Magic Lanthon

               

রায়হান রাফী

প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রথম পর্ব.

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ

রায়হান রাফী


ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১২

স্থান : ১৫০, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলা ভবন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

২৬ অক্টোবর ২০২৪, বেলা : ১১টা

প্রথম পর্ব

রোকসানা আরশি : শুভ সময়। সবাইকে শুভেচ্ছা। হেমন্তের মৃদু শীতমাখা মিষ্টি সকাল আমাদের ঠিক যেমন স্নিগ্ধ ভোর দেখায়, সেই স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে যাক আমাদের স্বপ্নগুলোকে। আমরা বিশ্বাস করি, অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থান আরো একবার আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে; স্বপ্ন বলছি কারণ এখনো অনেক পথই বাকি! তার পরও স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেওয়ার তাড়না নিয়ে, আজকে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। সেইসঙ্গে স্মরণ করছি এই গণঅভ্যুত্থানের আহত ও নিহত অগ্রপথিকদের। যারা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়ে নতুন করে আমাদের স্বদেশ নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই ভাবনাকে মাথায় রেখেই আমাদের আজকের আয়োজন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১২’। পরিবর্তিত এ সময়কে সঙ্গী করে যারা এই আয়োজনে সামিল হয়েছেন, তাদের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শুরু করছি ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১২’। সঞ্চালনায় আছি আমি রোকসানা আরশি।

জেরিন আল জান্নাত : সঙ্গে আমি জেরিন আল জান্নাত। আমন্ত্রিত অতিথি ও উপস্থিত দর্শকের সঙ্গে খানিক পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যেই জানিয়ে রাখি, চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যমবিষয়ক ষান্মাসিক পত্রিকা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন'-এর পথচলা শুরু ২০১১ খ্রিস্টাব্দে। এ বছরের জুলাইয়ে প্রকাশ হয়েছে এর ২৭তম সংখ্যা।

আরশি : ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ বছরব্যাপী নানা আয়োজন নিয়ে আপনাদের কাছে হাজির থাকে। উল্লেখযোগ্য এসব আয়োজনের তালিকায় রয়েছে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা’, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন বাতচিত’ ও ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’। পাশাপাশি নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনসহ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজও করে থাকে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’। শ্রোতামণ্ডলী, আপনারা হয়তো খানিকটা আঁচ করতে পারছেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন'-এর বাৎসরিক কাক্সিক্ষত আয়োজন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা’। এই অনুষ্ঠানের জন্য চলচ্চিত্রাঙ্গনের পেশাদার ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে থাকে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন'। জানিয়ে রাখি প্রথমবার কথামালা অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ খ্রিস্টাব্দে।

জেরিন : চলচ্চিত্রনির্মাতা নূরুল আলম আতিকের কথা উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা’র। এরপর ধারাবাহিকভাবে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ ১০টি কথামালার আয়োজন করে। বর্ষপঞ্জি ঘুরে আসা এই আয়োজনের আহ্বানে কথা উপস্থাপন করে গেছেন নির্মাতা আবু সাইয়ীদ, গোলাম রাব্বানী বিপ্লব, অভিনয়শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী কাজী হায়াৎ, অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, অভিনয়শিল্পী রাইসুল ইসলাম আসাদ, নির্মাতা শামীম আখতার, নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন এবং সর্বশেষ এসেছেন শব্দগ্রাহক রিপন নাথ।

আরশি : শব্দের কারিগর রিপন নাথ সর্বশেষ কথামালায় কথা উপস্থাপন করেন ‘শব্দ আর শব্দহীনতার কল্পনা, ধ্বনির রাজ্যে বসবাস’ প্রসঙ্গে।

অনেকেই এমনটা বলে থাকেন চলচ্চিত্র সমাজের দর্পণ। যেখানে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। তবে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে যে শাসন-শোষণ চলেছে তার কবল থেকে চলচ্চিত্রও রেহাই পায়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই প্রহসনের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের অনবদ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আমাদের আজকের অতিথি সেই প্রজন্মেরই একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। রায়হান রাফী। তিনি কথা উপস্থাপন করবেন ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ’ নিয়ে। নির্মাতা রাফীর বড়ো পর্দায় অভিষেক ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে, পোড়ামন ২ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর একে একে রাফী নির্মাণ করেন জানোয়ার, পরাণ, দামাল, সুড়ঙ্গ এবং সর্বশেষ আলোচিত চলচ্চিত্র তুফান। কেবল চলচ্চিত্রই নয়, নির্মাতা রাফীর ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শকনন্দিত ওয়েবফিল্মও। দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, টান, ৭ নাম্বার ফ্লোর, নিঃশ্বাস এবং সর্বশেষ মায়া। তার ওয়েবফিল্ম অমীমাংসিত রাষ্ট্রের চরম দমনপীড়নের শিকার হয়। যার কারণে তা এখনো দর্শকের দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

জেরিন : রায়হান রাফীর এসব চলচ্চিত্র ও ওয়েবফিল্মের প্রায় সবগুলোই দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এর পাশাপাশি তাকে এনে দিয়েছে স্বীকৃতিও। তার প্রথম চলচ্চিত্র পোড়ামন ২ ‘মেরিল প্রথম আলো’ পুরস্কার ২০১৮-তে চারটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। ২০২২-এ খাঁচার ভেতর অচিন পাখি নামের ওয়েবফিল্মটিও তাকে এনে দেয় ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পুরস্কার।

আরশি : অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আজকের অতিথি রায়হান রাফীকে মঞ্চে আসন গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এবারে অতিথিকে স্মারক প্রদান করবেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর সাবেক সহকারী সম্পাদক মো. হারুন অর রশিদ। মঞ্চে আহ্বান করছি হারুন অর রশিদকে।

জেরিন : এ পর্যায়ে রায়হান রাফীকে উপহার দিয়ে বরণ করে নেবেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর সহযোগী সম্পাদক সোহাগ আব্দুল্লাহ। অতিথিকে উপহার দেওয়ার জন্য মঞ্চে আসার অনুরোধ করছি সোহাগ আব্দুল্লাহকে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা আজকের আয়োজনের মূল আকর্ষণ রায়হান রাফীর কথা শুনবো। মূল আয়োজনে যাওয়ার আগে শুভেচ্ছা বক্তব্য নিয়ে আসছেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর সহকারী সম্পাদক রীতা জান্নাত।

রীতা জান্নাত : শুভেচ্ছা সবাইকে। প্রথমেই আমি দুঃখ প্রকাশ করছি এবং একইসঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনাদের। কারণ আপনারা জানেন যে, হঠাৎ করেই আমাদের অনুষ্ঠানের সময় পরিবর্তন হয়েছে। তা সত্ত্বেও আপনারা যারা আমাদের আজকের আয়োজনে এই মুহূর্তে সামিল হয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। আজকের অতিথি রায়হান রাফীকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের আয়োজনে উপস্থিত হওয়ার জন্য। আমরা এখন গণঅভ্যুত্থানের পরের সময়টাতে এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই পরিবর্তনটা এসেছে তরুণদের হাত ধরেই। এ পরিবর্তনে যেমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনই নানা ধরনের শঙ্কার জায়গাও আছে। সেই শঙ্কা শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রেই। এই ধরনের পরিস্থিতিতে শিল্প ও সংস্কৃতিতেও এক ধরনের বদল আসে। এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, চলচ্চিত্র আমাদের শিল্প চর্চার অন্যতম মাধ্যম। দীর্ঘদিন আমরা একটা ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তরুণরাই আমাদের সিনেমায় এগিয়ে আসে। এরই মধ্যে আমাদের দেশে ঘটে যায় এক অভ্যুত্থান। মানুষের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি হয় নানা বিষয়ের পরিবর্তনের। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রকে আমরা কীভাবে দেখবো, এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন হবে, আর সেসবের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, এসব নিয়ে কথা বলাটা অতীব জরুরি এই মুহূর্তে। সেই কথা বলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আমাদের আজকের আয়োজন ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ’ শিরোনামের এই কথামালা। তরুণ প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রনির্মাতা রায়হান রাফী এ বিষয়ে কথা বলবেন; আমরা এখন শুনবো তার কথা। আমি আর কথা দীর্ঘায়িত করছি না। সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আবারও।

রায়হান রাফী’কে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দিচ্ছেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর সাবেক সহকারী সম্পাদক মো, হারুন-অর-রশিদ,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

আরশি : ধন্যবাদ রীতা জান্নাতকে। আমন্ত্রিত সবার উদ্দেশ্যেই বলে রাখি, আজকের অনুষ্ঠান আমরা সাজিয়েছি দুটি পর্বে। প্রথম পর্বে আলোচকের কথা উপস্থাপনের পর দ্বিতীয় পর্বে সবার অংশগ্রহণে থাকবে প্রশ্নোত্তর পর্ব। কথা উপস্থাপনের মধ্যেই উপস্থিত সবার কাছে আমাদের সদস্যরা সাদা কাগজ পৌঁছে দেবে। সেখানে আপনাদের নাম, বিভাগ ও প্রশ্ন লিখে রাখবেন। পরে সদস্যরা সেগুলো সংগ্রহ করে নেবে। সেই সব প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করবেন আজকের অতিথি। এ পর্যায়ে কথা উপস্থাপন করতে আসছেন রায়হান রাফী। তিনি কথা বলবেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ’ প্রসঙ্গে। নির্মাতাকে অনুরোধ করছি তার কথা উপস্থাপনের জন্য।

রায়হান রাফী : আসসালামু আলাইকুম। সবাই কেমন আছেন? খুবই ভালো লাগছে এখানে উপস্থিত সবাইকে দেখে। বরাবরই এ ধরনের প্রোগ্রামে যেতে আমার ভালো লাগে। কারণ আমি যখন মানুষের সঙ্গেযারা আসলে আমাদের সিনেমা দেখে, যারা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করে, বা যারা ভবিষ্যৎ ফিল্মমেকার হতে চায়তাদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলি, সেটা আমার জন্য খুব ভালো হয়। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি সামনে কী করবো, কিংবা এখনকার প্রজন্ম ঠিক কী ভাবছে? আমি ঢাকায় বসে সিনেমা বানাচ্ছি, একজন মানুষ রাজশাহীতে বসে কী ভাবছে সিনেমা নিয়ে কিংবা তার কী চিন্তাধারা। সে কেমন চলচ্চিত্র দেখতে চায়, কিংবা কেমন চলচ্চিত্র বানাতে চায়? এজন্য সবসময় আমি চেষ্টা করি এ ধরনের প্রোগ্রামগুলোতে যেতে। আমার মনে হয়, আমি নিজের মধ্যেও একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করি এবং মন খুলে কথা বলতে পারি।

আমি খুব ভালো বক্তা নই, ফলে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারবো না। আমি হয়তো নরমালি আপনাদের সঙ্গে একটু আড্ডা দেবো। জানি না আমার কথা আপনাদের কেমন লাগবে! এজন্য শুরুতেই আপনাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি একটু আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করবো, আপনাদের কথা শুনবো, আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবো। আমি হয়তো সিনেমায় আমার জার্নির গল্পটা আপনাদের শোনাতে পারি। আমি কীভাবে এখানে মানে সিনেমা জগতে আসলাম। কীভাবে সিনেমা জগতটা এখন চলছে? কীভাবে আমরা সিনেমাটা বানাই; সেখানে কী ধরনের কষ্ট আমাদের হয়; কী কী সুবিধা আমাদের আছে? সামনের দিনের সিনেমা ঠিক কেমন হবে, মানে এর ভবিষ্যৎ? আপনাদের মধ্যে কেউ যদি কখনো সিনেমায় অভিনয় করতে চান; কিংবা গল্প লিখতে চান; বা কোনোভাবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চানতার ক্যারিয়ারে এটা যেনো সাহায্য করে আর কি।

শুরুতেই আমি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেসব স্টুডেন্ট ও সাধারণ মানুষ আত্মত্যাগ করেছে, তাদেরকে স্মরণ করছি। তারা আমাদেরকে নতুন একটি বাংলাদেশ দিয়েছে। আমাদেরকে সাহস দিয়েছে। একটা কথা আমাদের মধ্যে চালু আছে, এই জেনারেশনযারা আমাদের আগের জেনারেশন তারা বলতোকেবল গেমস খেলায় ব্যস্ত, ফেইসবুকে লেখালেখি করায় ব্যস্ত। এরা আসলে কিছু করতে পারবে না। এদেরকে ফার্মের মুরগি বলতো! এই ফার্মের মুরগিরা এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে, যা সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে স্টুডেন্টের ক্ষমতা কতো বেশি! এজন্য এখন আমরা এই প্রজন্মকে নিয়ে গর্ব করতে পারি; এই প্রজন্ম চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। আমি তাদেরকে স্মরণ করছি, যারা সাহস নিয়ে বুক পেতে দিয়েছিলো বন্দুকের নলের সামনে। তারা যদি সাহসটা না দেখাতো বাংলাদেশ আজকের বাংলাদেশ হতো না। এবং এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক দুঃখের, একইসঙ্গে অনেক সম্ভাবনার যে, এই প্রজন্ম খুব ভয়ঙ্কর। তারা যে খুব ভয়ঙ্কর সেটা তারা দেখিয়েও দিয়েছে।

আমাদের দায়িত্ব মানে আমরা যারা নির্মাতা, তাদেরকেও শিখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে সাহস করে সিনেমা বানানো যায়। আমরাও চেষ্টা করি সাহস নিয়ে সিনেমা বানানোর, কখনো পারি, কখনো পারি না। এখানে সঞ্চালক বলছিলেন, আমার একটা সিনেমার কথা; আমি খুব শখ করে একটা সিনেমা বানিয়েছিলাম ওটিটির জন্য। কেনো ওটিটির জন্য বানিয়েছিলাম? কারণ সিনেমাহলের জন্য রিলিজ দিলে এই সিনেমাটা মুক্তি পাবে না। সিনেমাহলের জন্য সিনেমা বানালে সেন্সরশিপ লাগে, নানা ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখন আমি চিন্তা করলাম, এমন একটা সিনেমা বানাই, যেটার জন্য সেন্সরশিপে যেতে হবে না। এই সিনেমা ওটিটিতে মুক্তি পাবে এবং আমি আমার বক্তব্যটা দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারবো।

আপনারা জানেন, বাংলাদেশের একটা খুব ভয়ঙ্কর ঘটনা, এক সাংবাদিক দম্পতির মৃত্যুসাগর-রুনি। আমি এগ্জ্যাক্টলি তাদের গল্প নিয়ে সিনেমাটা বানাইনি, যেহেতু কেসটা এখনো চলছে। আমি সেই গল্প থেকে ফিকশনাল করে একটা গল্প বলার চেষ্টা করেছিকেনো এতো বড়ো একটা হত্যাকাণ্ড, কেনো এতো এতো গোয়েন্দা থাকার পরও সল্ভ হচ্ছে না, কেনো এখনো অমীমাংসিত! এভাবেই আমি সিনেমাটা নির্মাণ করি, রিলিজ ডেটও ঠিক হয়। এর ঠিক আগ মুহূর্তে, রিলিজের এক-দুই দিন আগে হঠাৎ করে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে ফোন আসে, এই ছবিটা সেন্সর করতে হবে। আপনারা নিশ্চয়  জানেন, ওটিটির সিনেমা সেন্সর করা লাগে না। এটার নিয়ম নেই। সিনেমাহলে যেটা চলবে সেটা সেন্সর করতে হয়। আমরা সেন্সরের জন্য সিনেমাটা জমা দিলাম। আমরা ভাবলাম, এমন কিছু তো বানাইনি যা রাষ্ট্রবিরোধী বা দেশবিরোধী। আমি একজন সচেতন নির্মাতা হিসেবে একটা গল্প বলার চেষ্টা করেছি। এক সাংবাদিক দম্পতির গল্প বলার চেষ্টা করেছি। আমরা কোথাও এটা বলি নাই যে, এটা সাগর-রুনির গল্প। কিন্তু সামহাউ তারা এটাকে থ্রেড মনে করে এবং এটাকে নিষিদ্ধ করে। ফলে সিনেমাটা আর দর্শক দেখতে পারে না। আমাকে এখনো অনেক দর্শক মেসেজ পাঠায়, তারা অমীমাংসিত নামে সেই সিনেমাটা দেখতে চায়।

আমি মাঝে মাঝে চেষ্টা করি রিয়েল স্টোরি নিয়ে কাজ করার। আমি সেটা এনজয়-ও করি। আমার কাছে মনে হয়, সিনেমা জিনিসটা এমন কিছুএই যে কথাটা বললাম আমি কেনো সিনেমা বানাইআমার কাছে মনে হয়, আমি অনেক বেশি সাহসী না, মানে রাস্তায় নামতে পারবো না। আমি অনেক বেশি ভালো বক্তৃতা করতে পারবো না। আমি ভালো পলিটিশিয়ান না। ভালো নেতা না! আমি যেটা পারি, গল্পের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিতে পারি। গল্পের মাধ্যমে একটা বক্তব্য তুলে ধরতে পারি। এজন্যই এই জিনিসটা বেছে নিয়েছি মানে সিনেমার মাধ্যমে আমি আমার প্রতিবাদ, ভালোবাসা, ভালো লাগা, ইমোশনগুলোকে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারবো। আমি এই বিষয়টা খুব এনজয় করি। তাই আমার জার্নিটা একটু শেয়ার করতে চাই আপনাদের সঙ্গে। কারণ আপনাদের অনেকের ধারণা হতে পারে, বা আমরা অনেকেই ভাবিযারা নির্মাতা হতে চাই, সিনেমা বানাতে চাইঢাকায় না থাকলে, মেইন শহরে না থাকলে বা মিডিয়ার সঙ্গে কানেকশন না থাকলে হয়তো ওই জায়গাটাতে পৌঁছোতে পারবো না। আমি কিন্তু মাদ্রাসার স্টুডেন্ট। সেখান থেকেই পড়ালেখা করেছি। এটার একটা দুর্দান্ত গল্প আছে, আমি ঠিক কেনো মাদ্রাসায় পড়লাম! যখন ছোটো ছিলাম, তখন মাদ্রাসায় পড়াটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগতো। আমার মনে হতো, আমি কেনো মাদ্রাসায় পড়ি! মাদ্রাসার পড়ানোর ব্যবস্থা নিয়ে আমার কষ্ট ছিলো না, আমার কষ্ট ছিলো আমি নিজের ইচ্ছায় তো আর মাদ্রাসায় আসি নাই। আমার বাবা-মা আমাকে এখানে ভর্তি করিয়েছিলেন। আমার বংশের সবাই স্কুলে পড়ে, আমার বোনরা সবাই স্কুলে পড়ে, দেশের বাইরে যাচ্ছে পড়তে। আমিই কেবল মাদ্রাসায় পড়ছি।

আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমি সবার শেষ মানে ছোটো। আমার বাবা ছিলেন এয়ারফোর্সের পাইলট। উনি রিটায়ার্ড করেছেন, এখনো বেঁচে আছেন। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। আমার মায়ের খুব শখ ছিলো একটা ছেলে যদি হতো, তাহলে খুব ভালো হতো। প্রথমে একটা মেয়ে হলো, তার পাঁচ বছর পর আরেকটা মেয়ে, তারও সাত বছর পর আরেকটা মেয়ে। তিন মেয়ে, কোনোভাবেই আর ছেলে হচ্ছে না। বিভিন্ন হুজুরের কাছে গিয়ে বিভিন্ন রকমের তাবিজ করা হলো। তখন নাকি আমার আম্মুকে যে যা দিতো তিনি তাই খেতেন। তিনি হয়তো মনে করতেন এগুলো খেলেই ছেলে হবে। কিন্তু ছেলে আর হয় না। তখন তিনি এক আলেমের কাছে গেলেনকী করলে ছেলেসন্তান হতে পারে? তখন সেই আলেম বললেন, দেখেন আপনি একটা নিয়ত করেন, আপনার ছেলে হলে তাকে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করাবেন। তাহলে হয়তো আল্লাহ আপনার চাওয়া কবুল করতেও পারে। আল্লাহর রহমতে তার পর ছেলে হলো। এবং নিয়তের কারণেই আমাকে মাদ্রাসায় পড়ানো হয়েছিলো।

এই গল্পটা আমি ঠিক কেনো বলছি, সেটা আমি একটু পরে ব্যাখ্যা করছি। এর পরে আমার জার্নিটা একেবারে অন্যরকম; আমার বংশের মধ্যে মাদ্রাসায় পড়ে এমন কেউ নাই। হঠাৎ করে একটা হোস্টেল টাইপের জীবনে চলে গেলাম। যেহেতু এতো বছর পর একটা ছেলে, আমি মায়ের খুব আদরের ছিলাম। আমার বাবা-মা আমাকে কখনোই নাম ধরে ডাকে নাই। আমাকে তারা সবসময় বাবু বলে ডাকতো, এখনো বাবু বলেই ডাকে। মাত্র সাত বছর বয়সে আমাকে হোস্টেলে দিয়ে আসা হলো। সেখানে একেবারে অন্যরকম একটা লাইফ। সবাই একসঙ্গে থাকে, পায়জামা-পাঞ্জাবি, টুপি পরে। সেখানে টেলিভিশন নাই, গানবাজনা নাই। একেবারে অন্যরকম ব্যবস্থা, অন্যরকম কালচার! আমি সেই কালচারের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম না, যেহেতু আমি বা আমার ফ্যামিলি ওই লাইনে ছিলো না। কিন্তু সেসময় আমি লক্ষ করি, আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার হয়, আমি অনেক কিছু বলতে চাই।

ওই সময় আমি যখন টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেতাম, মাসে এক-দুইবার, তখন খুব ডিটেইলে সিনেমা দেখতাম। আমি ভাবতাম, আল্লাহ এটা কীভাবে হচ্ছে! এখনকার বাচ্চাদের যেমন হয়, হাতের মধ্যে মোবাইল আছে, টেলিফোন আছে, চাইলেই টেলিভিশন ছেড়ে দিচ্ছেটেলিভিশনটা খুব ইজি তার কাছে। আমার কাছে তখন এটা খুব ইজি ছিলো না।মাসে একবার যদি কেউ টেলিভিশন দেখে সে তাহলে কীভাবে দেখবে, খুব ডিটেইলেই তো দেখবে। তাই আমি টেলিভিশনটা খুব ডিটেইলে দেখতাম, কারণ আমি তো সবসময় দেখতে পারবো না, ফলে ভালো করে দেখে নিই। তবে ছুটিতে বাসায় আসলে দেখতাম।

আমার মধ্যে তখন অনেক প্রশ্ন তৈরি হতো। এটা এ রকম কেনো, ওটা ও রকম কেনো? আমার মাদ্রাসাটা যেখানে ছিলো সেই জায়গাটা একটা হাইওয়ের পাশে। তার ঠিক একটু সামনেই একটা পুলিশ ফাঁড়ি ছিলো¾হাইওয়ে পুলিশ। ওখানে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া, খুন হওয়া লাশ আসতো। আসামীদেরকেও ধরে নিয়ে আসতো ওখানে। জানালা দিয়ে ওটা দেখা যেতো। মাদ্রাসাতে তো পড়ালেখা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ ছিলো না; একটা ঘরের মধ্যে আমরা বন্দি থাকতাম। আমরা বেশিরভাগ সময় বোর হয়ে যেতাম; কী করবো! আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেটা করতাম, দূর দিয়ে যেসব মানুষ হেঁটে যেতো, কথা বলতো, আমি তাদের দেখে কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, ওরা মনে হয় ওই কথাটা বলছে। এটা আমার একটা এন্টারটেইনমেন্ট ছিলো আরকি! ধরেন, ওই ফাঁড়িতে একটা লাশ আসছে, দেখা যাচ্ছে তার বাবা-মা কান্না করছে, আমি ধরে নিতাম এটা হয়তো তার বাবা, এটা হয়তো তার মা। এর কারণ হয়তো সে মারা গেছে কিংবা এজন্য তারা কাঁদতেছে। ওই ইমোশনগুলো আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। কিংবা কোনো গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড হেঁটে যাচ্ছে, অটোমেটিক আমার মাথার মধ্যে তৈরি হতো ওরা মনে হয় এই নিয়ে কথা বলছে। আমি তখন বুঝি নাই, ওইটা আমার জীবনে এখন এসে খুব কাজে লাগবে! আলটিমেটলি আমরা যারা সিনেমা বানাই, গল্প লিখি, আমাদের তো কল্পনা করতে হয়। ওই যে ছোটোবেলায় কল্পনাশক্তিটা আমার তৈরি হয়েছিলো, সেটা এখন আমার জীবনে এসে খুবই কাজে দিচ্ছে।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দিচ্ছেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর সহকারী সম্পাদক রীতা জান্নাত,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

আমার ক্যারিয়ার খুব ছোটো; ২০১৮ সালে আমার প্রথম সিনেমা মুক্তি পায়। এখন ২০২৪ সাল, মাঝখানে দুই বছর কোভিড ছিলো। এতো অল্প সময়ে মনে হয় কোনো ডিরেক্টরকে আল্লাহতাআলা এই জায়গায় পৌঁছায় নাই। ফলে আমি খুব লাকি। কিন্তু আমার এখন মনে হয়, আমি যদি হোস্টেলে না থাকতাম, মাদ্রাসায় না পড়তাম, আমাকে যদি অনেক কিছু নিষেধ করা না হতোএই যে বাধা, সেটা খুব ইম্পরট্যান্ট মানুষের জীবনে। এবং যখনই কোনো কিছুতে অনেক বাধা আসে, তখনই সেখান থেকে অন্য কিছু বেরিয়ে আসে। ওই জন্য আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, আমি হোস্টেলে ছিলাম বলে আমার অন্যরকম একটা ফিলোসফি তৈরি হয়েছে। আমি আসলে জীবনটাকে অন্যভাবে দেখেছি। জীবনটাকে সহজভাবে দেখি নাই; জীবনটাকে খাঁচার ভেতর থেকে দেখেছি। এই অভিজ্ঞতাটা আমার জীবনে অনেক কাজে লেগেছে।

তবে তখন কিন্তু আমি জানি না সিনেমার ডিরেক্টর হবো; সিনেমা বানাবো; সেটা তখনো আমার মধ্যে আসে নাই। তখন অন্যদের মতো আমারও কখনো ইচ্ছে হতো খেলোয়াড় হবো; কখনো ইচ্ছে হতো আব্বুর মতো পাইলট হবো; কখনো ইচ্ছে হতো রিকশাওয়ালা হবো। আমার তখন রিকশা চালানো দেখতে খুব ভালো লাগতো। আবার কখনো আলেম হতে চাইতাম। আমাদের ওস্তাদরা যারা ছিলো, তারা যখন বক্তব্য দিতো, তখন সেটা দেখে ইচ্ছে হতো একজন আলেম হবো। নানারকম স্বপ্ন!

হোস্টেলে আমাদের কিছু বড়োভাই ছিলোএখানে নিশ্চয় অনেকে হোস্টেলে থেকেছেন, সেখানকার কিছু নিয়ম আছে; সিনিয়র, জুনিয়রের বিষয় আছে। হোস্টেলে আমাদের যে বড়োভাইয়েরা ছিলো, শুক্রবারের দিন দেখতাম তারা কোথায় যেনো যেতো; তিন-চার ঘণ্টার মতো হোস্টেলে থাকতো না। এর পর সেখান থেকে ফিরে আসার পর দেখতাম, তারা কোনো কিছু নিয়ে তিন-চার দিন ধরে গল্প করছে। আমরা ছোটোরা সেখানে গেলে তারা কেমন জানি চুপ হয়ে যেতো। আমরা বুঝতাম কিছু একটা নিয়ে ওরা হাসাহাসি করছে, গল্প করছে। আমার ভেতর ছোটোবেলা থেকেই খুব কিউরিওসিটি ছিলো, আমি খুব প্রশ্ন করতামএটা কেনো হয়, ওটা কেনো হয়? আমি তখন চিন্তা করলাম, এরা আসলে কোথায় যায়? তিনদিন ধরে কী নিয়ে গল্প করে, আমরা সামনে গেলেই কেনো থেমে যায়! আমি একদিন সাহস করে এক বড়োভাইকে বললাম, ভাই আপনারা কোথায় যান আমি কিন্তু জানি! আমার এই কথা শুনে ওরা চিন্তায় পড়ে যায়; ও এটা জানে কীভাবে! ওরা আমাকে ধরে তো র‌্যাগ দেওয়ার মতো অবস্থা! আমি যদি এই ঘটনা ওস্তাদদের বলে দিই।

ফলে ওরা আমাকে নিয়ে বসলো, তার পর বললো, তুই কেমনে জানিস, আমরা কোথায় যাই? আমি তখন ওদেরকে বললাম, আপনাদেরকে আমি ফলো করেছি। তিন ঘণ্টা আপনারা হোস্টেলে থাকেন না, তার পর আসেন। তার পর শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে বিষয়টা বললো; কিন্তু এই কথা কাউকে বলা যাবে না। তুই যদি তার পরও বলিস, তাহলে কিন্তু তোকে আমরা মারবো। আমি তখন বললাম, কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু এর পরেরবার যখন আপনারা যাবেন আমাকে নিয়ে যাবেন। আমার এই কথা শুনে ওরা আরো ক্ষেপে গেলোতোর এতো বড়ো সাহস, তুই একটা জুনিয়র ছেলে সিনিয়রদের সঙ্গে যেতে চাচ্ছিস। আমি তখন ওদেরকে একটা টোপ দিলাম এইভাবেআচ্ছা, আপনারা যেখানেই যান, সেখানে তো আপনাদের টাকা খরচ হয়, তাই না? এই খরচের টাকাটা আমি আপনাদেরকে দেবো, আপনারা খালি আমাকে নিয়ে যাবেন। এই টোপে কিছুটা কাজ হয়। ওরা আমাকে বলে ঠিক আছে, আমরা চিন্তা ভাবনা করে দেখি। কারণ এই বিষয়টা তো আসলেই খুব কনফিডেন্সিয়াল, ওরা আসলে লুকিয়ে সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যেতো।

শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হলো, তখন আমি ওদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো সিনেমা দেখতে গেলাম সিনেমাহলে। এই সিনেমা দেখাটা আমার জীবনে খুবই অন্যরকম একটা বিষয় ছিলো! তখন সিনেমাহলে পর্দার উপরে আরেকটা পর্দা ছিলো, সেটা খুলে দেওয়ার পর স্বাগতম লেখা ভেসে উঠতো; তার পর সিনেমা শুরু হতো। আমার কাছে বিষয়টা খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিলো। এর আগে আমি কোনো দিন সিনেমাহলে যাই নাই। সবাই লাইন ধরে টিকিট কেটে সিনেমাহলে ঢুকছে। সিনেমা শুরুর আগে গান হচ্ছে, পর্দা খুলে যাচ্ছে, সিনেমা শুরু হচ্ছে! সিনেমা শুরুর পর যখন ডিরেক্টরের নামটা আসলোতখন আমার বয়স আর কতো হবে, আট-নয় বছরতখনই আমি বুঝতে পারছি এই লোকটাই এখানে মেইন, যে আসলে সিনেমাটা বানায়। এটা আমার মধ্যে সামহাউ ওই সময়েই ঢুকছে আর কি! এর পর থেকে আমার মধ্যে একটা নেশার মতো হয়ে যায়। আমিও নিয়মিত বড়োভাইদের সঙ্গে সিনেমাহলে যাওয়া শুরু করি। যে সিনেমাই দেখি, আমার খুব ভালো লাগে। তখন কিছু অশ্লীল সিনেমাও হচ্ছিলো। সিনেমা হলেই হলো, মানে সিনেমা দেখতে আমার ভালো লাগতো আর কি। সিনেমা দেখতে দেখতে আরেকটা বিষয় আমি করতাম, হোস্টেলে ফিরে এসে এগুলো নিয়ে ভাবতামএটা এই রকম না হয়ে ওই রকম হলে ভালো হতো। গল্পটা কেনো এ রকম হলো না! এভাবে আমার নেশার মতো হয়ে গেলো। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং একটা জার্নির গল্প। কোনো একদিন এই ঘটনা নিয়েই আমি হয়তো একটা সিনেমা-ই বানিয়ে ফেলবো।

আমাদের তো পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা থাকতো, সিনেমাহলে ওই পোশাকে ঢোকা তো ডিফিকাল্ট, কেমন দেখা যায়! ফলে কোনো একটা দোকানে গিয়ে সেখানে চেঞ্জ করে, গেঞ্জি পরে সিনেমাহলে ঢুকে পরতাম। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলোজঙ্গি হামলা হলো না সিনেমাহলেএর পর থেকে হুজুরদেরকে কেউ আর সিনেমাহলে ঢুকতে দিচ্ছিলো না। এটা আমাদের জন্য একটা বড়ো বিপদ হয়ে যায়! হঠাৎ করেই দেশের ৬৪ জেলায় জঙ্গিরা বোমা হামলা করলো। এর পর থেকে সবাই অ্যালার্ট হয়ে গেলো। এই ঘটনার পর কী হলোএখন যেমন আওয়ামী লীগকে আপনারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছেন না, ওই সময় ছিলো জঙ্গিরা। তারা কখন, কোথায় বোমা মারবে কেউ জানে না।

এখন আমাদের যেটা সমস্যা হলো, সিনেমাহলে তো ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু সিনেমাহলে তো যেতেই হবে। সমস্যা হলো, এখন আর কোনো দোকানের সামনে গিয়ে পাঞ্জাবি খোলাও যাচ্ছে না। কারণ তাতে মানুষ আরো সন্দেহ করতে পারে। তখন আমরা বুদ্ধি করে অন্য একটা লাইনে সিনেমাহলে ঢোকার ব্যবস্থা করি। ফলে এই যে সিনেমা নিয়ে আমার জীবনের একটা জার্নিতখন বুঝতাম না, এখন বুঝিওইটা আমার ভেতরে একটা ডিরেক্টর সত্তা, একটা রাইটার সত্তা দিয়েছে আরকি। কিন্তু আমি তখনো জানতাম, আমি আসলে কখনো ডিরেক্টর হতে পারবো না। কারণ মাদ্রাসায় পড়ে সিনেমা বানানো সম্ভব না। আমার মনে হতো, এ নিয়ে আমার কোনো পড়ালেখা নাই, আমি কাউকে চিনি না। কিন্তু তখন ডিরেক্টর হওয়া আমার অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে একটা স্বপ্ন।

তার পর আরেকটা জিনিস আমার জীবনে খুব বেশি কাজে লেগেছে। আমরা হোস্টেলে একটা সময় একেবারে ফ্রি থাকতামবিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্তএই সময়টায় আমাদের ব্রেক ছিলো। এর বাইরে বাকি সময় আমাদেরকে কোনো না কোনো পড়ালেখার মধ্যেই থাকতে হতো। আমাদের তো আপনাদের ইউনিভার্সিটির মতো এতো সুন্দর মাঠ ছিলো না। এখনকার মাদ্রাসাগুলো তো এতো ওপেন না, একটা বিল্ডিংয়ের মধ্যে পুরো মাদ্রাসা থাকতো। ফলে আমরা যেটা করতাম, ওই বিল্ডিংয়ের ভেতরেই ক্রিকেট খেলতাম; মানে ওখানেই সবকিছু। সপ্তাহে একদিন আমাদেরকে বাইরে ঘুরিয়ে আনা হতো।

আমি যেটা করতাম, এই যে আমি সিনেমা দেখতাম, সেই সব সিনেমার গল্পগুলো আমার ফ্রেন্ডদেরকে বলতাম। এবং এইসব গল্প শুনে ওরা খুব এনজয় করতো। আমি তো খুব কম সিনেমা দেখেছি সিনেমাহলে, এই ধরেন ৪০টার মতো হবে। এখন ৪০টা সিনেমার গল্প তো ৪০ দিনেই শেষ। তাহলে এর পরে আমি কী বলবো! তখন আমি ওদেরকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতাম। আমি যদি ওদেরকে তখন বলতাম গল্পটা বানানো, তাহলে কিন্তু ওরা শুনতো না। ফলে ওদেরকে বলতাম, এই ধরনের একটা সিনেমা আছে, আমি দেখেছি। একই সিনেমার গল্প আমি তিনবার তিনভাবে বলতাম আরকি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ফলে এখন আমি যখন সিনেমার গল্প লিখি, সেটা অটোমেটিক আড়াই ঘণ্টা হয়ে যায়। এটা আমার মাদ্রাসা জীবনের ওই গল্প বলা থেকে এসেছে। তখনো কিন্তু আমি জানি কোনো দিন ডিরেক্টর হতে পারবো না।

এরই মধ্যে হঠাৎ করে একদিন আমি একটা নিউজ দেখলাম, তারেক মাসুদ বলে একজন ফিল্ম ডিরেক্টরের সিনেমা কান ফেস্টিভালে গেছে। কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গেছে, খুব ভালো কথা, কিন্তু আমার আগ্রহের জায়গা হলো তিনি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছেন। এটা আমার মধ্যে নতুন করে স্বপ্ন তৈরি করে। তার মানে উনি যদি মাদ্রাসাতে পড়ে কান-এ যেতে পারেন, এবং তাকে এতো সম্মান করে বাংলাদেশের মানুষ; তাহলে আমিও যেতে পারবো। এবার আমি তারেক মাসুদকে খোঁজা শুরু করলাম। ওনার সঙ্গে আমার দেখা করতে-ই হবে। উনি তখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েতখন অবশ্য এতোকিছু মানে ফেইসবুক ছিলো না, আমি এতোকিছু বুঝতামও নাসিনেমার শো করাতেন। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও নিশ্চয় তিনি এসেছিলেন। ফলে পোস্টার দেখে দেখে আমি ওই ইউনিভার্সিটিগুলোতে যেতাম। আমি এ রকম একটা পোস্টার দেখে একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি; সেখানে গিয়ে খোঁজ করছি যে ভাই, আজকে তো তারেক মাসুদের এখানে আসার কথা। তখন তারা বললো, ভাই এটা তো তিন মাস আগের ডেইট। আমি আসলে তারেক মাসুদের পোস্টার দেখে এতো এক্সাইটেড ছিলাম যে, ৩ তারিখ শুক্রবার দেখেছি, কিন্তু ঠিক মতো মাস আর দেখিনি। অনুষ্ঠান হয়েছে জুন মাসে আর আমি গেছি আগস্টে! তখন আমি তাদেরকে বললাম, ভাই উনি কি আবার কোনো দিন আসবেন? এভাবে এক বছর লেগেছে তারেক মাসুদকে আমার খুঁজে পেতে।

এর পর একবার গাজীপুরে ডুয়েট [ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি] নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে না, সেখানে উনি একবার এসেছিলেন মাটির ময়না সিনেমাটা দেখানোর জন্য। তারেক মাসুদ স্যার খুব ভালো একটা জিনিস করতেন, যেটা আমরা এখন পারি না। উনি কিন্তু সিনেমা দেখানোর পর সবার প্রতিক্রিয়া নিতেন; কার ভালো লাগলো, কার লাগলো না। এবং দর্শকের প্রশ্নের উত্তর করতেন। এখন তো একটু রিভিউ, একটু সমালোচনা করলেই আমরা মন খারাপ করি। ওনার মধ্যে এই গুণটা ছিলো, উনি ওনার কাজের রিভিউ নিতেন। আমি এ রকম একটা শোয়ে মাটির ময়না দেখে, একটা প্রশ্ন করেছিলাম ওনাকে। আমি হাত তুলেছিলাম। উনি দেখে বললেন, বলেন। আমি বললাম, সিনেমার মধ্যে একটা জায়গায় আমার একটু ঝামেলা মনে হচ্ছে। তখন উনি বললেন, সামনে আসেন। আমি বললাম, ওখানে একটা মুক্তিযুদ্ধের শট্ আছে, সেখানে মিছিল দেখানো হচ্ছে, কিন্তু পেছনের দেয়ালে রঙিন পোস্টার লাগানো। আমি যতোটুকু জানি ওই সময় রঙিন পোস্টার আসে নাই। সাদাকালো ছিলো। আমরাও এখন সিনেমা বানাই, এতো খেয়াল রাখতে পারি না। অতো দূরে কে দেখে? উনি বললেন যে, আপনারা এখানে ইউনিভার্সিটির টিচার আছেন, স্টুডেন্ট আছেন, সিনেমা বিশেষজ্ঞ আছেনতুমি কোথায় পড়ো বাবা? উত্তরে বললাম, আমি মাদ্রাসায় পড়ি। একজন মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে কতো ডিটেইলে সিনেমা দেখেছে যে, অনেক দূরের দেয়ালেএখনো মাটির ময়নাতে সিনটা আছেএকটা রঙিন পোস্টার দেখেছে। হয়তো কারো চোখেই পড়েনি। এরপর থেকে উনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমি মাঝেমধ্যে ওনার শুটিংয়ে যেতাম। উনি আমার সাথে কথা বলতেন। আমি চাইতাম, ওনাকে আমি অ্যাসিস্ট করবো। কিন্তু বয়সে যেহেতু আমি অনেক ছোটো; উনি বলতেন, পড়ালেখা শেষ করে তারপর যেনো ওনার কাছে আসি। ওনাকে আমি অ্যাসিস্ট করতে পারি নাই। তবে ওনার অনেক সিনেমার শুটিংয়ে গিয়েছি। রানওয়ে-তে গিয়েছি, সব জায়গায় গিয়েছি। উনি আমার আইডল ছিলেন। এবং একটা পর্যায়ে উনি তো মারা গেলেন!

কথা উপস্থাপনায় নির্মাতা রায়হান রাফী,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

মাদ্রাসায় আমার পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর আমি ডিফারেন্ট লাইনে পড়ালেখা শুরু করলাম। আমার মাথায় পোকাটা ছিলো, আমি সিনেমা বানাবো। এবার আমার লাইফে একটা চেঞ্জ আসলো। আমি তো আসলে আর্টফিল্ম বানাতে পছন্দ করি। কারণ আমি তারেক মাসুদের ফ্যান! আমি এই ধরনের গল্প বলতে পছন্দ করি। কিন্তু আমি মানুষকে আগে অবজার্ভ করি, কী হচ্ছে। কে কীভাবে ডিরেক্টর হচ্ছে বা কেমনে কী? অবজার্ভ করার চেষ্টা করি সবাইকে। পৃথিবীর বিভিন্ন ডিরেক্টরকে। আমি দেখলাম, বাংলাদেশের সিনেমার অবস্থা খুব খারাপ। এখানে সিনেমাহলে মানুষ সিনেমা দেখতে যায় না। যারা কিনা ডিফারেন্ট সিনেমা বানায়, তারা অনেক কষ্ট করে সিনেমা বানায়। এর কাছে টাকা ধার নেয়, ওর কাছে টাকা ধার নিয়ে অনেক কষ্টে সিনেমা বানায়। সেই সিনেমা কেউ দেখে না। জোর করে সিনেমা দেখাতে হয়। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে রিকোয়েস্ট করতে হয়, প্লিজ সিনেমা দেখেন! তারেক মাসুদ ছিলেন সিনেমার ফেরিওয়ালা। ফলে আমার কাছে মনে হয়েছে, সবাই তো ফেরিওয়ালা হতে পারবে না। সবার তো সেই গুণ নাও থাকতে পারে। তাই আমি এই লাইনে যাবো না। আমি যেটা করতে চেয়েছি, আমি আগে নিজের নাম তৈরি করবো। ব্র্যান্ড বানাবো রায়হান রাফীকে। এরপর আমি আমার গল্পগুলো বলবো। যে গল্পগুলো মানুষ দেখবে। আমি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে আসার আগ পর্যন্ত সিনেমা কিন্তু মাঝেমধ্যে হিট হতো। অনেক দিন পর একটা মনপুরা আসলো। সুপার ডুপার হিট। তার পর সাত বছর গ্যাপ। অনেক দিন পর আসলো আয়নাবাজি। অনেক দিন পর পর এমন সিনেমা আসতো। রেগুলার কেউ সিনেমা বানাবে এবং সেই সিনেমা দেখার জন্য মানুষ টিকিট পাবে না, সুপার ডুপার হিট হবেএটা তখন ছিলো না।

আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি কমার্শিয়াল সিনেমা বানাবো। সেগুলোর মধ্যে আমি একটু একটু আর্ট দিবো। সিনেমা তো আর্ট ছাড়া হয় না। আমার থট দিবো। কিন্তু দিনশেষে আমি যে সিনেমাটা বানাতে চাই, সেটা যদি প্রথমেই বানাই, তাহলে আমি আর সিনেমা বানাতে পারবো না। তাহলে কেউ দেখবেই না সিনেমা। কারণ দিনশেষে দর্শক একটু এন্টারটেইনমেন্ট পছন্দ করে। তখন আমি চিন্তা করলাম, আমি প্রথমে কমার্শিয়াল সিনেমা দিয়ে নিজের নাম তৈরি করবো। আমি পোড়ামন ২ বানালাম। পোড়ামন ২-এর আইডিয়াটা আর্ট ফর্মের ছিলোসুইসাইড করলে জানাজা হয় না। জানি না, আপনারা দেখছেন কিনা। আমি এরপর দহন, পরাণ বানালাম। এই গল্পটা যদি আমি গান ছাড়া বানাতাম, এটা একটা ডিফারেন্ট টাইপের সিনেমা হতো। কিন্তু আমি কী করলাম, একটু মসলা, একটু সুন্দর গান, একটু একটু করে সব দিলাম। যেমনটা আপনারা তুফান-এ দেখেছেন। তুফান কিন্তু আমি খুব চালাকি করে বানিয়েছি। এই গল্পে আমরা কী দেখিয়েছি, তুফান একজন বড়ো সন্ত্রাসী। সে কীভাবে দেশ দখল করেছে? সে একটা দলকে খুন করে আরেকটা দলকে ক্ষমতায় বসাচ্ছে; ভোট ডাকাতি করে। আগের গভর্নমেন্ট কিন্তু একই কাজ করেছে। কিন্তু আমি এমনভাবে গানে গানে দেখিয়েছি, শাকিব খানের ভাবচক্করে দেখিয়েছি, ওরা বিষয়টা বুঝতেই পারেনি। আপনারা যদি খেয়াল করে দেখেন, তুফান-এর গল্প কিন্তু ডার্ক পলিটিক্স। কীভাবে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা একটা দল থেকে আরেকটা দলের হাতে চলে যায়। খেয়াল করে দেখবেন সেখানে পলিটিক্স আছে, ডায়ালগ আছে‘ওই তুই কে রে, আমাদেরকে পলিটিক্স শিখাচ্ছিস?’ তো ওই পলিটিকাল গল্পটাকে, ডার্ক পলিটিক্সটাকে এমনভাবে দেখিয়েছি, সেন্সর বোর্ড বুঝতেই পারে নাইআমি আসলে ডার্ক পলিটিক্সের গল্প বলছি! ভোট ডাকাতির গল্প বলছি। আমি এভাবেই গল্প বলার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে পার পাই। মাঝে মাঝে আটকে যাই। যেমন অমীমাংসিত পার পায়নি। বাট আমি খুব এনজয় করি। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি। আমি যেটা চেয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, আল্লাহতায়ালা সেটা পূরণ করার তৌফিক দিয়েছেন।

আমি এই গল্পটা সংক্ষেপে হলেও আপনাদের কেনো বললাম? কারণ মানুষ যদি চায় তাহলে সে সবকিছুই অ্যাচিভ করতে পারে। আমি জানি আপনাদের এখান থেকে অনেক ভালো ভালো ডিরেক্টর উঠে আসবে। তাওকীরকে [তাওকীর ইসলাম সাইক] আমি খুব পছন্দ করি। শর্টফিল্ম বানায়, ওটিটির জন্য বানায়। ওর সঙ্গে বিভিন্ন ফেস্টিভালে আমার দেখা হয়েছে অনেক আগেই। আপনাদের রাজশাহীর স্টুডেন্টদের আমরা অনেক পছন্দ করি। কারণ রাজশাহীর স্টুডেন্টরা অনেক মেধাবী। ওরা ডিফারেন্টভাবে সিনেমাটাকে দেখে। ইভেন তুফান-এর রাইটার আদনান আদিব খান, সেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি জানি এখান থেকে অনেক ভালো ভালো রাইটার উঠে আসবে। একসময় ডিরেক্টর হবে। আপনারা যদি সবাই সচিব হয়ে যান, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যান, তাহলে সিনেমা বানাবে কে? এজন্য আমাদেরকে সিনেমা বানাতে হবে, এই লাইনে আসতে হবে। এই লাইনে যখন ভালো ভালো রাইটার আসবে, ভালো ভালো লোকজন আসবে, ভালো ভালো চিন্তা আসবে, তখনই এই ইন্ডাস্ট্রি চেঞ্জ হবে। একজন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, একজন সুমন [মেজবাউর রহমান সুমন], একজন অমিতাভ রেজা চৌধুরী, একজন রাফীকে দিয়ে আসলে চেঞ্জ হবে না। ভবিষ্যতে আপনাদের লাগবে। সে কারণেই গল্পটা আপনাদের বললাম, যদি কেউ আসতে চান, এটা তো জোর করে হয় না। কারো মনে যদি থাকে আমি সিনেমা বানাবোএখন এটা তো অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফোন দিয়েও সিনেমা বানানো যায়।

আমার এখনো মনে আছে। প্রথম যখন শর্টফিল্ম বানাতে চাইলাম, ক্যামেরা ছিলো না। তাই বিয়ের ক্যামেরা ভাড়া করেছিলাম। সেই ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করেছিলাম, যেটা টেপ দিয়ে রেকর্ড হতো। অনেক কষ্ট করে শর্টফিল্ম বানাতে হয়েছে তখন। টাকা দিতো না কেউ। ফেইসবুক ছিলো না, ইউটিউব ছিলো না, কোথায় দেখাবো? এখন তো অনেক অপশন। আপনি যদি একটু ভালো কাজ করেন; সেই ভালো কাজ আপনাকে আপনার জায়গায় নিয়ে যাবে। আমি এই গল্পটা আপনাদের সামনে এই জন্য করলাম, যাতে আপনাদের মধ্যে আগ্রহ জন্মে, কেউ চায় সিনেমা বানাতে, অভিনয় করতে, গল্প লিখতে। কারণ আপনারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, আপনারাই ভবিষ্যতে সিনেমা বানাবেন। আপনাদের সিনেমা সবাই দেখবে।

গতকাল ঢাকায় একটা টিমের সঙ্গে গল্প করছিলাম। সেই গল্পটা আপনাদের শেয়ার করি। ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’ তখন নতুন হয়েছে। আমি সাভারে একটা মাদ্রাসায় পড়ি। সাভার থেকে সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। যদিও আমার কাছে ওভাবে টাকাপয়সা থাকতো না। টিকিট ছিলো ২৫০ টাকা। আমি হয়তো ৩০০ টাকা নিয়ে যেতাম। ৫০ টাকা ভাড়া। বসুন্ধরা সিটির নিচে কিছু দোকান আছে, কম টাকায় বার্গার, চিকেন, নুডুলস এসব পাওয়া যায়, ১০-২০ টাকায় তখন পাওয়া যেতো, এখনকার কথা আমি জানি না। সিনেমার মাঝে যে ব্রেক ছিলো, সেই ব্রেকে আমি নিচে যেতাম, ও সব খেয়ে আবার সিনেমা দেখতাম। কারণ পেটে ক্ষুধা নিয়ে তো সিনেমা দেখতে ভালো লাগবে না। এবং যে সিনেমাই আসতো, সেই সিনেমাই আমি হলে গিয়ে দেখতাম। আর ওইদিন সিনেপ্লেক্স রিপোর্ট দিয়েছে, সিনেপ্লেক্স হওয়ার থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দিন আমার ছবি চলেছে। মানে সিনেপ্লেক্সে বাংলাদেশি ডিরেক্টরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন আমার সিনেমা চলেছে। তুফান তো দুই মাস ধরে চলেছে। এর আগে পরাণ ছিলো ৩০০ দিন; সুড়ঙ্গ ২০০ দিন; পোড়ামন ২, দামাল-ও চলেছে। মানে সিনেপ্লেক্সের ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো ডিরেক্টরের সিনেমা এতোদিন চলেনি। অথচ একসময় এমন ছিলো আমি সিনেপ্লেক্সে যেতে পারলে আমার আশা পূরণ হয়ে যেতো। এখন যখন দেখি সিনেপ্লেক্সে আমার সিনেমার টিকিট থাকে না, তখন আমার খুব প্রাউড ফিল হয়। ফলে আমি জানি, আপনারাও সামনের দিনে ভালো করবেন।

‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১২’-এর সঞ্চালনায় রোকসানা আরশি ও জেরিন জান্নাত,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

আমরা এবার ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’কে ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা এতো সুন্দর আয়োজনটা করেছে এবং আয়োজনের উদ্দেশ্যটা খুবই ভালো, তারা জানতে চায়, সিনেমার ভবিষ্যৎ কেমন হবে? আমার মনে হয় সিনেমার ভবিষ্যৎ আপনারাই। আপনাদের মতো নতুন নতুন রাইটার, ডিরেক্টররা যখন সিনেমা বানাবে, তখন সিনেমার ভবিষ্যৎ চেঞ্জ হবে। আমরা তো আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টা করছি। আপনারা যদি সিনেমা দেখেন এবং সিনেমা নিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন, সিনেমার সঙ্গে থাকেন, তাহলে আমাদের দেশের সিনেমা চেঞ্জ হবে। না হলে আসলে চেঞ্জ হবে না। দেখেন, আমরা এতোদিন কী করতাম? আমরা পলিটিক্স করতে চাইনি। আমাদের ধারণা ছিলো, পলিটিক্স মানেই খারাপ। ফলে পলিটিক্সে যাওয়া যাবে না। এ কারণেই কিন্তু ডার্টি পলিটিক্স আমাদের এখানে ঢুকে গেছে। কিন্তু যখন সব স্টুডেন্ট নেমে গেলো, তখন নতুন পলিটিক্সের যাত্রা শুরু হলো। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু সেইম। আপনারা ভাবছেন, ভালো সিনেমা হচ্ছে না, কেনো সিনেমাহল নাই, কেনো ভালো সিনেমা দেখতে পাচ্ছি না। কারণ কেউ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যাচ্ছে না। আপনার চয়েজ হলো, আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবো, বি সি এস ক্যাডার হবো। কিন্তু কেনো কেউ ভাবছে না, এই প্রফেশনটা অনেক ভালো, এই প্রফেশনে অনেক সম্মান পাওয়া যায়। এটার যে কী শান্তি, কী আরাম! 

দেখেন, আমার একটা শান্তির জায়গা কী, যে কাজটা আমি ভালোবাসি, সেই কাজটার জন্য মানুষ আমাকে টাকা দেয়। সেই কাজের জন্য মানুষ আমার কাছে আসে। মানে আমি স্বপ্ন দেখি, আমি একটা সিনেমা বানাবোতুফান ২। এবার এটাকে পূরণ করার জন্য একটা টিম আছে, যারা আমার স্বপ্ন পূরণ করবে। আসলে অনেক সময় ডিরেক্টরকে গডের সঙ্গে মেলানো হয়। কারণ ডিরেক্টররা স্বপ্ন দেখছে এখন বৃষ্টি হবে, তখন বৃষ্টি হয়ে যায়। আমি ওদের মধ্যে প্রেম দেখছি; এখন বিচ্ছেদ হবে, বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এটা এমন একটা পাওয়ারফুল জিনিস, আমি যা ভাবছি তা হয়ে যাচ্ছে। এবং সেটা হওয়ার জন্য কেউ আমাকে টাকাও দিচ্ছে, আপনি ভাবেন একবার! এর থেকে শান্তির জব আর কী হতে পারে। রাইটার হোক বা যে যেটা পছন্দ করে, তাকে যদি সেটা করতে টাকা দেওয়া হয়ভাই তুমি এটা করো। আমি বিশ্বাস করি, যে ব্যাংকার, সে ব্যাংকিং করতে এনজয় করে না। জব এটা তার, যায় আসে, কাজ করতে হবে বলে করে। কিন্তু রাইটার হোক বা যে শিল্পী কিংবা খেলোয়াড়, তাদের সেটা করতে ভালো লাগে। আবার টাকাও দেওয়া হয়। তাই আমি বলবো, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি চিন্তা করেন, আপনারা আসতে পারেন। আপনারা আসলেই, এই যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি, ভবিষ্যতটা চেঞ্জ হবে। আপনারা না এলে ভবিষ্যতটা চেঞ্জ হবে না।

আমি খুব অগোছালো বক্তব্য দিচ্ছি। জানি না কেমন লাগছে। আপনারা তো ভালো ভালো বক্তব্য শোনেন। আমার এ রকম আড্ডা দিতে ভালো লাগে। আমার মনে হয় খুব প্ল্যান করে, খুবই সাহিত্যিক যে আড্ডা হয়, সেগুলো ভালো। কিন্তু জীবন থেকে যে গল্পটা বলা হয়, আমার জীবনের যে গল্পটা বললাম, হয়তো আপনাদের কারও জীবনের অনুপ্রেরণা হবে। আমি যখন ডিরেক্টরদের জীবনের গল্প পড়তাম, আমি ওই গল্পটা জানতে চাইতাম, যেটা আমার জীবনের কাজে লাগবে। এখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা বেশ ভালো। আমরা চেষ্টা করছি ভালো ভালো সিনেমা বানানোর। পরিস্থিতি একটু করে চেঞ্জ হচ্ছে, হাওয়া হচ্ছে, পরাণ হচ্ছে, আয়নাবাজির মতো সিনেমা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি একটু ডিফারেন্ট সিনেমা বানাতে। অনেক সিনেপ্লেক্স হচ্ছে। সিনেমার ব্যবসার যে অবস্থা, একটা সময় ধারণা ছিলো ভালো সিনেমা ব্যবসা করে না। এখন সেই ধারণাও ভেঙে গেছে। ভালো সিনেমা ব্যবসা করছে। ইন্টারন্যাশনালি আমাদের সিনেমা ভালো জায়গায় যাচ্ছে। ওটিটি প্লাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। কাজেই আমার মনে হয়, আমাদের সিনেমার ভবিষ্যৎ সামনে আরো ভালো হবে।

এই যে নতুন করে আমরা একটা আন্দোলন করলাম, সার্টিফিকেশন বোর্ড করতে হবে। এতে করে একটা জিনিস ভালো হলো, যা ইচ্ছা আমরা বানাতে পারবো, মন দিয়ে বানাতে পারবো। আশা করছি সামনের দিনে আরো ডিফারেন্ট সব সিনেমা হবে, ভালো সিনেমা হবে। বক্তব্য আর দীর্ঘায়িত না করে বরং আপনাদের প্রশ্ন শুনি। প্রশ্নগুলো শুনলে আমার কথা বলতে সুবিধা হবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ। অনেক অনেক ভালো লাগলো আপনাদের দেখে। জানি না আপনারা আমার সিনেমা দেখেন কিনা। দেখলে এমন প্রশ্নও করতে পারেন, কী আপনাদের ভালো লাগে, কী আপনাদের ভালো লাগে না। সবাইকে ধন্যবাদ [হাততালি]।

জেরিন : ধন্যবাদ, রায়হান রাফীকে। দীর্ঘ এক প্রাণবন্ত আলোচনা শুনলাম আমরা। দর্শক, নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে আপনাদের কাছে আমাদের সদস্যরা কাগজ পৌঁছে দিয়েছে। নির্মাতার আলোচনার সময় আপনাদের যেসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে সেগুলো নিশ্চয় কাগজে লিখেছেন। ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সদস্যদের আহ্বান করছি কাগজগুলো সংগ্রহ করে আলোচকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

রাফী : আমার মনে হয় কাগজে লেখার থেকে আপনারা যদি কেউ সরাসরি প্রশ্ন করতে চান করতে পারেন। এতে সুবিধা যেটা হয়, মনের ভাবটা প্রকাশ করা যায়। যেহেতু সামনাসামনি আছি আমরা। আর হলরুমও ছোটো। আমার মনে হয় মুখে বললেও শোনা যাবে। মুখে মুখে বললে সুবিধা হয় আরকি।

সজিবুর রহমান, শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : আমরা জানি সিনেমা দর্পণের মতো। সমাজে যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো প্রতিফলিত হয়। বর্তমানে যেসব সিনেমা আমরা দেখি, সেগুলোতে খুব একটা শিক্ষণীয় বিষয় থাকে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনার সিনেমাগুলোতে সমাজের অনেক ঘটনার প্রতিফলন বা একটু কিছু হলেও শিক্ষণীয় বিষয় দেখেছি। ২৪-এর যে বিপ্লব এবং ১৯৭১ পরবর্তী যতোগুলো আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, মানুষ যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে এসব আন্দোলন করেছে, আন্দোলন পরবর্তী মানুষ সেসব আকাঙ্ক্ষা পূরণের স্বাদ পায়নি। যে কারণে বার বার মানুষকে রাজপথে আসতে হয়েছে, বার বার প্রাণ দিতে হয়েছে। আমরা চাই, ২৪-এর আন্দোলন যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে হয়েছে, তা যেনো ব্যর্থ না হয়। তাই রাফী ভাইয়ের কাছে অনুরোধ এটা নিয়ে একটা সিনেমা করবেন।

আর একটা বিষয়, কোনো রাষ্ট্রকে উন্নত করতে হলে শুধু যে সরকারকে দায়িত্বশীল, সচেতন থাকতে হবে তা নয়; আমি মনে করি সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, সর্বস্তরের মানুষকে। আর সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভাবনাগুলো পৌঁছে দিতে সিনেমা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রাফী ভাইকে বলবো, গণমানুষ রাষ্ট্রকে কীভাবে দেখতে চায়, সেই ভাবনা নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। ধন্যবাদ।

রাফী : খুব সুন্দর চাওয়া। এমনটাই হওয়া উচিত। সিনেমা আসলে এমন একটা জিনিস, এর মাধ্যমে সমাজকে চেঞ্জ করা যায়। যখন একটা মানুষ তিন ঘণ্টা হলে বসে সিনেমা দেখছে, ওই সময় সে কিন্তু নেশা করছে না, কোনো অন্যায় করছে না। সিনেমার ভাষায় যখন সব থাকবে, যখন সেন্সর আইন অনেক সহজ থাকবে, যখন আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনেমা বানাতে পারবো। তখন কিন্তু অন্যায়কারীরা ভয় পাবে। আপনি ইন্ডিয়ার দিকে তাকান, ওরা কিন্তু সব ধরনের সিনেমা বানায়। ওরা পুলিশকে খারাপ দেখায়, প্রধানমন্ত্রীকে খারাপ দেখায়, কেউ সেই সিনেমা আটকাতে পারে না। সবাই ভয় পায়। ওদের ওখানে চাইলেই আটকানো যায় না। আমরাও যখন ওভাবে সিনেমা বানাবো, আমাদেরও অনেক ভালো হবে। যে কথাটি উনি বললেন, অলরেডি আমি প্ল্যান করছি, আমার ম্যাক্সিমাম অডিয়েন্সদের দাবি, আমি যাতে এই সাবজেক্ট নিয়ে সিনেমা বানাই। সত্যি কথা বলতে, এই আন্দোলনে এতো এতো গল্প, অনেক সিনেমা বানানো যাবে। আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করবো খুব তাড়াতাড়ি একটা সিনেমা বানাতে। সেটা মুগ্ধকে নিয়ে হোক, পুরো ঘটনা নিয়ে হোক বা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া নিয়ে হোক। আমি সিনেমা বানাবোই। টুইস্ট নিয়ে সিনেমা বানাতে আমার ভালোই লাগে। আর এতো এতো টুইস্ট, এতো এতো গল্প, আমি কেনো বানাবো না, আমি অবশ্যই সিনেমা বানাবো।

আসরাফ আলী, পিএইচডি গবেষক : বক্তৃতায় আপনি বললেন, ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করা যায় না। আমার প্রশ্ন হলো, মানুষের মৌলিক চাহিদার যে ক্ষুধা চলচ্চিত্র কি তা মেটাতে পারে? নাকি কেবল বিনোদন মাধ্যম হিসেবেই কাজ করে?

রাফী : আমি আগেই ক্ষুধার কথা বলেছি, পেটে ক্ষুধা থাকলে সিনেমা দেখতে ভালো লাগে না। সিনেমা আসলে এমন একটা শিল্প, যে শিল্প মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো যায়। এই শিল্প মাধ্যমে সমাজব্যবস্থাকে তুলে আনা যায়। এই শিল্পের মাধ্যমে একটা গল্পকে একটা জায়গায় বন্দি করা যায়। যেমন এই যে একটা আন্দোলন হলো, একটা সময় হয়তো মানুষ সেটা ভুলে যাবে। ভবিষ্যতে সেটা আর জানবে না। সেটা নিয়ে কথা বলবে না। কিন্তু এই ঘটনা যখন সিনেমাতে থাকবে, সেটা সারা বিশ্ব দেখতে পারবে। খেয়াল করবেন, এই যে ফেইসবুক। ফেইসবুক কীভাবে এই আন্দোলনে সহায়তা করেছে? আমরা যখন ছবি দেখেছি আবু সাঈদের সেই ঘটনার। সেটা আমাদের ইমোশনাল করে দিয়েছে। আমরা যদি লেখা পড়তাম রংপুরে একজন মারা গেছে, কিংবা মুগ্ধ নামে একজন মারা গেছে; হয়তো এতোটা ইমোশনাল হতাম না। কিন্তু আমরা যখন মুগ্ধের চেহারাটা দেখেছি, মুগ্ধের সাউন্ডটা শুনেছি, ‘পানি লাগবে পানি’ এবং এর পরের দৃশ্যে যখন আমরা দেখেছি মুগ্ধ লাশ হয়ে গেছেআমরা কিন্তু কান্না করে দিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন মুগ্ধের সেই দৃশ্য দেখেছি, আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছি। এর অর্থ হলো খুব সহজে সবার ওপর ভিজ্যুয়ালের ইফেক্ট পড়ে। ভিজ্যুয়ালের ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। এবারের বিপ্লবে ভিজ্যুয়াল অনেক প্রভাব ফেলেছে। আমরা যদি ভিজ্যুয়ালি মানুষকে না জানাতে পারতামআপনারা আসেনমানুষ কিন্তু আসতো না।

সিনেমা তো ভিজ্যুয়াল-ই। এই ভিজ্যুয়াল অনেক কিছু করতে সক্ষম। এই যে আন্দোলনটা, এতে স্টুডেন্টদের সবচেয়ে বড়ো অবদান। সাধারণ মানুষ, চাকরিজীবী, রিকশাওয়ালা সবার অংশগ্রহণ কিন্তু ভিজ্যুয়াল মারফত। ভিজ্যুয়ালি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছে, মানুষকে ধাক্কা দিয়েছে। ওই যে সাউন্ড, ‘পানি লাগবে পানি’, ওই যে দৃশ্য আমরা দেখেছি মুগ্ধের কিংবা আবু সাঈদের, এই দৃশ্য দেখার পর মানুষ অনেক সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এই দৃশ্য যখন সিনেমার পর্দায় দেখানো হবে, এ রকম বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হবে, সেটা ভাবেন একবার!

অবশ্যই সিনেমা শুধু বিনোদন না। এর মধ্য দিয়ে নানা বিষয় উঠে আসে। আমাদের যে মৌলিক চাহিদা, আমাদের যে পলিটিক্স, সমাজব্যবস্থা, ন্যায়-অন্যায়, কোনটা ভালো, কোনটা খারাপএর সঙ্গে নানা ধরনের বিষয় জড়িত। আমাদের সিনেমাতে হিরো-ভিলেন থাকে, কেনো থাকে? আমরা দেখাই খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ। খারাপ করলে খারাপ হবে, ভালো করলে ভালো। একটা দেশের সিনেমা যতো উন্নত ওই দেশের কালচার ততোটা উন্নত হবে। সিনেমা খুবই ইম্পরট্যান্ট কোনো দেশের কালচার, সমাজব্যবস্থা ও পলিটিক্সের জন্য। সিনেমা শক্তিশালী হলে তখন পলিটিশিয়ানরা ভয় পাবে এটা ভেবে যে, আমি উল্টাপাল্টা কিছু করলে আমাকে ধরবে। আমাদের দেশে দুর্নীতি নিয়ে কোনো সিনেমা নাই কেনো? কেনো ২১শে আগস্ট নিয়ে সিনেমা হলো না? কেনো হলি আর্টিজান নিয়ে সিনেমা হওয়ার পর সেই সিনেমা বন্ধ করে দেওয়া হলো? বিভিন্ন সরকার এসবকে বন্ধ করে দিয়েছে। এগুলো যখন ওপেন হয়ে যাবে, আমরা তখন সবকিছু নিয়ে সিনেমা বানাতে পারবো। আমাদের সিনেমার হিরো কখনো টিচার হতে পারে, পুলিশ হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, কিংবা কখনো উকিল হতে পারে। যখনই সাহসের সঙ্গে মানুষ সিনেমা বানাতে পারবে, দর্শক তখন সিনেমা দেখবে। সিনেমার সঙ্গে যখন জীবনের মিল পাবে তখন সেটা সমাজকে হেল্প করতে পারবে।

কাজী মামুন হায়দার, সম্পাদক, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ : নির্মাতার কাছে অনেক প্রশ্ন এসেছে। আমি একটু সাহায্য করছি ওনাকে। ড. আমিনুল ইসলাম প্রশ্ন করেছেন, ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র উপদেষ্টা। উনি প্রশ্ন করেছেনচিত্রনাট্য, গল্প ও উপন্যাসের কাঠামোগত সম্পর্ক এবং মৌলিক পার্থক্য কোথায়?

‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১২’তে উপস্থিত দর্শকের একাংশ, ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

রাফী : আমরা যখন চিত্রনাট্য করি মানে আমরা প্রথমে সিনেমাটা যখন বানাই; আমরা প্রথমে গল্প রেডি করি। গল্পে একটা আখ্যান থাকে। এই হচ্ছে, সেই হচ্ছে, এভাবে যাচ্ছে, সেভাবে যাচ্ছে। চিত্রনাট্য যখন হয় সেটার কিন্তু স্ক্রিপ্ট থাকে। ধরেন, আজকের প্রোগ্রামটা একটা সিনেমার গল্প। এটার গল্প হবে আমি আসলাম, বক্তব্য দিলাম। তারপর প্রশ্ন-উত্তর পর্ব হলো। এরপর আমি চলে গেলাম। কিন্তু এটাকে নিয়ে যখন চিত্রনাট্য লিখবো সেখানে আমার একটা জার্নির গল্প থাকতে হবে। আমি কোথায় থেকে আসলাম সেটার একটা কানেকশন লাগবে। এটা দিন, নাকি রাত। কোন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে জিনিসটাকে দেখতেছি, সিনেমাটাকে দেখাতে চাচ্ছি। এই দেখানোটা কী রায়হান রাফীর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে, নাকি অডিয়েন্সের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। এখানে আমি কতোটা শট্ ব্যবহার করতেছি। সময়টা কখন? অনেক ডিটেইল থাকে এতে। অনেক বেশি সিনেমাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ। এটা একটু আলাদা। আবার উপন্যাস থেকেও সিনেমা হয়। কোনো রাইটার যখন গল্প, উপন্যাস লেখে একেক অডিয়েন্স একেকভাবে সেটা পড়ে থাকে। সবাই নিজের মতো করে ভাবে, আচ্ছা ক্যারেক্টারটা তাহলে এটা করতেছে। লেখক একটা ধারণা দেয়, আর মানুষ নিজেদের মতো করে কল্পনা করে নেয়। কিন্তু সিনেমা জিনিসটা হচ্ছে আমি যেভাবে কল্পনা করছি সেটা সবাই দেখে। গল্পটাকে একটু স্পেসিফিক হতে হয় আসলে। আমার মনে হয় এটাই খুব বেসিক পার্থক্য চিত্রনাট্য ও উপন্যাসের মধ্যে। অনেক ভালো উপন্যাস, ভালো চিত্রনাট্য হয়ে ওঠে না কখনো কখনো। আবার অনেক গল্প আছে যেটা ভালো চিত্রনাট্য হয়ে ওঠে। কোথায় কী দেখাচ্ছি, শুরুটা কীভাবে হচ্ছে, ক্লাইম্যাক্সটায় কী দেখাবে, কোথায় আপ করবো আর কোথায় ডাউন করবো¾এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মামুন হায়দার : একই ধরনের প্রশ্ন তিনজন করেছেন। তরিকুল ইসলাম, আরবি বিভাগ; আল আমিন ইবনে রায়হান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ; এবং হাবিবা আক্তার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। আমি একজনের প্রশ্ন পড়ছি। প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনি মাদ্রাসায় পড়ে চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়েছেন। এক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না? আর হলে সেটা সমাধান করেছেন কীভাবে?

রাফী : অবশ্যই এটা কেউ ভালোভাবে নেয়নি। এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। এমনিতেই তো মানুষ ভালোভাবে নিতে চায় না। যখন কোনো ছেলে বলে আমি ফিল্মমেকার হবো, তখন কোনো বাবা-মা সেটা ভালোভাবে নিবে না। এটা বাবা-মার দোষ না। আমরা কালচারালি এমনটা ভাবি, এটা ভালো না, ওটা ভালো। ফেইসবুক চালানো ভালো, খেলাধুলায় কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু সিনেমা দেখা নিয়ে সমস্যা! এই রকম পরিস্থিতির জন্য আমার বাবা-মা চায় নাই আমি ফিল্মমেকার হই। কিন্তু স্বপ্ন তো আর চাপা দিয়ে রাখা যায় না। এটা আমার কাছে অনেক দামি স্বপ্ন! এবং আমার ভিশন পরিষ্কার ছিলো। আমার স্বপ্ন ছিলো আমি ভালো কাজ করতে চাই। আমি সিনেমার মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাই। আমি সিনেমার মাধ্যমে মানুষকে বিনোদিত করতে চাই। আমি সিনেমার মাধ্যমে সাগর-রুনির গল্পটা বললাম। আমি পরাণ-এ যে গল্পটা বলেছি, বরিশালের হত্যাকাণ্ডের যে গল্প, পরকীয়ার গল্প; সুড়ঙ্গতে ব্যাংক ডাকাতির গল্প বলেছি। জানোয়ার নামে একটা সিনেমা বানিয়েছিলাম আমি। এর গল্পটা ছিলো একটা বাসায় চারজন ঢুকে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। সিনেমাটা এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, সেটা রিলিজের পর ওই চারজন অ্যারেস্ট হয় এবং তাদের ফাঁসির রায় হয়।

সিনেমার নামটা জানোয়ার দিয়েছি কেনো? নামটা এ কারণে দিয়েছি যে, এরা মানুষ নয়, জানোয়ার। জানোয়ার-এর যে গল্প সাধারণ মানুষ দেখতে পারবে না সহজে। কষ্ট হবে অনেকের দেখতে। যারা দেখেছে তাদেরকে থেমে থেমে দেখতে হয়েছে। আমি খুবই জঘন্যভাবে সিনেমাটা বানিয়েছি। এটা মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব হবে না। তাহলে কেনো আমি এটা বানিয়েছি? কারণ মানুষ তো আর রেপিস্ট হয়ে জন্ম নেয় না। সে কোনো না কোনোভাবে রেপিস্ট হয়। আমার এই সিনেমা যদি কোনো রেপিস্ট দেখে—ভবিষ্যতে যে রেপিস্ট হতে পারতোসে জীবনে রেপ করতে পারবে না। তার মধ্যে অনুশোচনা তৈরি হবে এই ভেবে যে, এইটা এতো জঘন্যতম কাজ? এটা আমি করবো না। আমি আমার সিনেমার মধ্য দিয়ে সমাজের জন্য এই কাজটা করি। একটা মানুষও যদি আমার সিনেমা দেখে একটু চেঞ্জ হয়, তাহলেই সার্থকতা।

আমার সুড়ঙ্গ-এর গল্প নিয়ে অনেকেই বলেছে, সেখানে ছেলে পজেটিভ মেয়ে নেগেটিভ, কেনো? এই যুগে এসে ছেলেমেয়েকে আমরা আলাদা করতে পারবো না। সবাই এক। অনেক সিনেমাতেই ভিলেন থাকে পুরুষ। আর হাতেগোনা কয়েকটা সিনেমাতে নেগেটিভ ক্যারেক্টারে নারীকে পাওয়া যায়। আমাদের এটা পজিটিভলি নেওয়া উচিত। আমরা যদি এই সময়ে এসে চিন্তা করি নারীকে নেগেটিভ দেখানো যাবে না, সেটা ভালো কথা নয়। গল্প সবার জন্য; সেটা যেকোনো গল্প হতে পারে। অন্যায় যে কেউ করতে পারে। আমার কাছে সবাই সমান। তো আমি সুড়ঙ্গতে কী দেখিয়েছি? সেখানে দেখিয়েছি লোভের বিষয়টা। আমি আমার সিনেমার মধ্য দিয়ে সমাজের জন্য ভালো কাজটাই করার চেষ্টা করছি। যাইহোক, আমার স্বপ্নের শক্তিটা বেশি ছিলো। সবাই বাধা দিয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই আটকাতে পারে নাই। একটা পর্যায়ে এসে আমার বাবা-মা বিষয়টা মেনে নিয়েছে।

মামুন হায়দার : ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে গেছে হাতে। শিক্ষার্থীরা অনেক প্রশ্ন করেছেন। সেসব উত্তর দিতে হবে নির্মাতাকে। রুদ্র আল মুত্তাকিন, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। উনি বলছেন, ফ্যাসিস্ট রেজিমে সিনেমার মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধা দেখা গেছে। বর্তমানে সেন্সর আইনের নীতিমালায় নানা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তন নিশ্চয়ই আসবে। তারপরও যদি বলি, চিত্রনাট্য, নির্মাতা, বিষয়বস্তু নির্ধারণ, এসবে বাংলাদেশে কোনো কমতি আছে কি না? কাছাকাছি ধরনের প্রশ্ন করেছেন আরিফ হাসান, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। তিনি লিখেছেন, ৫ জুলাইয়ের পর সিনেমার ক্ষেত্রে সেন্সরের ঝামেলা কতোটুকু কমে যাবে বলে মনে করেন?

রাফী : আসলে আমাদের অনেক কমতি আছে। আমাদের দেশের অন্যতম সঙ্কট হচ্ছে রাইটার। এখানে রাইটার নাই। আপনারা খেয়াল করবেন, যারা ডিরেক্টর, এর মধ্যে অনেকেই এখানে এসেছেন। একটু আগেই আমি তাদের নাম শুনলাম। নূরুল আলম আতিক, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মেজবাউর রহমান সুমন। সবাই কিন্তু নিজেই গল্প লেখেন। আমার গল্পও কিন্তু আমিই লিখি। কিন্তু সংলাপটা অন্য কাউকে দিয়ে লেখাই। আমার ম্যাক্সিমাম সিনেমার গল্প আমার লেখা। কারণ আমি কারো গল্প বিশ্বাস করতে পারি না। আমি এমন কোনো স্ক্রিপ্ট পাই না, যেটা আমার কাছে ভালো লাগে। বাংলাদেশের সেই সব ডিরেক্টররাই সাকসেস যারা নিজেরা লিখতে পারে। যিনি ডিরেক্টর তাকে যে লিখতে পারতেই হবে, এ রকম কোনো কথাও নেই। একজন লিখে সফল, আরেকজন সিনেমা বানিয়ে সফল। হুমায়ূন আহমেদ গল্পও লিখেছেন, সিনেমাও বানিয়েছেন। আমার কাছে মনে হয় ওনার সিনেমার চাইতে ওনার বই বেশি শক্তিশালী। রাইটার হিসেবে তিনি অনেক বেশি সমাদৃত। বাংলাদেশে চিত্রনাট্যকারের খুব অভাব। আমরা ভালো রাইটার পাচ্ছি না।

আরেকটা প্রশ্ন ছিলো সেন্সরশিপ নিয়ে। সেন্সরশিপ নিয়ে যে আইনটা হয়েছে, সেন্সর সার্টিফিকেশন আইন, সেই আইনটা বানানো হয়েছিলো ওই ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে। সেই আইনে অনেক ফাঁকফোকর আছে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো সিনেমা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আমরা শুনতেছি এখন যারা আছে, তারা স্বাধীনতা দিবে। যতোক্ষণ না পর্যন্ত আমি এমন কিছু সিনেমা বানাবোসেটা আমি ছাড় পেয়ে দেখাবোতারপর বলবো দেখো সবকিছু ঠিকঠাক আছে। বিষয়টা যদি এ রকম হয়আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপিকে নিয়ে সিনেমা বানালে রিলিজ করা যাবে; আবার বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগকে নিয়ে সিনেমা বানালে তা রিলিজ করা যাবেএটা করলে বিপদ! তখন কী হবে যেই গভর্নমেন্টই আসবে সে বলবে আগের গভর্নমেন্টকে খারাপ দেখাও। এ রকম যদি হয়, যেকোনো বিষয় নিয়ে আমি সিনেমা বানাতে পারবোএটাকেই বলে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে তো এইটা না এখন আপনি আওয়ামী লীগকে বদনাম করে সিনেমা বানাবেন। স্বাধীন তখনই থাকবে যখন আমি সবকিছুর সমালোচনা করতে পারবো। আমরা এখন যেই গভর্নমেন্টটাকে নিয়ে আসলাম, দরকার হলে তাদেরও সমালোচনা করবো। সমালোচনা করার সময় কেউ যদি বাধা না দেয়, তাহলে বুঝবো আমরা স্বাধীন।

আর আইনের মধ্যে অনেক ঘাপলা আছে। এখনো যে আইনটা আছে, সেটা খুব তাড়াহুড়া করে করা। আমরা চাচ্ছি কতো তাড়াতাড়ি এই আইন চেঞ্জ করা যায়। আমার কয়েকটা সিনেমা আটকে আছে। ফারুকী ভাইয়ের [মোস্তফা সরয়ার ফারুকী] শনিবার বিকেল আটকে আছে। এ রকম অনেকগুলো সিনেমা আটকে আছে। আমরা চাইবো যেনো কোনো সিনেমাকে আর কোনো দিনএই আইন করা হোক, যে সিনেমা রাষ্ট্রের ক্ষতি করবে, যেই সিনেমা স্বাধীনতাকে ছোটো করবে, ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করবে এগুলো বাদেনিষিদ্ধ না হোক। কিন্তু রিয়েল স্টোরি নিয়ে সিনেমা করলে সেটা নিষিদ্ধ করা যাবে না। আমি ২১শে আগস্ট নিয়ে সিনেমা বানাবো, বি ডি আর বিদ্রোহ নিয়ে সিনেমা বানাবো, জুলাই বিপ্লব নিয়ে সিনেমা বানাবোএটা কেউ আটকাতে পারবে না। পুলিশকে নিয়ে, আর্মিকে নিয়ে, নৌবাহিনী ও র‌্যাবকে নিয়ে সিনেমা বানাবো, ক্রসফায়ার নিয়ে সিনেমা বানাবোহাজার হাজার মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, বাংলাদেশে ক্রসফায়ার নিয়ে একটা সিনেমাও নাই। আমি রিসেন্ট কাজ করছি ক্রসফায়ার নিয়ে।

ক্রসফায়ারে একটা জীবন্ত মানুষকে নিয়ে মেরে ফেলা হয়! এই সাবজেক্ট নিয়ে কেউ সিনেমা বানানোর সাহস পায় নাই। কারণ সেন্সর দিবে না। যখন সিনেমা বানাবো, তখন যদি সেন্সর দেয় তাহলে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো। হ্যাঁ, আমরা কাজ করতে পারছি। আশা করছি, স্বাধীনতা পাবো। যতোদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা না দেখবো, ততোদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারবো না। ৫ তারিখে যে এমন ঘটনা ঘটবে সেটা তো অনেকে বিশ্বাস করতে পারে নাই। ঘটার পরে না বিশ্বাস করেছে সবাই। আমি আসলে বিশ্বাস সেদিনই করবো, যখন একজন ডিরেক্টর যেকোনো বিষয় নিয়ে সিনেমা বানাবে। সিনেমা সেন্সরশিপে আটকাবে না। দর্শক সেই সিনেমাটা দেখবে। তখন বুঝতে পারবো আমরা স্বাধীন, আমরা সব গল্প নিয়ে সিনেমা করতে পারছি। ধন্যবাদ, এতো দারুণ একটা প্রশ্ন করার জন্য।

মামুন হায়দার : মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাফী প্রশ্ন করেছেন। একইসঙ্গে ইনফরমেশন সায়েন্স ও লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান আলীও কাছাকাছি ধরনের প্রশ্ন করেছেন। রাফীর প্রশ্ন, আপনি প্রথম সিনেমা শুরুর সাহসটা করেছিলেন কীভাবে? সেটআপটা ম্যানেজ করেছিলেন কীভাবে? আগে কী অ্যাড নিয়ে কাজ করেছিলেন? মানে একদম নতুন হিসেবে শুরু করেছেন, নাকি আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো? রায়হান আলী প্রশ্ন করছেন, তরুণ নির্মাতা এবং যারা এই পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে চায় তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

রাফী : বক্তৃতার সময় এই কথাটা সেভাবে আসেনি। প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টা আসলো। ভালোই হলো। আমি যখন চিন্তা করলাম সিনেমা বানাবো, তখন শুরুতে শর্টফিল্ম বানালাম। নানা ডিরেক্টরের কাছে গেলাম তাদেরকে অ্যাসিস্ট করার জন্য। বয়সটা কম ছিলো। ঢাকায় থাকতাম। সবকিছু মিলিয়ে আমি আসলে সেভাবে কারো সঙ্গে কাজ করতে পারছিলাম না। তখন তো ফেইসবুক ছিলো না। এখন তো চাইলেই মেসেজ পাঠানো যাচ্ছে; মেইল করা যাচ্ছে। সেসময় তো আর এটা সম্ভব ছিলো না। কাউকে রিচ করতে পারতাম না। কীভাবেইবা রিচ করবো! ফোন নম্বরও তো ছিলো না কারো।

তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পর আমি শর্টফিল্ম বানানো শুরু করি। সিনেমা বানানোর টাকাপয়সা জমানো শুরু করলাম। কোচিংয়ের টাকা চুরি করতাম আমি। আব্বা-আম্মাকে বলতাম কোচিং করবো। আমার একটু মেধা ভালো ছিলো। কোচিং ছাড়াই রেজাল্ট ভালো হতো। এটা নিয়ে মজার গল্প আছে। বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। এটা এই কারণেই বলতেছি, কারণ আপনারা সেটা করবেন না। আমার আব্বু যখন হোস্টেলে আসতো, তখন কাউকে আমি টিচার বানাতাম। বলতাম উনি আমার টিচার, ওনার কাছে আমি পড়ি। এ রকম বিভিন্নজনকে টিচার বানাতাম। বলতাম ওনার কাছে ইংলিশ পড়ি, ওনার কাছে অঙ্ক আর ওনার কাছে সায়েন্স পড়ি। বড়োভাইদের টিচার বানাতাম। এভাবে টাকাটা আমি জমাতাম সিনেমা বানানোর জন্য। এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। যেহেতু আমার বাবা এয়ারফোর্সে ছিলো, খুব কড়া। আর যারা পাইলট থাকে তারা একটু অহংকারী হয়, ইংলিশে কথা বলে। চুল ছোটো থাকে। আমার আব্বুর একটা বিশ্বাস ছিলো, চুল ছোটো মানে সে ভদ্র ছেলে। চুল বড়ো মানে ও ভালো নয়। আর্মিরা কিন্তু এভাবেই দেখে। আর্মি কাটিং দিতে হবে। চুল লম্বা ওরা পছন্দ করে না।

আমার আব্বু সিনেমা বানানোর জন্য কোনো টাকাপয়সা দিতো না। খুবই হিসাব করে টাকাপয়সা দিতো। কিন্তু সিনেমা বানাতে তো টাকা লাগবে। আমি ওই প্রাইভেটের টাকা, কোচিংয়ের টাকা জমিয়ে সিনেমা বানানোর চিন্তা করলাম। ক্যামেরা কোথায় পাবো? বিয়ে বাড়িতে ভিডিও করতো, ওই ধরনের ক্যামেরা ভাড়া নিলাম। একটা শর্টফিল্ম বানালাম আজব বাক্স। এটা অনলাইনে আছে। ওই সময় হিন্দি সিরিয়ালের খুব প্রভাব ছিলো। ‘পাখি’ নামে একটা সিরিয়াল হতো। ওইটাই আমার প্রথম শর্টফিল্ম। অনলাইন ঘাটলে ওটা এখনো পাবেন। ওখানে একটা মেয়ে মানে ওয়াইফ কাঁদতেছে। এর পরের দৃশ্যটাতেই ছিলো একটা বয়স্ক লোক মারা যাচ্ছে। দর্শকের মনে হবে মেয়েটা আসলে বয়স্ক লোককে দেখেই কাঁদছে। বয়স্ক লোকটা ওষুধ চাচ্ছে, ওষুধ চাইতে চাইতেই মারা যাচ্ছে। শ্বশুর ওষুধ চেয়ে মারা যাচ্ছে, আর ওদিকে হাসবেন্ড-ওয়াইফ টিভিতে সিরিয়াল দেখছে, ‘পাখি’ সিরিয়াল! মেয়েটা আসলে ‘পাখি’ সিরিয়াল দেখে কান্না করছে! হাসবেন্ড তার ওয়াইফের আঁচল ধরে বসে আছে এবং বলতেছে তুমি আর কান্না করো না। এমন একটা ছোট্ট আইডিয়া নিয়ে আমার জাদুর বাক্স।

বানানোর পর আমি চিন্তা করলাম, এটা কী করবো—আড়াই মিনিটের একটা শর্টফিল্মএটা কোথায় ছাড়বো, কীভাবে দেখাবো, কোন ফেস্টিভালে দিবো। তবে আমার আগ্রহের জায়গা ছিলো বাংলাদেশের মানুষকে দেখানো। আগে এখানকার মানুষ দেখবে, পরে ইন্টারন্যাশনালি দেখাবো। দেশের বাইরে যখন কোনো সিনেমা যায়, সেটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। তবে আমরা নিজেরাই যদি আমাদের সিনেমা না দেখি, বাইরের মানুষ তো সেই সিনেমা দেখে বুঝবে না। ওরা আমাদের ইমোশনকে কানেক্ট করতে পারবে না। ওদের দেশের মানুষের ইমোশন আর আমাদের দেশের মানুষের ইমোশন তো এক না।

ফলে আমি তখন কী করলাম? ফেইসবুকে ছেড়ে দিলাম শর্টফিল্মটা। এখন নতুন একটা জোয়ার তৈরি হয়েছে ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের। এটা ভালো-খারাপ মিলিয়েই! এটা খারাপ কোন দিক দিয়ে, যেটা আমার কাছে মনে হয়েছেইউটিউব থেকে ইনকাম করতে হবে! আমি যদি তখন চিন্তা করতাম ইউটিউবে আমার সিনেমাটা দিবো, সেখান থেকে ডলার ইনকাম করবো; তাহলে কিন্তু আজকে আমি রাফী হতে পারতাম না। আমি ফ্রি করে দিয়েছি আমার কনটেন্ট। ফেইসবুকে ওটা আপলোড করার পর ভাইরাল হয়েছিলো। ভাইরাল হওয়ার পর দেখলাম কিছু মানুষ আমাকে পছন্দ করে। আমার কাজটা দেখেছে। ওই সময়ে ৫০ মিলিয়ন না কতো ভিউ হয়েছিলো! এর পর অনেক বড়ো বড়ো ডিরেক্টর আমাকে বলেছিলো, তারা এটা দেখেছে। এর এক বছর পর আমি আরেকটা শর্টফিল্ম বানাই। তার এক বছর পর বানাই আরেকটা শর্টফিল্ম।

আমি যেটা করার চেষ্টা করতাম একেবারে শুরু থেকেই খুব প্রফেশনালি কাজটা করতাম। আমি কিন্তু আমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে কাজটি করাই নাই। হয়তো আমার সিনেমার বাজেট ৫,০০০ টাকা। কিন্তু আমি ১,০০০ টাকা দিয়ে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নিতাম। তারপর বলতাম তুমি অ্যাক্টর, তুমি নায়িকা, তুমি ওমুক। একটা বিজি এম (ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক) করতাম। যদি বলতাম তোমরা এগুলো এগুলো হয়ে যাও, তখন পুরো ব্যাপারটা ক্যাজুয়াল হয়ে যেতো। সিনেমা তো একটা প্রফেশনাল জিনিস। আমার একটা ফ্রেন্ড আমাকে অ্যাসিস্ট করতো, আমি ওকে বলতাম শুটিংয়ের সময় তুমি আমার বন্ধু না। আমি এই প্রসেসটার মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজে নিজেই বিজি এম করতাম। সাউন্ড ডিজাইন করতাম। আমার সেসব শর্টফিল্ম এক লাখ, দুই লাখ, পাঁচ লাখ মানুষ দেখতো। ওইটা একদিন আব্দুল আজিজ, যিনি জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার তার চোখে পড়ে। তখন জাজ মাল্টিমিডিয়া থেকে আমাকে ডাকে। আমার একটা ছবি ছিলো খেলনা নিয়ে। সেটা দেখেই আমাকে ডাকা হয়। এর পর তারা সিনেমা বানানোর প্রস্তাব দেয়। তখন আমি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যরে চিত্রনাট্য লিখি। জানি না আমার সাহসটা কোথায় থেকে আসলো। আমি সিনেমা বানালাম এবং সিনেমা হিট হয়ে গেলো! আমার এতো সাহস কোথায় থেকে আসে, সেটা আমি জানি না। এটা হয়তো আল্লাহ প্রদত্ত সাহস। ওই সাহসেই আমি সিনেমা বানাই। আমি কাউকে সেভাবে অ্যাসিস্ট করি নাই। সিনেমা নিয়ে পড়ালেখাও করি নাই। বাট এখন চিন্তা করি, যদি আমি সিনেমা নিয়ে পড়ালেখা করতে পারতাম, তাহলে আরো ভালো সিনেমা বানাতে পারতাম। আমার জন্য কাজ করা সহজ হতো। কারণ আমি সিনেমা বানিয়ে বানিয়ে শিখেছি। পড়ালেখা করার মতো জায়গা বাংলাদেশে ছিলো না তখন। কোনো ফিল্ম স্কুল ছিলো না। বাট এখন ফিল্ম স্কুল হচ্ছে। পড়ালেখা করে সিনেমা বানালে এবং কাউকে অ্যাসিস্ট করলে আরো বেটার কিছু করা যেতো। 

(চলবে)

 

রায়হান রাফী

kanonfilmsbd@gmail.com

raihanrafi008@gmail.com


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন