Magic Lanthon

               

রায়হান রাফী

প্রকাশিত ২৫ জুন ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

শেষ পর্ব.

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ

রায়হান রাফী


ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১২

স্থান : ১৫০, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলা ভবন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

২৬ অক্টোবর ২০২৪, বেলা : ১১টা

কাজী মামুন হায়দার : নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাসবীর সজীব প্রশ্ন করেছেন, আপনার চলচ্চিত্রে নারীর চরিত্রায়ন নেতিবাচক এবং সেটা প্রথাগত ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে ঘটছে। সেটা কেনো বা কীভাবে ঘটছে? এখানে আপনার ব্যক্তিগত দর্শনের প্রভাব কতোখানি?

রায়হান রাফী : আমি সিনেমা বানিয়েছি কয়টা¾পোড়ামন ২, দহন, দামাল, পরাণ, সুড়ঙ্গ, তুফান, জানোয়ার। এর মধ্যে সব থেকে হিট ছবি এখন পর্যন্ত তুফান। তার আগে ছিলো পরাণ। সব থেকে ব্যবসা কম করেছে দামাল সিনেমাটা। যেটার য়েন্ডিং ছিলো একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে। এবং সিনেমাটায় নারী প্রতিনিধিত্ব করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমি এতোগুলো সিনেমা বানালাম, কিন্তু সবাই কেবল পরাণটাই দেখলো! বিশেষ করে নারীরা দেখলো! এবং সবাই ধারণা করছে যে, রায়হান রাফীর সিনেমায় মেয়েরা নেগেটিভ! মেয়েরা নেগেটিভ হওয়ায় সবাই পাগল হয়ে সিনেমাটা দেখেছে! নারীরাও পাগল হয়ে দেখেছে!

কিন্তু এর আগে আমি যে পোড়ামন ২, দামাল বানালাম, যেখানে ভিলেন ছেলে; তুফান-এ ভিলেন ছেলে। এখন আমি যদি ২০টা ছবি বানাই¾আমাদের দেশের তো সব ভিলেন পুরুষ না! শেখ হাসিনা নারী নাকি পুরুষ? ধরেন, আমি শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটা সিনেমা বানালাম, আর আপনি বললেন, না, আপনি এটা করতে পারবেন না। একটা নারীকে খারাপ দেখাতে পারবেন না। কিন্তু ওনাকে নিয়ে সিনেমা করতে হলে তো ফ্যাসিস্টই দেখাতে হবে। আমি ওনাকে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবো, উনি স্টুডেন্টদের মারার হুকুম দিয়েছেন। এটা নারীর পক্ষে যাবে নাকি পুরুষের পক্ষে যাবে? এখন আপনারা বলছেন, না, এটা হবে না। রায়হান রাফী আবারও একজন নারীকে নিয়ে ...।

আমার মনে হয়, এই জিনিসটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। নারী-পুরুষের সমান অধিকার। হ্যাঁ, কেউ ইন্টেনশনালি খারাপ দেখিয়েছে, সেটা ভিন্ন কথা। আমি যে পরাণ বানিয়েছি, সেটা তো আকাশ থেকে পড়েনি। এই ঘটনাগুলো তো ঘটেছে। মিন্নি এখনো আছে। আমি বানিয়েছে যে, একটা মেয়ে, তার দুটো ছেলেকে ভালো লাগে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে আছে নাকি নাই? অবশ্যই আছে। অনেক ছেলেও আছে যারা একাধিক প্রেম করে। এটা নিয়ে কী হতে পারে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কোনো ইন্টেনশন ছিলো না নারীকে খারাপ দেখানোর।

আসলে অনেক নারীবাদী আছে, যারা এটাকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছে। আমি একটা বিষয় চিন্তা করি, নারীদের নিয়ে কথা বললে ব্যবসাটা ভালো পাওয়া যায় আরকি। কারণ নারীকে নিয়ে কথা বললে নারীবাদীদের অনেক আলোচনা সমালোচনা পাওয়া যায়। আমি আমার সিনেমায় কখনো নারীকে হিরো বানানোর চেষ্টা করেছি; কখনো নারীদের ভালো লাগা দেখিয়েছি; খাঁচার ভেতর অচিন পাখিতে সাংবাদিক চরিত্রে দেখিয়েছি; জানোয়ার-এ রেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমি আসলে গল্প বলার চেষ্টা করছি।

আপনারা খেয়াল করবেন, আমার সিনেমায় নারী চরিত্র অনেক পাওয়ারফুল! একটা সময় সিনেমা হতো নায়কনির্ভর; মানে কেবল হিরোর গল্প থাকতো। আমার সিনেমায় নারীদের গল্প থাকে। ফলে আমি বিশ্বাস করি, এই অভিযোগ কিছু মানুষের বানানো। বরং আমি বলবো, এটা আপনাদের দোষ। কারণ আপনারা কেনো শুধু পরাণ-ই এতো হিট করলেন? আপনারা দামাল দেখেন। আমি মায়া নামে একটা সিনেমা বানিয়েছি, যেটা মানুষ দেখেছে, কিন্তু অনেক মানুষ দেখে নাই। কেনো মেয়ের নেগেটিভ চরিত্র থাকলে আপনারা সবাই পাগল হয়ে দেখেন¾এটা আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন?

আমি বুয়েট-এর ফিল্ম ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখানেও এই প্রশ্নটা করেছিলাম, আপনারা কেনো পরাণ এতো দেখলেন, কেনো দামাল দেখলেন না? সেখানে একটা ছেলে খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছিলো। আমার আরেকটা সিনেমা ছিলো নিঃশ্বাস। সেটাও খুব একটা মানুষ দেখে নাই। এক্সপেরিমেন্টাল ওটিটি ফিল্ম ছিলো সেটা। যেখানে তাসনিয়া ফারিণ অভিনয় করেছে।

বুয়েটের ওই ছেলেটা বললো যে, একটা মেয়ে ছেলেকে বা ভিলেনকে মারছে, সেটা দেখে মানুষ তালি দিতে পারে না। কিন্তু একটা ছেলে মারলে তালি দেয়। এটা আমাদের মানসিক সমস্যা। এই যে নারী খারাপ, নারী ভালো, এটা আমাদের মনের সমস্যা। আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি, একজন নারী হিরো হতে পারে, ভিলেনও হতে পারে, তাহলে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু একটা মেয়ে যদি হিরো হয়, আমরা ভাবি এটা সমস্যা, মেয়ে কেনো মানুষকে মারবে?

জুলাই আন্দোলনে দেখবেন অনেক ছেলে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু মেয়েরা যেখানে ভাইরাল হয়েছে, সেখানে অনেক বাজে কমেন্ট দেখেছি। ‘ওড়না ঠিক করো আপু’; ‘তোমার বাসায় কি মা বোন নাই’¾এই টাইপের আরকি। অথচ এই আন্দোলন যখন ছেলেরা করছে, তখন বলছি, সাবাস! ও হিরো! তার মানে আন্দোলনে কেনো নারীরা যাবে! আমি এটা দেখতে পারলে খুব ভালো লাগতো যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আরো কিছু মেয়ে থাকলে। আমরা কেনো জানি নারীদের হিরো বানাতে পারি না। এটা আমাদের মানসিক সমস্যা।

এই যুগে এসে আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনারা যখন এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন, তখন পরাণ যেমন ব্যবসা করবে, দামালও ব্যবসা করবে। তখন আমাকে আর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না যে, রায়হান রাফীর সিনেমায় নারীরা নেতিবাচক চরিত্র। কেননা তখন সবাই দামাল দেখবে। যদিও অনেকে দামাল দেখেই নাই আসলে। অনেকে খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, নিঃশ্বাস দেখে নাই। পরাণ সবাই দেখেছে। আমার অন্য ছবিগুলো যখন দেখবে, তখন নারীরা প্রাধান্য পাবে।

আমি যেটা সব জায়গায় বলি, আপনাদের কাছেও বলছি, সামনে নারীর হিরো চরিত্রে আমি সিনেমা বানাবো, যেখানে কোনো পুরুষ চরিত্র থাকবে না; শুধু নারী চরিত্রই থাকবে। আপনারা সেই সিনেমাটা হিট করে দেখান। যা দেখে ডিরেক্টররা নারীকেন্দ্রিক আরো বেশি সিনেমা বানাতে পারবে। কেনো নারীকে নিয়ে আমরা সিনেমা বানাতে পারি না? কেনো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো সুপার স্টার নায়িকা নাই? শাকিব খান আছে, নিশো ভাই আছে, মোশাররফ করিম আছে। তাই আবারও বলছি, এটা আমাদের মানসিক সমস্যা। হলিউড, বলিউডে কিন্তু নারী সুপার স্টার আছে। যাদের সিনেমা হিট হয়। কাজেই আমাদের মানসিকতার পরির্বতন আনতে পারলেই সিনেমা, রাইটার সবকিছু ঠিক হবে।

কথা উপস্থাপনায় নির্মাতা রায়হান রাফী,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

আরেকটি বিষয় হলো, নারীরা কেনো ডিরেক্টর হয় না; কিংবা নারী ডিরেক্টর কেনো কম? নারীকে ডিরেক্টর হতে হবে, রাইটার হতে হবে, সব জায়গায় যেতে হবে¾তখনই আমার মনে হয় নারীরা ভালো করবে। আমার মনে হয় নারীরা একটা জায়গায় ভালো করেছে¾পলিটিকসে বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুই নেত্রীই কিন্তু নারী। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা আরো নারী দেখতে চাই এবং নারীদের রাজত্ব দেখতে চাই। তাহলে আমাদের দেশে যেভাবে নারীদের ছোটো করা হয়, অসম্মান করা হয়; সিনেমায় তাদেরকে যেভাবে প্লাস্টিকের মতো রাখা হয়; নায়িকার যেমন কোনো গল্প থাকে না; নায়িকাদের গান ছাড়া আর কিছু থাকে না¾এই সবকিছুরই পরিবর্তন হবে। কিন্তু কীভাবে পরিবর্তন হবে? পরিবর্তন আপনারা করতে পারেন। আপনারা যখন ওই ধরনের সিনেমা দেখবেন, তখন আমাদের দেশে সেইসব সিনেমা আরো বেশি বেশি হবে।

মামুন হায়দার : একই ধরনের প্রশ্ন করেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিখর রায়। ফলে আমি আর প্রশ্নটা পড়ছি না। নাট্যকলা বিভাগের ফয়েজ দুটো প্রশ্ন করেছেন। প্রথম প্রশ্ন, ছবি ব্যবসাসফল করতে কোন গল্পটা চলবে, সেটা কীভাবে বোঝেন? এটার টেকনিক কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন করেছেন, নতুনদের জন্য প্লাটফর্ম তৈরির ক্ষেত্রে আপনার কোনো ভাবনা আছে কি না?

রাফী : আসলে পৃথিবীর কোনো রাইটার, ডিরেক্টর এভাবে গল্প লিখতে পারে না। কোনো কবি একটা হিট কবিতা লিখে দিলেন, হিট গান¾এটা আসলে হয় না। এভাবে সিনেমা হিট করা যায় না। আর একটা সিনেমা হিট হলেই সেটা ভালো ছবি, হিট না হলে খারাপ ছবি হয়ে যায় না। সিনেমার দুইটা অপশন¾ভালো ছবি আর খারাপ ছবি। কোনো ভালো ছবি হিট হতেও পারে, না-ও পারে। দেখা গেছে অনেক সিনেমা মুক্তির পর খুব বেশি মানুষ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে সেটা তার সময়কে অতিক্রম করে গেছে। আমি আসলে ওভাবে সিনেমা বানাই না। সামহাউ আমি যা কল্পনা করি, সেটা মানুষের ভালো লেগে যায়। আমি খুব লাকি! আমি হয়তো দর্শকের পাল্স বুঝতে পারি। আমি যেটা চিন্তা করি, সেটা সম্ভবত মানুষের চিন্তা হয়ে ওঠে।

দেখেন প্রত্যেক ডিরেক্টর তার সেরা ছবিটা বানায়। সবাই সেরা গল্পটাই বানানোর চেষ্টা করে। এবং সে ভাবে সবাই পাগল হয়ে সিনেমাটা দেখবে। কিন্তু মানুষ আসলে দেখে না। কারণ তার টেস্টের সঙ্গে অন্য মানুষের টেস্ট মেলে না। তার ভাবনার সঙ্গে মানুষের ভাবনা মেলে না। এই জায়গায় আমি খুব লাকি। আমি হয়তো মানুষের মতো করে ভাবতে পারি। সামহাউ মানুষের ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনা মিলে যায়। আমার সিনেমা মানুষ দেখে। কিন্তু এভাবে সিনেমা বানানো যায় না যে, এটা হিট হবে।

আমি জীবনের গল্প নিয়ে সিনেমা বানাই এবং চেষ্টা করি গল্পের মধ্যে জীবনবোধ রাখতে, রিয়েলিস্টিকভাবে রাখতে। খেয়াল করে দেখবেন, আমার ছবি রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচের হয়। মানে খুব বেশি অবাস্তব হয় না। বাস্তব জীবন থেকেই নেওয়া হয়। মানুষ রিলেট করতে পারে। আমার ছবির হিরোকে দেখে মনে হয় এটা আমারই প্রতিচ্ছবি। হিরোইনকে মনে হয় আমার মতোই কেউ একজন বা পাশের বাড়ির একজন। সেজন্য হয়তো দর্শক রিলেট করতে পারে। এবং আমি খুব সহজসরল সিনেমা বানাই। আমার যে কঠিন কঠিন স্ক্রিপ্টগুলো আছে, আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখে সেগুলো নিয়েও আমি সিনেমা বানাবো। আমি দর্শক তৈরি করছি। এখন অবধি আমি খুব সহজসরল সিনেমা বানাতে পছন্দ করি। খুব কঠিন কিছু বানানোর চেষ্টা করি না। হয়তো সে কারণে মানুষ সিনেমাগুলো দেখে।

আর নতুনদের নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। তাদের জন্য আমার একটা কোম্পানিও আছে। সেখানে অনেক নতুন ছেলেমেয়ে কাজ করে। একসময় সেখান থেকেও ডিরেক্টর হবে। সামনে আমাদের পরিকল্পনা আছে একটা ইন্সটিটিউশন করবো। কারণ আমি জানি, অনেক নতুন ছেলেমেয়ে আছে, যারা ঢাকায় গিয়ে ঠিক কী করবে, কীভাবে সিনেমা বানাতে হয়, তার কিছুই বুঝতে পারে না। তাদের জন্য একটা ইন্সটিটিউশন করার চেষ্টা করছি।

ইন্ডিয়াতে ডিরেক্টর, ডিওপিরা [ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি] ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে সিনেমা নিয়ে পড়ালেখা করে আসা। বাংলাদেশে কিন্তু ইন্সটিটিউশন বা স্কুল নাই। কীভাবে করা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। সেটা নিয়ে আমাদের দাবিও আছে। যেহেতু দেশে সংস্কার হচ্ছে। আমাদের এখানেও সংস্কার দরকার। যদি একজন ডিরেক্টর সিনেমা বানাতে চায়, সে কীভাবে সেটা করবে? আমাদের যদি এমন একটা ইন্সটিটিউশন থাকতো, যেখানে শুধু সিনেমা নিয়েই পড়ালেখা করা যায়। ভারতের পুনেতে যেমনটা আছে। অনেক বড়ো বড়ো ডিরেক্টর সেখান থেকে এসেছে। বড়ো বড়ো রাইটার তৈরি হয়েছে। যা আমাদের দেশে নাই। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেশেও সেটা হবে। আপাতত এখন যেটা আছে, আপনাদের যে ডিরেক্টরকে ভালো লাগবে, যার কাজ আপনার পছন্দ, যার মতো আপনি হতে চান, তাকে এসেস করেন। এক-দুই বছর এসেস করেন। তারপর আপনি সহজে ডিরেক্টর হতে পারবেন। কারণ শুধু বইপত্র পড়লেই সিনেমা হবে না। এটা প্রাকটিকাল জিনিস, আপনাকে প্রাকটিকালি শিখতে হবে। প্রাকটিকালি না শিখলে আসলে ডিরেক্টর হওয়া যায় না। এসেস করতেই হবে। যাকে আপনার পছন্দ, আপনি যদি তার সঙ্গে কাজ করেন স্ট্রাগল করতেই হবে।

মামুন হায়দার : আসলে অনেক প্রশ্ন। তাই একটু হলেও আমাদের সেন্সর করতে হচ্ছে। এর পর প্রশ্ন করেছেন সাকিব মল্লিক, গণযোগাযোগ বিভাগ শিক্ষার্থী। উনি প্রশ্ন করেছেন, আপনি বললেন তুফান মুভি স্বৈরাচারী সরকারের আলোকে করা। মুভিটি ওই সরকারের আমলে মুক্তি পায়। তখন আপনি কেনো মিডিয়ার সামনে বলেননি, এটা প্রতীকী সিনেমা? এখন কেনো এ কথা বলছেন? 

রাফী : এখানে আমার প্রশ্ন হলো, একজন ডিরেক্টরকে কেনো বলতে হবে আমার সিনেমাটা কীসের ওপর বানানো? এটা আমাকে কেনো বলতে হবে? আমি যদি আজ কোনো সিনেমা নিয়ে আসতাম, মানে একটা সিনেমার শো হতো, তাহলে কিন্তু আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতাম না। আমার কথাটাই আমার সিনেমা। তাহলে আমি কথা বলছি কেনো? কারণ আমি কোনো সিনেমা নিয়ে আসি নাই।

আমি অ্যাজ আ রাফী এখানে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। আজকে যদি কোনো সিনেমা নিয়ে আসতাম, সিনেমা দেখার পর শুধু সিনেমা নিয়েই প্রশ্ন হতো। কিন্তু আমি যখন কোনো সিনেমা বানাবো, আমি কেনো বলবো, সেটাতে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি! যেমন, আমি কিন্তু এখনো বলছি না, অমীমাংসিত সিনেমাটা সাগর-রুনিকে নিয়ে বানানো। এটা আমাকে কেনো বলতে হবে? এটা আপনারা বলবেন সিনেমা দেখে। আমি এখন বলছি। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে কথাটা বলছি? আমরা মাঝে মাঝে সেন্সর বোর্ডকে ফাঁকি দিই। ফাঁকি দিই কারণ আমরা ডিরেক্টলি সেটা বানালে তারা বন্ধ করে দিতো। শিল্পীর কাজই তো সেটা। এমনভাবে শিল্পকর্মটা সৃষ্টি করবে, যা তারা সহজে বুঝতে পারবে না।

কার্টুনিস্টরা কী করে? হাসিনা আমলে অনেক কার্টুনিস্ট এই ফ্যাসিস্টকে নানাভাবে এঁকেছে। ওরা বুঝতেই পারে নাই সেটা। যারা বোঝার কেবল তারাই বোঝে। আমার কথা সেটাই। আমি কেনো বলবো, আমার সিনেমাটা এই গল্পের? দর্শক যারা বোঝার তারা বুঝে নেবে। এই যে ভোট ডাকাতি হচ্ছে, এই ভোট ডাকাতি আমাদের বাংলাদেশে আগেও হয়েছে। এটা এখান থেকেই রাফী নিয়েছে।

আমি সাধারণত বলি না, কোন সিনেমা কী নিয়ে বানানো। আমি কিন্তু পরাণ হিট হওয়ার পরে বলেছি এটা মিন্নিকে নিয়ে বানানো। এর আগে বলি নাই। আমি বলেছি এটা বাস্তব জীবন থেকে বানানো। আমি চাই সিনেমা দেখার পর দর্শকই বলুক। আগামীতেও আমি বলবো না কোন ঘটনা থেকে সিনেমা বানাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমি যদি বলেই দিই কী বোঝাতে চাচ্ছি, তাহলে মানুষ সিনেমাহলে গিয়ে কী দেখবে? আমার বক্তব্যটা সিনেমাহল থেকে প্রকাশ পাবে।

মামুন হায়দার : একই ধরনের প্রশ্ন করেছেন হাফিজুর রহমানমাইনুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। আমি একটি প্রশ্ন পড়ছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষত জেনজি [১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ দশকের শুরুর বছরগুলোর মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে জেনজি বলা হয়]¾তারা তো আসলে সিনেমাহলে গিয়ে অন্যদের মতো সিনেমা দেখে না। তারা সোশাল মিডিয়াতে রিলস বা শট্স ভিডিও দেখে থাকে। সেক্ষেত্রে সিনেমা তৈরি নিয়ে আপনার মতামত কী? একই রকম প্রশ্ন মাইনুল ইসলাম-এরও। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন রিল্স, শট্স ভিডিও দিয়ে ভরপুর, এমন বাস্তবতায় সিনেমা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে কি না?

রাফী : আমার মনে হয় সিনেমার জনপ্রিয়তা আরো বাড়ছে। প্রযুক্তি আসবে, প্রযুক্তি যাবে। সিনেমা কেনো থেকে যাবে, সেটা ইতিহাস বলে সিনেমা থেকে যাবে। প্রথম যখন ফোন আসে, তখন সবাই মনে করে এবার সিনেমা শেষ! ফোনের প্রতিও কিন্তু এই রকম অ্যাডিক্টশন ছিলো মানুষের। যখন টেলিভিশন আসে, তখন ধারণা করা হয়েছিলো মানুষ আর সিনেমা দেখবে না। কিন্তু সিনেমা এমন একটা জিনিস, যে প্রযুক্তিই আসুক সিনেমা সেই প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে যাবে। ওই যে বললাম, রিলস্। রিলসে জেনজিরা কি ‘দুষ্টু কোকিল ...’ শোনে নাই? জেনজিরাই তো ‘দুষ্টু কোকিলে’ ডাকাতদের নাচিয়েছে। জেনজিরা দেখিয়েছে ডাকাতদের না মেরেও শাস্তি দেওয়া যায়। ওরা বলছে, তুই তিন ঘণ্টা নাচ; এটাই তোর শাস্তি। অনেকে তো ডাকাতকে মেরে ফেলে। যেটা আমরা চাই না। আমরা পছন্দ করি না, ডাকাত ধরে মেরে ফেলা।

দর্শকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে রায়হান রাফী,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন

ওরা তাহলে কী করেছে? আমি শুনেছিলাম, ওরা তিন ঘণ্টা ডাকাতকে ‘দুষ্টু কোকিল’ গানের সঙ্গে নাচিয়েছে। নাচতে নাচতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এটাই ওর শাস্তি। এই যে ইন্টারেস্টিং আইডিয়া এর মধ্যেও সিনেমা আছে, গল্প আছে। তবে হ্যাঁ। ফেইসবুক শুধু সিনেমা না, সব জায়গাই নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা বই পড়ছি না, পড়ালেখা করছি না, গবেষণা করছি না, আমরা ভাবছি না। ফেইসবুক সবচেয়ে বড়ো যে ক্ষতিটা করেছে, আমাদের ভাবনার জায়গাটা বন্ধ করে দিয়েছে। ইভেন আমাকেও। এমনভাবে রিলস্ বানানো, একটা দেখলে আরেকটা দেখতে ইচ্ছে করবে। এমন সিস্টেম করেছে, কষ্ট করতে হবে না আপনাকে। একটার পর আরেকটা আসতেই থাকে। আমার মনে হয়, কয়েকদিন পর এমন হবে যে ইশারা করলেই রিলস্ চেঞ্জ হয়ে যাবে!

আমরা ভাবছি, আমরা প্রযুক্তিকে নিয়ে গেছি। ব্যাপারটা তা নয়। আসলে প্রযুক্তিই আমাদের নিয়ে গেছে। খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যা নিয়ে কথা বলবেন, ফেইসবুক আপনাকে সেটাই দেখাবে। ফেইসবুক আসলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আরো খেয়াল করবেন, আন্দোলনের সময় যারা আন্দোলন করেছে ওদের কাছে আন্দোলনের ছবি অটোমেটিক চলে গেছে। কারণ ফেইসবুক জানে আপনি এটা দেখতে চাচ্ছেন। আমাদের উচিত, এই জায়গা থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

সম্প্রতি আমি চায়নায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। আন্দোলনের সময় আমি আমেরিকাতে ছিলাম অনেকদিন। আমাদের মতো খুব কম মানুষ ফেইসবুক চালায়। আমরা মনে হয় একটু বেশিই আসক্ত। আমাদের এই আসক্তি কমাতে হবে। এই যে এখন বই না পড়া, মানুষের ক্রিয়েটিভিটি কমে যাওয়া, এর বড়ো কারণ রিলস্। এটা আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। হিরো আলমদের মতো মানুষ তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট মানুষ তৈরি হচ্ছে। যেটা হওয়ার কথা ছিলো না।

আমরা হাসতে হাসতে একটা জিনিস দেখে সেটাকে হিট করে দিচ্ছি। যাতে সমাজের ক্ষতি হচ্ছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো, আপনারা এমন জিনিস দেখেন, যা ভাইরাল করলে সমাজের উপকার হয়। আপনারা হিরো আলমকে ভাইরাল করবেন না। নেগেটিভ ক্যারেক্টারগুলোকে ভাইরাল করবেন না। আপনারা হাসতে হাসতে ভাইরাল করছেন। আর ওরা এটা নিয়ে ব্যবসা করছে।

রিলস্ শুধু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে না, ফেইসবুক রিলস্ আমাদের পড়ালেখা, মেধা, চিন্তাধারা এবং সচেতনতা অনেক বেশি কমিয়ে দিচ্ছে। আমি কালকে একটা ছবি দেখছিলাম, কেউ একজন রেললাইনে কাটা পড়েছে। একটা মানুষের হাত রেলে কাটা পড়েছে। সবাই সেটা ভিডিও করছে। আমাদের চিন্তা কোথায় চলে গেছে, ভিডিও করে ফেইসবুকে দিলে বেশি রিচ হবে। সামনে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর দিন আসছে, আমাদের ইমোশন চলে যাচ্ছে। ইমোশন চলে আসছে ফোনের মধ্যে। খেয়াল করবেন, কোথাও ঘুরতে গেলে বা রেস্টুরেন্টে গেলে আমরা কিন্তু আর খাই না। ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করছি। আমরা বন্ধুরা আর আড্ডা দিই না। এখনকার প্রেমগুলোও ভালো নেই। আগের প্রেম কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং ছিলো। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতো। এখন প্রেম হচ্ছে আর ফেইসবুকে লিখছে। আসলে প্রতিটা জায়গা থেকে ফেইসবুক আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। শুধু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি না, সব জায়গায় এটা হচ্ছে।

জেনজিরা কিন্তু শুধু রিলস্ দেখে না। ওরা অনেক বুদ্ধিমান। ওরা হলিউডের সব সিনেমা দেখে। ওদের কারো কারো সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। অনেকে মনে করে ওরা ফার্মের মুরগি টাইপের। কিন্তু ওরা অনেক ট্যালেন্টেড। আমি আপনাদের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটা গল্প বলি। ব্র্যাকে পুলিশ সবচেয়ে বেশি কেনো মার খেয়েছে জানেন? ওরা গেমসের মতো করে পুলিশের সঙ্গে খেলেছে। ওরা পাঁচজন সামনে থেকে পুলিশকে আক্রমণ করে। যখন পুলিশ আসে তখন ১০০ জন পেছন থেকে আক্রমণ করে। পুলিশ কোনোভাবেই কুলাতে পারে নাই। কী যেনো একটা গেমস আছে। আমি অবশ্য কখনো খেলি নাই। ঠিক সেই স্টাইলে ওরা খেলেছে। যে কারণে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পুলিশরা বেশি মার খেয়েছে। যাইহোক, অনেক সময় গেমস খেলেও ভালো কাজে লাগে।

আমাদের সিনেপ্লেক্সের একেকটা ভাগ আছে। বসুন্ধরার ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’-এ বড়োলোকেরা সিনেমা দেখে। ‘মধুমিতা’তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি সিনেমা দেখে। মহাখালীর এস  কে এস সিনেমাহলে জেনজি টাইপেরা সিনেমা বেশি দেখে। আপনারা জানলে খুশি হবেন, তুফান সবচেয়ে বেশি হিট হয়েছে ওখানে। তার মানে ওরা বাংলা সিনেমা দেখতে চায়¾যে সিনেমা একটু হলিউডিস্ট হবে, একটু বলিউডিস্ট হবে। আমরা আসলে যে ধরনের সিনেমা বানাই ওরা সেগুলো এনজয় করে না। তাই আমার মনে হয় আমরা যদি এমন সিনেমা বানাই যেটা ওরা কানেক্ট করতে পারবে, তাহলে ওরা সিনেমা দেখবে।

মামুন হায়দার : ‘প্রথম আলো’র রাজশাহী প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম প্রশ্ন করেছেন। তার প্রশ্ন হলো, দহন সিনেমাটা নিয়ে একটু বলবেন? আমার কেনো জানি মনে হয় সিনেমাটা একটি রাজনৈতিক দলকে বেশি সুবিধা দিয়েছিলো। চলচ্চিত্রটি বানানোর ক্ষেত্রে কি কোনো চাপ ছিলো? কিংবা এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে বলবেন।

রাফী : একদমই না। আমি যেমন বাস্তবধর্মী সিনেমা বানাই, তেমনই একটি সিনেমা দহন। আমার জানোয়ার যেমন একটা সিনেমা, পরাণ যেমন একটা সিনেমা, সামনে আমি যে সিনেমা বানাচ্ছি ক্রসফায়ার নিয়ে, সেটাও একটা সিনেমা। কিংবা সাগর-রুনিকে নিয়ে যেটা বানানো সেটাও একটা সিনেমা। আমার কাছে মনে হয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারা খুব অন্যায়; তাই আমি কমার্শিয়াল ওয়েতে সিনেমাটি বানিয়েছি। এটা হয়তো কারো পক্ষে কারো বিপক্ষে গেছে। কিন্তু আমি আসলে রিয়েল স্টোরি নিয়েই সিনেমা বানাবো।

২৪-এর আন্দোলন নিয়েও সামনে যে সিনেমাটা বানাবো, এটাও কারো না কারো পক্ষে-বিপক্ষে যাবে। কোনো একসময় এটা নিয়ে কথা উঠবে, এটা কেনো বানিয়েছি! আপনারা একটা জিনিস খেয়াল করবেন, আমি কিন্তু সিনেমাতে জাস্টিফিকেশন দিই না, কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো। অমুক ক্রিমিনাল, অমুক ক্রিমিনাল না। আমরা একটা গল্প তুলে ধরি। আর আমি এমন বাস্তবধর্মী গল্প নিয়েই সিনেমা বানাবো। অলরেডি ট্যাগলাইন হয়ে গেছে, রাফী রিয়েল স্টোরি নিয়ে সিনেমা বানায়। দহন ওই ধরনের স্টোরি-ই ছিলো।

মামুন হায়দার : দেলোয়ার, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। উনি প্রশ্ন করেছেন¾নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ যারা সিনেমা দেখা শুরু করেছে, তাদের আসলে কাদের সিনেমা দেখা দিয়ে শুরু করা উচিত? এবং সিনেমা দেখার কৌশলটা কী, যা তাকে সিনেমাপ্রেমী করে তুলবে?

রাফী : সিনেমা দেখার কৌশল একেকজনের কাছে একেক রকম। এবং কাদের সিনেমা দেখা উচিত সেটা নিয়েও পছন্দের ভিন্নতা আছে। সিনেমা তো আপেক্ষিক বিষয়। একটা সিনেমা কারো কাছে অনেক ভালো লাগে, কারো কাছে লাগে না। কারো কাছে মনে হয় গল্প খুব ভালো, কারো কাছে ভালো না। একেকটা সিনেমা একেক রকম¾গান যেমন। আপনার কাছে একটা গান ভালো লাগে, তো আরেকজনের কাছে লাগে না। খুব আপেক্ষিক জিনিস। ফলে এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমি দিতে পারবো না। আমার টেস্ট আর আপনার টেস্ট এক নাও হতে পারে।

তবে আপনার সেই রকম সিনেমা দেখা উচিত, যেটা আপনার কাছে ভালো লাগে। যেটা আপনি এনজয় করেন। অনেকে যুদ্ধের সিনেমা দেখে এনজয় করে, অনেকে কার্টুন সিনেমা দেখে এনজয় করে কিংবা সুপার হিরো। যেমন আমি খুব রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচের সিনেমা দেখে এনজয় করি। আমি এমন সিনেমা দেখে এনজয় করি, যেটা আমি বানাতে পারবো। আমি হলিউডের অনেক বেশি সুপার হিরো টাইপের মুভি দেখে এনজয় করি না। আমার কাছে মনে হয় এটা আমি কোনোদিন বানাতে পারবো না। এটা আমার কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না।

আমি এমন সিনেমা দেখতে পছন্দ করি, যেটা আমি বিশ্বাস করি বা বানাতে চাই। এবং আমার সঙ্গে মিলে। তাই আমার মনে হয়, কেউ সত্যজিৎ রায়কে দেখবে, কেউ মৃণাল সেন দেখবে, কেউ জহির রায়হান দেখবে, কেউ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দেখবে, কেউ তারেক মাসুদ দেখবে। যার যেটা ভালো লাগে। তবে সিনেমা দেখতে হবে। সিনেমা দেখলে অনেক কিছু শেখা যায়, জানা যায়। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখা উচিত। আমি তার সিনেমা পছন্দ করি। ইরানি সিনেমা অনেক ভালো হচ্ছে। একেকজন ডিরেক্টরের তো একেক রকম ফিলোসফি। একেক রকম ভাবনা। ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলার স্টাইল। যে যতো বেশি সিনেমা দেখবে সে ততো বেশি সিনেমাবোদ্ধা হবে। সিনেমার জন্য ভালো হবে।

‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১২’তে উপস্থিত দর্শকের একাংশ,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন 

ডিরেক্টর হতে গেলে একটা জিনিস মাস্ট, প্রতিদিন অন্তত একটা সিনেমা করে দেখতে হবে। সেটা যে সিনেমাই হোক। প্রতিটি সিনেমা থেকে কিছু না কিছু শিখবেই। সেটা একটা শট্ হতে পারে, দৃশ্য, সংলাপ বা যেকোনো কিছু হতে পারে। কেউ যদি ফিল্মে কাজ করতে চায়, সিনেমা দেখার কোনো বিকল্প নাই। সে রাইটার, অভিনয়শিল্পী বা আর যাইহোক।

মামুন হায়দার : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তুষার ইমরান তোফা। উনি প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশে কেনো শিক্ষামূলক, গবেষণামূলক সিনেমা তৈরি হয় না? হলিউডে যেমন ইন্টারস্টেলার, টেনেট; বলিউডে তারে জামিন পার, থ্রি ইডিয়টস, সুপার ৩০ বা টুয়েলভথ ফেইল-এর মতো সিনেমা দেখা যায়। আমাদের দেশে কেনো এমন সিনেমা দেখা যায় না?

রাফী : বলিউড কিংবা হলিউডের দর্শকের প্রতি সপ্তাহে একটা জিনিস কমন থাকে, সবাই সিনেমা দেখে। কিন্তু আপনারা তো সিনেমা দেখতে যান না। আপনারা মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতে যান। যে সিনেমার হাইপ ওঠে, যে সিনেমা না দেখলে ইজ্জত থাকবে না¾‘আরে তুই হাওয়া দেখিসনি, তুই তো তাহলে ক্ষ্যাত!’, ‘তুফান এখনো দেখা হয় নাই, তুমি তো তাহলে জাতে নাই’¾আপনারা সেই সিনেমা দেখতে যান। সরি, আপনারা কিছু মনে করবেন না।

বলিউড কিংবা হলিউডের দর্শকের কাছে সিনেমা দেখা কালচার। আমরা যেমন চা খেতে যাই, ওই রকম ওরা সিনেমা দেখতে যায়। সিনেমা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে। এই জন্য ওখানে একটা তারে জামিন পার হয়, এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা হয়। আমাদের দেশে কীভাবে হবে? আমাদের সিনেমার বাজেট কতো? আমরা কোনো রাইটারকে ওই পরিমাণ পেমেন্ট করতে পারবো যে, একটা গল্প নিয়ে দুই বছর ভাববে। আমরা একটা গল্পের জন্য রাইটারকে দিই ৫০ হাজার টাকা! সে কীভাবে ভাববে!

আমরা যেভাবে ফোন কেনা শুরু করেছি, দেখবেন অলিতে গলিতে ফোনের দোকান হয়ে গেছে। কারণ আমরা ফোন চালাই। আপনারা যখন সিনেমা দেখবেন, তখন বেশি বেশি সিনেপ্লেক্স হবে, সিনেমা হবে, ভালো সিনেমাও তৈরি হবে। আমাদের দেশে ডিরেক্টররা যে এখনো সিনেমা বানায় সেটাই বেশি! কারণ এখানে মানুষ মাঝে মাঝে সিনেমা দেখে। এটা মানুষের দোষ না। আমাদেরই দোষ। আমরা তাদের সিনেমা দিতে পারছি না। আমাদের ডিরেক্টর সঙ্কট, আর্টিস্ট সঙ্কট। আমাদের সবকিছু সঙ্কটে ভরা।

আমাদের দেশে এখনো সিনেমাকে আমরা শিল্প [industry] বলতে পারছি না। এখানে সিনেমা নিয়ে কেউ ভাবে না। এই ২৪-এর আন্দোলনের পরও দেখেন এখনো সিনেমা নিয়ে সংস্কার শুরু হয়নি। শুধু ওই সেন্সর সার্টিফিকেশন হয়েছে। আমি তুফান বানিয়েছি ভারতে। কেনো? কারণ আমাদের দেশে তেমন কোনো সেট নাই! কোথায় বানাবো সিনেমা? সামান্য একটা পিস্তল নাই সিনেমায় ব্যবহারের জন্য! আপনারা সিনেমা দেখে হাসেন। এটা কোনো পিস্তল হলো, খেলনা পিস্তল! তাহলে সেই পিস্তলটা কোথায় পাবো? কোনো ইকুইপমেন্ট নাই।

আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় কষ্ট করে শুটিং করতে হয়। বাংলাদেশের ডিরেক্টররা নাই¾এর মধ্যে দিয়ে সিনেমা বানায় আসলে। তাদের এমন-ই স্যালুট করা উচিত! বাট ইন্ডিয়াতে সব আছে। ফেক পিস্তল থেকে শুরু করে, ফেক সব পাওয়া যায়। সিনেমা বানানোর জন্য সব রেডি। ফিল্ম স্কুল আছে, যারা গবেষণা করে। আমাদের দেশে কিছুই নাই। আমরা চেষ্টা করছি সিনেমা বানানোর জন্য। আপনারা যদি সিনেমা দেখেন তখনই আমাদের দেশে ওই ধরনের সিনেমা হবে। আমি অনুরোধ করছি, আপনারা নিজেরাই শুরু করেন। আমরা সপ্তাহে না হোক, অন্তত মাসে একটা সিনেমা দেখি। তাহলেই আরো ভালো ভালো সিনেমা হবে। 

মামুন হায়দার : অনিক ইসলামসালাউদ্দীন নীল, দুজনই নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। তারা স্ক্রিনপ্লে নিয়ে প্রশ্ন করেছেন¾স্ক্রিনপ্লে শিখতে সাহায্য করবে, এমন তিনটি সিনেমার নাম যদি বলতেন। আপনি কি কখনো হরর সিনেমা বানানোর কথা ভেবেছেন? একই রকম প্রশ্ন নীল করেছেন। আপনি জীবনের প্রথম কোন গল্পটা লিখেছিলেন? বিষয়বস্তু কী ছিলো? নতুন কেউ গল্প লিখলে আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে কি না? থাকলে কীভাবে?

রাফী : আমি প্রথম গল্প লিখেছিলাম আমার জীবন নিয়ে। মাদ্রাসা নিয়ে গল্পটা লিখেছিলাম। ওটা কেউ প্রোডিউস করেনি। আমি ওই সময় বানাতে পারিনি। সামনে বানাবো ইনশাআল্লাহ। আমি খুব লাকি তখন এটা বানাইনি। কারণ তখন বানালে এটা কেউ দেখতো না। এখন বানালে হয়তো দেখবে।

আর চিত্রনাট্য লেখার জন্য কোন সিনেমা দেখবেন¾এটা নির্ভর করে সে কী ধরনের চিত্রনাট্য লিখতে চায়। আমাদের আলোচনায় যে রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচের সিনেমার নাম উঠে আসলো, সেগুলো দেখলে ভালো। একেক দেশে একেকজন ডিরেক্টরের [কৌশল আলাদা]। সিনেমা অনেক ধরনের হয়। সিনেমা খুব ফাস্ট পেইসের হয়, কেউ খুব স্লো বানায়। তাই আপনি কী ধরনের সিনেমা বানাতে চান, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করবে। আপনার যে ভাবনা, আপনি কী ধরনের গল্প পছন্দ করেন¾আপনি যদি থ্রিলার লিখতে চান, আপনাকে থ্রিলার সিনেমা দেখতে হবে। আপনি একটু রোমান্টিক সিনেমা বানাতে চাইলে রোমান্টিক দেখতে হবে। এটা টেস্টের ওপর নির্ভর করে।

একেকজনের একেক সিনেমা ভালো লাগে। যেমন, টাইটানিক আমার অনেক ভালো লেগেছিলো। এটার মধ্যে আমি অনেক রোমান্স পেয়েছিলাম, রিয়েল স্টোরি ছিলো, প্রেম ছিলো। থ্রি ইডিয়টস আমার এখনো প্রিয় ছবি। এখনো মাঝে মাঝে ভালো না লাগলে আমি এই সিনেমা দেখি। দেশের বাইরে যখন যাই থ্রি ইডিয়টস দেখি। টুয়েলভথ ফেইল দেখে আমি অনেকবার কান্না করেছি। বজরঙ্গি ভাইজান আমার অনেক পছন্দের ছবি। কারণ ওরা বেশিরভাগ সিনেমা বানায় ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে। আর ওখানে দেখিয়েছে বন্ধুত্ব। এটা একটা ডিফারেন্ট আইডিয়া। আবার নাচগান-ও আছে, সালমান খান আছে। এ রকম অনেক ইন্টারেস্টিং ছবি হয়। আমি সব ধরনের ছবি দেখি। আমার সব ধরনের ছবি ভালো লাগে। আমার গল্প বলতে, গল্প শুনতে ভালো লাগে আরকি।

মামুন হায়দার : অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছে নির্মাতার কাছে। এর মধ্যে আবার কিছু প্রশ্ন রিপিটও আছে। তাই সেগুলো বাদ দিলে আপনারা কিছু মনে করবেন না প্লিজ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কৌশিক দাশ কঙ্কন প্রশ্ন করেছেন, আগামীতে যদি মন খুলে সিনেমা না বানানো যায়, তখন কী করবেন?

রাফী : কী আর করবো, দেশের বাইরে চলে যাবো [হাসি]। সেখানে গিয়ে সিনেমা বানাবো। সিনেমা তো বানাতেই হবে। এর বাইরে তো আর কিছু পারি না। যতোই ঝড়-তুফান আসুক সিনেমা বানাতে চাই। এই একটা কাজই এনজয় করি। যখন আমি শুটিংয়ে যাই, শরীরে অন্য রকম স্পিড আসে, ভালো লাগা চলে আসে। এই একটা জিনিসই পারি আমি। এটার জন্যই আপনারা আমাকে ভালোবাসেন। তাই এখানে এসে বসতে পারছি। এর আগে যেই ডিরেক্টররা এখানে আসছে সবার কাজ দেখে আমি ডিরেক্টর হয়েছি। নূরুল আলম আতিক, মেজবাউর রহমান সুমন, অমিতাভ রেজা চৌধুরী¾তারা কিন্তু আমার অনেক সিনিয়র। তারা যেই প্রোগ্রামে আসছে সেই প্রোগ্রামে আমিও আসতে পেরেছি।

রিপন নাথ ছিলো আমার প্রথম শর্টফিল্মের সাউন্ড ডিজাইনার। আমি রিপন নাথকে গিয়ে বলেছি, ভাই শর্টফিল্ম বানাবো, কিন্তু আমার বাজেট নাই; আমাকে কাজটা একটু করে দেন। তিনি আমাকে ফ্রি সাউন্ড ডিজাইন করে দিয়েছিলেন। এই আয়োজনে আগে রিপন নাথ এসেছে, তার পরে আমি এসেছি। এটাই আমার লাইফের সাকসেস। এখন যদি আমি সিনেমা বানানো বন্ধ করে দিই বা কালকে মারা যাই, তাহলে আমার কোনো আফসোস থাকবে না। সিনেমা বানাতে এসে আল্লাহ পাক অনেক কিছু দিয়েছে।

আমি আরেকটা বিষয় করার চেষ্টা করেছি। অনেকে এটা করে নাই। যদিও এই প্রশ্নটা এখনো আসে নাই। তারপরও বলে ফেলি। আমি যেটা করেছি, সিনেমা বানিয়ে প্রথমে টাকা কামিয়েছি। টাকা যদি না কামাই, শুধু ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে তো আর জীবন চলবে না। অনেক মানুষ সিনেমাতে আসে না, কারণ এখানে পয়সা নাই। আমি সিনেমা বানিয়েছি আমার রেমুনারেশন বাড়িয়েছি। একটা কথা হচ্ছে, মানুষ পলিটিশিয়ানদের ভয় পায়? কারণ দেখে তারা পাওয়ার খাটাচ্ছে, এই করতেছে, সেই করতেছে। তখন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, আমি পলিটিকস করবো, নেতা হবো, আমি ডাক্তার হবো, পাইলট হবো। আমার এমন ভাবসাব থাকবে। একটা বিষয় দেখেন, আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ডিরেক্টরদের মধ্যে কোনো স্টার/আইডল ছিলো না। তাহলে আমি কেনো ডিরেক্টর হতে চাইবো? লাস্ট মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে দেখেছিলাম, একজন স্টার ডিরেক্টর। আমার মনে হয়েছে, আমি এমনভাবে থাকবো যেনো আমাকে দেখে ১০ জন ডিরেক্টর হতে চায়। একজন মানুষ ডিরেক্টর কখন হতে চাইবে? যখন সে দেখবে তার জীবনটা সেইফ। সে যদি ডিরেক্টর হয়, তাকে আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হবে না।

আর একটা কথা, সিনেমা বানানো কিন্তু ভিক্ষা করে হয় না। ভাই, টাকা দাও, টাকা দাও¾এটা করে সিনেমা হয় না। এটা আলিশান জিনিস, আলিশান ভাবেই করতে হবে। আমি যেটা করেছি, নিজেকে সেভাবে গড়ার চেষ্টা করেছি। এবং এটা করে পয়সা কামানোর শুরু করেছি। আমিই মনে হয় প্রথম ডিরেক্টর যে সিনেমা বানিয়ে মার্সিডিজ গাড়ি কিনেছি! কেনো কিনেছি? কারণ এটা দেখে যেনো আরেকজন ডিরেক্টর ভাবে শুধু নায়করাই কেনো গাড়ি কিনবো। এর আগে শুধু নায়িকারাই দামি ফোন কিনতো; নায়করাও কিনতো। ডিরেক্টররা কিন্তু গরিবই থাকতো। আমি নিজেকে ওই জায়গায় রাখি নাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, না আমিও কিনবো। আমি নিজেকে ওইভাবে তৈরি করেছি। একজন মানুষ তখনই ডিরেক্টর হতে চাইবে, যখন তার কাছে মনে হবে ডিরেক্টরের যে সম্মান, নায়কেরও সেই সম্মান, নায়িকারও সেই সম্মান এবং প্রোডিউসারেরও সেই একই সম্মান।

রাজকুমার হিরানী একজন স্টার ডিরেক্টর। আপনি যদি বাইরের স্টার ডিরেক্টরদের দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন এই বিষয়টা। আমাদের ডিরেক্টররা কতো টাকা পায়? দক্ষিণ ভারতের ডিরেক্টর অ্যাটলি কুমার একটা সিনেমার জন্য ৬০ কোটি টাকা নেয়। তাহলে কেনো ওর সিনেমা ভালো হবে না বলেন! থ্রি ইডিয়েটস থেকে রাজকুমার হিরানী যতো টাকা পেয়েছে, ওই টাকা দিয়ে ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী চলতে পারবে। আমাদের দেশে এই জায়গাতে একটা সঙ্কট ছিলো। মিডিয়াতে অভাব ছিলো। বিষয়টা এমন যে, মিডিয়া মানেই ও মানুষের কাছ থেকে চেয়ে সিগারেট খাবে। ওর টাকা নাই, বাসা ভাড়া দিতে পারবে না। এটা যদি হয়, ইয়াং জেনারেশন তো এখানে আসবে না। কে আসবে তার জীবনটা নষ্ট করতে, বলেন! যখনই দেখবে, তার জীবনটা সেইফ, তখনই না আসবে! যখন কেউ দেখবে সিনেমা বানালে ভালোভাবে থাকা যায়, ভালো লাইফ লিড করা যায় এবং জীবনকে ভালোভাবে গড়া যায়, তখনই তো আসবে।

মামুন হায়দার : আমাদের দিক থেকে শেষ প্রশ্ন করছি। একজন এখানে এসে কথা বলতে চান। তার আগে আমাদের দিক থেকে এটাই শেষ প্রশ্ন। অনেক প্রশ্ন এসেছে কিন্তু সব প্রশ্ন করা হয়নি। আমাদের মনে হয়েছে, প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনো না কোনোভাবে দেওয়া হয়ে গেছে। আমি আবারও প্রশ্নগুলো চেক করলাম। মাহমুদুল হাসান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। মাহমুদুল প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশের সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে তুফান-এর রোল কতোটুকু এবং কীভাবে? কিংবা বাংলাদেশের সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে তুফান আমরা কীভাবে পাঠ করবো আসলে?

রাফী : দেখেন, তুফান একটা কমার্শিয়াল সিনেমা। একটা দেশে কমার্শিয়াল সিনেমা বানানো খুব ইম্পরটেন্ট। হলিউড, বলিউডের দিকে একটু দেখেন। বাহুবলীর মতো সিনেমা কেনো বানায়? ইন্ডাস্ট্রিটা বড়ো করার জন্য। সবসময় যদি সুড়ঙ্গ-এর মতো সিনেমা আমরা বানাই, তখন কী হয় অল্প দর্শক সিনেমা দেখতে যায়। হাইপটা ক্রিয়েট হয় না। আপনি যখন সুপারস্টারকে নিয়ে সিনেমা বানাবেন তখন মার্কেটটা বড়ো হবে। একটা তুফান থেকে কী হয়েছে, মার্কেটটা ১০ কোটি টাকার হয়ে গেছে। তুফান-এর বাজেট ছিলো ১০ কোটি টাকা। এবং এক মাসে আমরা প্রায় ৫৩ কোটি টাকার টিকিট সেল করেছি! যে সিনেমা ব্যবসা করে সেখান থেকে হলমালিক টাকা পায়, প্রোডিউসার টাকা ফেরত পায়।

অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তৃতায় ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন 

তুফান-এ একটু গান ঢুকিয়েছি, মারামারি ঢুকিয়েছি¾এটা কিন্তু কমার্শিয়াল প্যাটার্ন। আমি যে ধরনের সিনেমা বানাতে পছন্দ করি, সে ধরনের সিনেমা কিন্তু এটা না। এখানে আমি কিছু কিছু বিষয় ঢুকিয়েছি¾একজন ডন কীভাবে ডন হয়ে ওঠে। পলিটিকস কীভাবে পাওয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করে, তুফান কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এবং সেই তুফানকে ধরার জন্য কীভাবে আরেকটা তুফান তৈরি করে। এটা করেছি আমি ফিকশনালভাবে।

আপনারা যদি একটু খেয়াল করেন, এই তুফানের সঙ্গে কালা জাহাঙ্গীর-এর মিল পাবেন, সুইডেন আসলাম-এর মিল পাবেন¾আমাদের দেশের বড়ো সন্ত্রাসী এরা। এই তুফানের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাই-এর মিল পাবেন। জীবন থেকে নিয়ে অনেক সময় সিনেমা হয়। তুফানের সঙ্গে আমাদের এখনকার ডার্ক পলিটিকসেরও মিল পাবেন। এখনকার পলিটিশিয়ানরা তাদের গভর্নমেন্টকে টিকিয়ে রাখার জন্য সন্ত্রাসী বাহিনী পালে। এই জায়গায় নির্মাতার দায় সিনেমা বানানো। আমার সিনেমা দেখে মানুষ যেনো ভালো কিছু শিখে, খারাপ কিছু থেকে বিরত থাকে।

তুফান বানানোটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো হয়েছে। সেটা কীভাবে? একটা সিনেমা যখন ব্যবসা করে অনেকগুলো মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয় এখান থেকে। যে লোকটা ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করে, সিনেমা যখন হিট হয়, সেও কিন্তু ওই টাকা দিয়ে চলতে পারে। যে টিকিট বিক্রি করে সেও কিন্তু টাকা পায়। যিনি সিনেমাহলে টর্চলাইট মারেন, সেও টাকা পায়। এভাবে লাখ লাখ মানুষ এখান থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এটা গেলো প্রথম কথা।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আপনারা যে সিনেমা দেখতে হলে যাচ্ছেন, যেই রিকশা দিয়ে যাচ্ছেন তার উপার্জনও কিন্তু সিনেমা থেকে আসতেছে। দর্শক সিনেমা সামনে নিয়ে যে পপকর্নটা খাচ্ছে, যে ড্রিংস খাচ্ছে, সেটা থেকেও কিন্তু আয় করে মানুষ। ভালো সিনেমা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আবার যখন সেই সিনেমা দেশের বাইরে মুক্তি পায়, সেখান থেকেও আয় হয় দেশের। তার মানে একটা সিনেমা যখন ব্যবসাসফল হয়, অনেকগুলো মানুষ উপকৃত হয়। সিনেমার দিকে মানুষ মনোযোগী হয়। ওখান থেকে আবার ইনভেস্ট হয় আরেকটা ফিল্ম তৈরিতে। এভাবে আরো ১০ জন ডিরেক্টর তৈরি হবে পরে। এভাবে ইন্ডাস্ট্রিটা আস্তে আস্তে দাঁড়ায়।

মামুন হায়দার : একজন মঞ্চে এসে সরাসরি প্রশ্ন করতে চান। আপনার পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করুন। আসসালামু আলাইকুম, আমি এহসান তাহসিন জামান, দর্শন বিভাগে পড়াশোনা করি। আমি যেটুকু বুঝেছি আপনি প্রথমে কমার্শিয়াল ফিল্ম নির্মাণের মাধ্যমে ম্যাস অর্ডিয়েন্স ক্রিয়েট করে, তারপর আর্টফিল্মে যেতে চান। সেক্ষেত্রে আপনি কী মনে করেন, ম্যাস অর্ডিয়েন্সের জন্য আর্টফিল্ম হতে পারে? ম্যাস অর্ডিয়েন্স কি তারকোভস্কি কিংবা বার্গম্যান বুঝবে? সত্যজিৎ রায় কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষ যদি ভাবতেন, আমি কমার্শিয়ালি আর্টফিল্ম বানাবো, তাহলে তারা কী তাদের মানের আর্টফিল্ম বানাতে পারতেন?

রাফী : খুবই দারুণ প্রশ্ন। যখন সত্যজিৎ রায় সিনেমা বানাতেন, তখন কিন্তু সিনেমার একটা কালচার ছিলো। মানুষ সিনেমা দেখতো। এখন সিনেমার কালচার সেই জায়গায় নেই। আপনাদের মতো যারা ফিল্ম নিয়ে গবেষণা করেন, ফিল্ম নিয়ে ভাবেন, শুধু তাদেরকে চিন্তা করে সিনেমা বানালে সেটা ব্যবসা করবে না। ডিরেক্টর যখন সিনেমা বানাবে, তখন পয়সা কে দিবে? টাকা কেউ তখনই দিবে যখন সেটা রিটার্ন আসবে। আপনি যদি দেখেন ব্যবসায় রিটার্ন নাই, তাহলে তো কেউ ইনভেস্ট করবে না। তখন সিনেমার সুবর্ণ সময় ছিলো। এখন সিনেমা তো ভালো অবস্থায় নাই। এখন কেনো আরেকটা সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ তৈরি হচ্ছে না? কারণ ওই জায়গাটা, পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

আপনারাই দেখেন, ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা আগে প্রচুর সিনেমা দেখতো। এখন সেটা নাই। এতো বড়ো একটা ইউনিভার্সিটি, এখানে একটা হল থাকতে পারতো না? যে হলে এই ধরনের সিনেমা চলতো। এখানে হয়তো সিনেমা দেখার জন্য ১০ টাকার টিকিট থাকতো। এটা আমাদের সোসাইটির সমস্যা। এই সোসাইটিকে চেঞ্জ করতে গেলে ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট জিনিস দর্শককে দিতে হবে বলে আমার মনে হয়। এটা আমার ফিলোসফি। একেকজন ডিরেক্টরের ফিলোসফি একেক রকম।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাইয়ের কাজ দিয়েই চিন্তা করেন। উনি প্রথমে ব্যাচেলর বানিয়েছে, তারপর ফোর টোয়েন্টি, এরপর টেলিভিশন, ডুব, এরপর না শনিবার বিকেল। এর মাধ্যমে দেখতে পারবেন, ওনার থটের চেঞ্জিং। উনি প্রথমেই যদি ডুব বানাতেন, তাহলে তো আর ডিরেক্টর হতে পারতেন না। উনি বানিয়েছেন ব্যাচেলর। ওই সময়ের কনটেন্ট¾বাচ্চা হবে নাকি হবে না¾এই রকম। লিটনের ফ্ল্যাট,খুবই ট্রেন্ডি কনটেন্ট। আস্তে আস্তে উনি এখন ওনার থটগুলো দিতে পারছেন। এটা করলে তো হবে না যে, আমি এমন একটা থট দিলাম যেই থট কেউ বুঝতেই পারলো না। এখন যদি আমি একটা আর্টফিল্ম বানাই, তখন দর্শক ভাববে, রায়হান রাফীর তুফান দেখেছিলাম, এই সিনেমাটাও দেখে আসি। দর্শককে আমি আমার মেসেজটা দিতে পারবো তাহলে। একটু হলেও তারা সেই সিনেমা দেখবে। যখন আমি রায়হান রাফী না, তখন আমি কথা বললে দর্শক তো শুনবেই না; সিনেমা দেখবেনই না আপনারা। এখন অ্যাট লিস্ট আমার একটা সিনেমা আসলে আপনারা সেটা দেখবেন। যেমন, আমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি, মাদ্রাসার স্টুডেন্টদের নিয়ে যদি সিনেমা বানাই সেই সিনেমাটা মানুষ দেখবে। কেনো দেখবে? কারণ আমার সিনেমাগুলো আগে মানুষ দেখেছে। নাম হলো এই রকম ইম্পরট্যান্ট।

ধন্যবাদ সবাইকে। অনেক ভালো লাগলো সবার সঙ্গে কথা বলতে পেরে। আপনাদেরকে বলবো, যে সংস্কার চাচ্ছেন, সংস্কারের কথা বলছেন, তার জন্য আমরা নিজেরাও যেনো নিজেদের জায়গা থেকে সংস্কার হই, চেঞ্জ হই। ভাবতে হবে, আমি এই নতুন বাংলাদেশে নিজে কী করলাম আরকি। শুধু অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, ওরা কী করলো। সবাই যদি নিজেদের জায়গা থেকে একটু একটু করে কিছু করি, বাংলাদেশটা আসলেই তখন সুন্দর হয়ে যাবে। এই দেশটাকে শুধু নেতারা, পলিটিশিয়ানরা চেঞ্জ করতে পারবে না। আমরা যদি আমাদের জায়গা থেকে চেঞ্জ হই, তাহলেই চেঞ্জ হবে। আমরা যদি দেশটাকে ময়লা না করি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি, যদি দেশটাকে ভালোবাসি, তাহলেই দেশ সুন্দর হবে। আমরা নিজেরাই দেশটাকে নষ্ট করি।

আমরা যদি দেশের সিনেমা দেখি¾বাহুবলী, কেজিএফ দেখছি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে¾আমরা যেনো বাংলা ছবি দেখি। বিভিন্ন ধরনের সিনেমা হয়, সেটা আপনারা দেখেন না। তখন ডিরেক্টরের উৎসাহ কমে যায়। অনেক ভালো ভালো আর্টফিল্ম বাংলাদেশে হচ্ছে; কিন্তু সেভাবে দেখছে না মানুষ। আপনারা দেশের সিনেমা দেখেন। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশেই তৈরি হতে পারে সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ। কারণ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সেই মেধা আছে। আপনারা যদি বাংলা ছবির সঙ্গে থাকেন, সারা পৃথিবীতে একদিন বাংলা ছবি ভালো কিছু করবে। অলরেডি বাংলা ছবির যে আইডিয়া, যে গল্প, এটা পৃথিবীর যে দেশেই গেছে সবাইকে অবাক করেছে। সুড়ঙ্গ, হাওয়া ভালো রেস্পন্স পেয়েছে। আয়নাবাজি এখনো দেশের বাইরে অনেকের ফেভারিট ছবি। আমাদের আশপাশে অনেক গল্প। আমরা যদি ভালো সিনেমা বানাতে পারি, তাহলে আমাদের সিনেমা সারা পৃথিবীর বুকে ভালো করবে। সেই প্রত্যাশা করি। বাংলা সিনেমা দেখবেন, বাংলা সিনেমার পাশে থাকবেন। অন্যায় হলে আপনারা সবাই প্রতিবাদ করবেন। সবাই ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।

আরশি : ধন্যবাদ রায়হান রাফীকে এতো দারুণভাবে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর করার জন্য। দর্শক, আয়োজনের একেবারেই শেষপ্রান্তে চলে এসেছি আমরা। সমাপন বক্তব্যের জন্য ডেকে নিবো ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সম্পাদক কাজী মামুন হায়দারকে। সেইসঙ্গে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর অন্য কোনো আয়োজনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমরাও। সবাই ভালো থাকবেন।

মামুন হায়দার : রায়হান রাফীকে ধন্যবাদ। খুবই ছোট্ট করে আমি দুই-একটা কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হচ্ছে ফিল্ম নিয়ে¾বাংলাদেশে গত ৫০ বছরের ইতিহাস যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন, খুবই অদ্ভুত একটা ডিলেমা আছে। কোনটাকে ফিল্ম বলবো আর কোনটাকে বলবো না, তা নিয়ে। কেউ তারকোভস্কি দেখছে, কেউ সত্যজিতের কথা বলছে। রাফী যা বানাচ্ছেন তা আদৌ ফিল্ম হচ্ছে কিনা, অসংখ্য যুক্তিতর্ক, কাউকে অবজ্ঞা করা, অবহেলা করা¾এই একটা ট্রেন্ড বাংলাদেশে চলেছে গত ৫০ বছরে। এবং এই ট্রেন্ড আপনি যদি অন্যভাবে বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করে ফেলেছে।

৮০’র দশকে একদল তরুণ নির্মাতা যখন এফ ডি সি’তে সিনেমা বানাতে গিয়েছিলো, তখন তারা সাপোর্ট পায়নি সেখানে। একটা পর্যায়ে তারা মনে করেছে, তারা যে ধরনের সিনেমা বানাতে চায়, এই এফ ডি সি সেই সিনেমা বানানোর জায়গা না। অন্যদিকে এফ ডি সির মানুষরা তখন মনে করেছে এরা সিনেমাটা-ই বোঝে না। ওখানে দুই পক্ষ দাঁড়িয়ে গেলো। একপক্ষ মনে করেছে এদের সিনেমা হয় না; আরেকপক্ষ মনে করেছে এরা সিনেমা বোঝে না। এই না বোঝাবুঝির পর্যায়ে ৮০’র দশকে একটা বড়ো অংশের মেধাবী নির্মাতা¾যদি আমি কোট আনকোটে বলি¾এফ ডি সি থেকে বের হয়ে এসেছিলো। তারা বিকল্প ধারার একটা চলচ্চিত্র আন্দোলন করেছিলেন। যে আন্দোলনটা পরে আর বাংলাদেশে দাঁড়ায়নি। এর ফলে যেটা হয়েছে, এফ ডি সিতে মেধাবী ঢোকার যে পাইপলাইন ছিলো, সেই পাইপলাইনটা আমরা ৮০’র দশকেই কেটে ফেলেছিলাম। যদি ওই পাইপলাইনটা থাকতো তাহলে আজকে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে আলাদা করে রায়হান রাফীকে এই কথাটা বলার দরকার ছিলো না, তিনি কমার্শিয়াল সিনেমা বানান। ডিরেক্টর সিনেমা বানান, সেটা কমার্শিয়াল নাকি আর্টফিল্ম সেটা ম্যাটার করে না। ফিল্ম একইসঙ্গে শিল্প, আবার বাণিজ্য। আপনি টাকা ছাড়া সিনেমা বানাতে পারবেন না।

রাফী বার বার একটা কথা বলেছেন¾ভাই, আমি কিন্তু কোনো কিছু ফ্রি দেখাতে চাই না। আসলেই পৃথিবীতে কোনো কিছু ফ্রি দেখানো উচিত নয়। এই বক্তৃতাটাও আপনাদের ১০ টাকার টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো। এই ফ্রি দেখানোর কালচারের কারণে বাংলাদেশের সিনেমাটা শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন অনেকেই ফেইসবুকে রিলস্, ইউটিউবে শর্টস্ দেখছি, সিনেমা দেখছি। আপনাদের কি মনে হয় আমরা এসব ফ্রি দেখতে পারি? এর পেছনে যে হাজার হাজার কোটি টাকার বিজনেস আছে, সেই খবরটা কিন্তু আমি-আপনি জানি না!

দুঃখটা কী জানেন, এই দেশের হাজার হাজার তরুণ যে ভিডিওটা বানায়, সেই ভিডিও ১০ টাকা রোজগার করলে, সেখান থেকে মাত্র দুই টাকা পায় ওই তরুণ। বাকি আট টাকার মালিকানাটা তার থাকে না। রায়হান রাফী গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, তিনি ১০ টাকার মালিকানা দাবি করছেন কোনো না কোনোভাবে। উনি বলছেন, আমি এটা বানিয়েছি ভাই, আপনাকে মাগনা দেখাবো না। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ¾নারী বিদ্বেষ, সহিংসতা আরো কতো কী! সারা পৃথিবীতে এগুলো হয়েছে। ডিরেক্টর তার মতো করে সিনেমা বানাবে, সেটাই তার স্বাধীনতা। তারকোভস্কি তার মতো করে সিনেমা বানিয়েছেন, আইজেনস্টাইন তার মতো করে সিনেমা বানিয়েছেন। রাফী তার মতো করে সিনেমা বানান। এটা নিয়ে তো কোনো ধরনের সমস্যা নাই! ফারুকী-ও তার মতো করেই সিনেমা বানান। নির্মাতা আবু সাইয়ীদ সিনেমা বানাতে বানাতে আর পারেননি, অন্য ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেটাও করতে পারেননি, এখন বিদেশে গিয়ে থাকছেন। আরেকজন মোরশেদুল ইসলাম এইটিজে বিকল্পধারার সিনেমা বানিয়েছিলেন, এখন সবকিছু বাদ দিয়ে ‘সময় টেলিভিশন’-এ সরকারের দালালি করেছেন। তার চেয়ে রাফী যদি তার মতো করে সিনেমা বানিয়ে বি এম ডব্লিউ’তে চড়েন, তাতে আপনার আমার কী সমস্যা! আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না। এই সমস্যাটার কথা বলেই আপনারা গত ৫০ বছরে সিনেমাটা শেষ করে ফেলেছেন। আজ এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে এটাই আমার কথা।

কথামালা শেষে রায়হান রাফীর সঙ্গে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবার’-এর সদস্যরা,  ছবি : ম্যাজিক লণ্ঠন 

আমাদের বন্ধুদের অনেকেই সিনেমার সমালোচক, বোদ্ধা। তাদের অনেকেই বললেন, রাফীকে ডেকেছেন! রাফী সিনেমা নিয়ে কী বলবেন? ও তো তারকোভস্কি দেখেনি। তো আপনি কী কী দেখেছেন? আপনি তারকোভস্কি দেখেছেন, কিন্তু তুফান তো দেখেননি। অনেকে ফ্লেক্স করে বলে, আমি তো শাকিব খান-এর সিনেমা দেখি না! আপনি তাহলে কার সিনেমা দেখেন! আপনি যেই সিনেমা দেখেন, সেই সিনেমা কি সাধারণ মানুষ দেখে? তারা তো সেটা দেখে না। তার মনোগঠন কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে তৈরি হয়েছে শাবানা, ববিতাকে দেখে। সে কিন্তু সুন্দরের পরিমাপ করে শাবানা, ববিতাকে দেখেই। আপনি তো আপনার সিনেমা দিয়ে এই কালচারে পরিবর্তন আনতে পারেননি। আপনি তাদের কাছে যেতে পারেননি। রাফী যদি তার বক্তব্য নিয়ে তাদের কাছে যায়, তাতে আপনার সমস্যা কী? আমি তো আল্টিমেটলি কোনো সমস্যা দেখি না।

রাফী আজকের আলোচনায় একটা কথা বলেছেন, আমরা এখানে সিনেমার কালচারই ডেভেলপড করতে পারিনি। যে সময়ে কালচারটা ডেভেলপ হতে পারতো, ৭১ পরবর্তী সময়ে, সেটা হয়নি। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সিনেমা যেখানে দাঁড়ানোর কথা ছিলো, সেই কালচারই আমরা ডেভেলপ করতে পারিনি। এর ফলে এতো দ্বন্দ্বের কথা আমরা বলেছি।

দেখেন, আর্টফিল্ম শব্দটা বাদ দিয়ে তার নাম হওয়া উচিত প্যারালাল সিনেমা। ব্যবসা প্রাধান্যশীল সিনেমা কিছু বানাবো, তার সমান্তরালে আরেক ধরনের সিনেমা চলবে। যেটাকে আপনারা আর্টফিল্ম বলেন। একইসঙ্গে সিনেমা নিয়ে আলোচনা, ক্রিটিক চলবে। এই যে বক্তৃতা, আলোচনার আয়োজন, সেগুলোও একই সঙ্গে চলবে। যদি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ফিল্মকে দেখতে চান, সবকিছুর সমন্বয় যদি না করতে পারেন, তাহলে ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করবে না। আমাদের দেশে এর কোনোটাই হয়নি, যেটা খুবই দুঃখজনকভাবে। কোনোটা যেমন হয়নি, আবার হতেও দেওয়া হয়নি। এটা হচ্ছে আমাদের এখানকার বাস্তবতা। এই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

ডিরেক্টর স্টার হয়ে উঠতে পারেন, জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন, সেটা অনেক আগে একসময় কাজী হায়াৎ দেখিয়েছিলেন। ফারুকীও কিছুটা হয়ে উঠেছেন। এখন রাফী সেটা হয়ে উঠছেন। আমরা যে স্টারডমের কথা বলি, ডিরেক্টর সেই স্টার হয়েছেন। এটাকে আমি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখি। একজন ডিরেক্টরের স্টারডম থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাফীকে দেখা যায় না, সে কারণে রাফীর ফেইস হয়তো অনেক মানুষ চিনে না, কিন্তু রাফী স্টার ডিরেক্টর। রাফী দামাল-এর কথা বললেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা। ‘চ্যানেল আই’ প্রোডিউস করেছে। সর্বশেষ উনি যে ওয়েব ফিল্ম মায়া বানিয়েছেন ‘বিঞ্জ’-এর জন্য¾আপনারা অনেকেই হয়তো দেখেননি সিনেমাটা। পারলে দেখবেন। রাফী কথা বলতে শুরু করেছেন, রাফী তার ভাষায় কথা বলছেন। রাফীর চলচ্চিত্রে নারীর পজিশন নিয়ে আপনি নানা প্রশ্ন তুলছেন। রাফী যে উত্তর দিলেন এখানে, এবং উল্টো যে প্রশ্ন তুললেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আপনি কি দিতে পারবেন? কেনো নিঃশ্বাস আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় না? এ কে ফোরটি সেভেন নিয়ে ফারিণ যখন গুলি করে, সেই গুলি আপনার দেখতে কেনো ভালো লাগে না। সমস্যা তো রাফীর না। সমস্যা আমার-আপনার মস্তিষ্কের।

রাফী জুলাই-আগস্ট মুভমেন্ট নিয়ে যে প্রশ্নটা তুলেছেন¾কতোজন নারী সমন্বয়কের নাম আমরা জানি? পুরো সোসাইটিতেই আমরা ভয়ঙ্করভাবে নারী ইস্যুকে ডেকে রেখেছি। এখন যতো কথা হচ্ছে তাহলো, নারী কী পরবে, কীভাবে হাঁটবে, কীভাবে চলবে¾পুরুষ কীভাবে চলবে, হাঁটবে সে কথা বলেছে কেউ? বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল সে কথা বলেছে? বলছে না। শুধু নারী কীভাবে চলবে, কীভাবে হাঁটবে, কার সঙ্গে বসতে পারবে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। সোসাইটির টোটাল অবস্থা যখন এই, তখন নারীকে রাফী যেভাবে দেখান¾উনি বলছেন যেভাবে উনি নারীকে দেখেছেন সেভাবেই নারীকে দেখান। সমস্যা কী, আপনি ভিন্নভাবে দেখান নারীকে। ইন্ডাস্ট্রি যখন ডেভেলপ করে, তার মধ্যে ভ্যারাইটিজ জিনিস থাকবে। আপনি খালি টুয়েলভথ ফেইল-এর কথা বলছেন, ইন্টারস্টেলার-এর কথা বলছেন। আপনি কী এটা জানেন ইন্টারস্টেলার যে ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি হয়, সেখানেই হাজার হাজার কোটি টাকার পর্নোগ্রাফিও তৈরি হয়। একটা ইন্ডাস্ট্রি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। ইন্ডাস্ট্রির নানা উইং থাকে। এখানে যেমন নূরুল আলম আতিককে এনেছিলাম আমরা, একইসঙ্গে রাফীকেও এনেছি। আগের দিনের পপুলার ডিরেক্টররা বেঁচে থাকলে আমরা তাদেরকেও আনতাম। আমরা বলতাম, এইট্টিজে আপনি যে রাজা-বাদশার সিনেমা বানিয়েছেন, মানুষ উড়ে যাওয়ার সিনেমা বানিয়েছেন, সেগুলো কেনো বানিয়েছেন? আমার খুব ইচ্ছা ছিলো পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল যদি বেঁচে থাকতেন, তাকে এখানে নিয়ে আসার। উনি বেদের মেয়ে জোসনা কেনো, কীভাবে বানিয়েছেন সেটা জানার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই মানুষগুলো আর নেই আমাদের মাঝে।

বেদের মেয়ের জোসনার সঙ্গে তুফান-এর সম্পর্ক করতে পারি আমরা। ১৯৮৯-তে তৈরি হচ্ছে বেদের মেয়ে জোসনা। প্রচণ্ড হিট হয়েছিলো। তখনকার হিসাব বলে, ১৬ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে সিনেমাটা। উনি এখন পর্যন্ত তুফান-এর কথা বললেন ৫৩ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। আপনার কি মনে হয়, শুধু দুষ্টু কোকিল দেখার জন্য এতো মানুষ তুফান দেখতে গেছে? সেই সময়ে বেদের মেয়ে জোসনায় কি দর্শক কেবল অঞ্জু ঘোষ আর ইলিয়াস কাঞ্চনের নাচ দেখতে গিয়েছে? আপনি শুধু নাচের কথাটা বলেন¾‘তুমি জোসনা হেথা দিয়েছিলে কথা’। কিন্তু রাজার সামনে দাঁড়িয়ে জোসনা যখন বলেন, ‘আপনি আপনার কথা রাখেননি। আপনি বলেছিলেন যদি রাজকুমারকে বাঁচাতে পারো, যা চাইবে তাই পাবে।’ তারপর কী হলো? রাজকুমার যখন বেঁচে গেলো তখন ওই বেদের মেয়ে বললো, আমি ওই রাজকুমারকেই চাই। এটা শুনে হুংকার দিয়ে রাজা বললেন, তোমার এতো বড়ো সাহস তুমি রাজকুমারকে চাও। তখন বেদের মেয়ে জোসনা বলছেন, আপনি রাজা কথা দিয়েছিলেন রাজকুমারের জীবনের বিনিময়ে যা চাইবো আপনি আমাকে তাই দিবেন। কিন্তু এখন আপনি সেই কথা রাখলেন না। তখন জোসনা দেয়ালে মাথা ঠুকে বলেন, আমি আমার রক্তের দাগ এখানে রেখে গেলাম, আপনি আপনার কথা রাখেননি।

সরকারের সামনে, রাষ্ট্রের সামনে, কাঠামোর সামনে দাঁড়িয়ে এই চ্যালেঞ্জ করার প্রসঙ্গ ১৯৮৯ সালে তোজাম্মেল হক বকুল দেখিয়েছিলেন তার বেদের মেয়ে জোসনায়। ২০২৩ সালে এসে আমাদের রাফী দেখাচ্ছেন, এমন একজন তুফানকে যিনি কোনো ভিন্নমত রাখবেন না, ভিন্নমত রাখতে চান না। তিনি হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছেন¾বাবাকে হত্যার। তুফান কোনো ভিন্নমত রাখলেন না¾এতো বড়ো একটা স্টেনগান এনে অন্য দলের সব নেতাকর্মীদের মেরে ফেললেন। মেরে ফেলে কী বললেন, ‘ভোট দিবেন কাকে? তুফানকে।’ একবার ভাবেন, আপনি গত ১৫ বছর কোন রাষ্ট্রের মধ্যে ছিলেন? ভোট দিবেন কাকে? আপনি জানতেন না ভোট কাকে দিতে হবে? সেটা রাফীকে চিৎকার করে কেনো বলতে হবে, আমি এটা এই সরকারকে নিয়েই বানিয়েছি। আপনি বুঝে নেন। আপনি যদি না বোঝেন, তাহলে ওই সিনেমা দেখার আপনার দরকার নেই। রাফী এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তোজাম্মেল হক বকুল-ও বেদের মেয়ে জোসনা বানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ-ই হয়েছিলেন।

এইটুকুই আমার বলা। ধন্যবাদ সবাইকে। আমরা আবারও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। রাফী প্রচণ্ড ব্যস্ত এখন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও আমরা খুব স্টাবল আছি, এমন না। কালকে ওনার শুটিং আছে। আজকেই ওনাকে আবার ঢাকাতে যেতে হবে। এই প্রোগ্রামটা বিকাল বেলা হলে বোধ হয় ভালো হতো। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছিলাম। খুব অল্প সময়ের নোটিশের মধ্যে সময়টা পরিবর্তন করতে হয়েছে। তারপরও আপনারা এসেছেন এখানে। আবার কালকে রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রাজশাহীর ছেলেমেয়েরা এমনিতেই বেশি ঘুমায়, তার ওপর আবার বৃষ্টি [দর্শকের হাসি]। এরপরও কিছু মানুষ এখানে এসেছেন, সেটা রাফীর জন্যই হোক কিংবা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর জন্যই হোক বা সিনেমার প্রেমেই হোক, এসেছেন তো! এটাই বড়ো কথা। কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন, কিছু প্রশ্ন নিশ্চয় নিজের জন্য নিয়েছেন। রাফীকে আমরা যদি পরবর্তী সময়ে কোনো বিষয় নিয়ে ডাকি নিশ্চয় আপনারা পাশে থাকবেন। এই আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।

 

রায়হান রাফী

kanonfilmsbd@gmail.com

raihanrafi008@gmail.co

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন