আসে। মানে একেবারে বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত চলচ্চিত্র; বা অধিপতিশীল বলিউডের একক রাজত্বের বাইরে গিয়ে একটা প্রান্তিক অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ কীভাবে চলচ্চিত্রকে দেখে— কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাদের যে অস্তিত্বের লড়াই সেই আলাপ বা দাবি-দাওয়াটা জায়গা করে নেয়।
নির্মাতা রীমা কাগতি-ও অন্যদের মতোই তার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষের সামাজিক জীবনের নানান সংঘাত ও দ্বন্দ্বকেই বেছে নিয়েছেন, কিন্তু একটু ভিন্নভাবে। যেমন তাকে অনেকেই চিনে থাকবে তালাশ (২০১২), হানিমুন ট্রাভেলার্স প্রাইভেট লিমিটেড (২০০৭) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তারই নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র সুপারবয়েজ অব মালেগাঁও (২০২৪)।
চলচ্চিত্রের নাম : সুপারবয়েজ অব মালেগাঁও
নির্মাতা : রীমা কাগতি
নির্মাণকাল : ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সম্পাদনা : আনন্দ সুবায়া
চিত্রনাট্য : বরুণ গ্রোভার
সঙ্গীত পরিচালনা : শচিন জিগার
চিত্রগ্রহণ : স্বপ্নিল এস. সোনাওয়ানে
প্রযোজনা : জয়া আখতার, রীমা কাগতি, ফারহান আখতার ও ঋতেশ সিধওয়ানি
ব্যাপ্তি : দুই ঘণ্টা ১১ মিনিট
অভিনয়শিল্পী : আদর্শ গৌরভ, ভিনীত কুমার সিং, শশাঙ্ক অরোরা, অনুজ সিং ধুহান, ঋদ্ধি কুমার, সাকিব আয়ুব, পল্লব সিং, মুসকান জাফেরি, মঞ্জিরি পুপালা, জ্ঞানেন্দ্র ত্রিপাঠি, অনমল কাজানি, জগদীশ রাজপুরোহিত, আলি আব্বাস, নেহা মিশ্রা ও নির্ভয় জৈন
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন